চলতি মাসে তুরস্কের ছোড়া একটি বুলেট যুক্তরাষ্ট্রের কানের লতি ছুঁয়ে বেরিয়ে গেছে। সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে চলমান লড়াইয়ে মার্কিন বাহিনীর প্রধান মিত্রগোষ্ঠী সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেসের (এসডিএফ) প্রধান মজলুম আবদিকে নিশানা করে তুরস্ক হামলা চালিয়েছিল।
আবদিকে তিনজন মার্কিন সেনা প্রহরা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এ সময় তুর্কি ড্রোন থেকে হামলা চালানো হয়। হামলা থেকে সবাই রক্ষা পেলেও এ ঘটনা তুরস্ক-আমেরিকা সম্পর্ককে একটি ভয়ংকর সংকটে ফেলে দিয়েছে।
তুরস্ক হয়তো ইচ্ছা করেই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়েছে। কিন্তু তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের মূল লক্ষ্য যদি গুলিবর্ষণের মাধ্যমে কোনো বার্তা দেওয়া হয়ে থাকে, তাহলে সে লক্ষ্য অর্জনে তিনি সফল হয়েছেন। আর যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্কের কূটনীতিতে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গেছে। ন্যাটো ইস্যুতে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র-তুরস্ক কূটনৈতিক সম্পর্ক সংকটের মধ্যে ছিল। এ ঘটনা সেটিকে আরও জটিল করল।
তুরস্কের গোলার মুখে যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথমবারের মতো পড়েনি। এর আগে ২০২২ সালের নভেম্বরে আমেরিকান সেনাদের ১৩০ মিটারের মধ্যে থাকা এসডিএফ কার্যালয় লক্ষ্য করে তুরস্ক হামলা চালিয়েছিল। সেবারও মার্কিন বাহিনীর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এ দুটি হামলার কোনো একটিতেও যদি আমেরিকান সেনারা মারা যেতেন, তাহলে মার্কিন কংগ্রেস কী প্রতিক্রিয়া দিত, তা অনুমান করা খুব কঠিন কিছু নয়।
তুরস্কের সরকারে কর্তৃত্ববাদ উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা, সিরিয়া ও ইজিয়ান অঞ্চলে তাদের সামরিক আচরণ, ন্যাটোতে সুইডেনের সদস্য পদ চাওয়ায় ভেটো দেওয়া এবং রাশিয়ার কাছ থেকে বিমানবিধ্বংসী এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা কেনাসহ নানা কারণে তুরস্ক ক্যাপিটল হিলের নেক নজরের বাইরে আছে।
তুরস্কের সমালোচনা করার বিষয়ে জো বাইডেনের প্রশাসনের অনিচ্ছার বিষয়ে ইতিমধ্যে কংগ্রেস নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো এরদোয়ান কেন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এ ধরনের একটি ঝুঁকিপূর্ণ খেলায় নামলেন? এর নিশ্চিত জবাব হলো, রাজনীতি। শুধু রাজনৈতিক কারণে এরদোয়ান এসব করছেন।
তবে জো বাইডেন ইচ্ছা করেই ড্রোন হামলা নিয়ে এরদোয়ানের সঙ্গে বিবাদে জড়াননি। তবে এরদোয়ানের সঙ্গে তিনি দূরত্ব বজায় রাখছেন। তিনি হোয়াইট হাউসে এরদোয়ানকে আমন্ত্রণ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এরদোয়ান চান তুরস্কের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র তুর্কিবিরোধী কড়া অবস্থান নিক।
মনে রাখা দরকার, আগামী মাসে এরদোয়ান তাঁর পুনর্নির্বাচনের জন্য লড়বেন। গোটা দেশ এবং রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কার্যত ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে রূপান্তরিত করা একজন জনতুষ্টিবাদী কর্তৃত্ববাদী নেতা হিসেবে তিনি এ ক্ষমতা ছাড়তে চাইছেন না। মজলুম আবদি এবং আমেরিকান সেনাদের ওপর হামলা চালানো দেখে বোঝা যায় এরদোয়ান কতটা বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। হামলায় তিনি যদি সফল হতেন, তাহলে তিনি এটিকে একটি বিজয় হিসেবে চিত্রায়িত করতেন এবং নিজের নির্বাচনী জয়ের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতেন।
উত্তর সিরিয়ায় তৎপর থাকা কুর্দি জনগোষ্ঠীকে এরদোয়ান সন্ত্রাসী হিসেবে মনে করেন এবং তাদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের অংশীদারির তিনি কঠোর সমালোচক। কুর্দিদের নিয়ে তুরস্ক অনেক আগে থেকেই ঝামেলায় আছে। পিকেকে, কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টির মতো বিদ্রোহী কুর্দি গোষ্ঠীর পাশাপাশি শান্তিপূর্ণ ঘরোয়া কুর্দিবিরোধী দলগুলোকে সামাল দিতে গিয়ে এরদোয়ানকে যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে।
সিরিয়ার কুর্দিরা তাদের সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য তুরস্কের কুর্দিভিত্তিক পিকেকের কাছে ঋণী। কিন্তু সিরিয়ার কুর্দিরা কখনো তুরস্কের ভূখণ্ডে ঢুকে কুর্দিদের সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে যোগ দিয়েছে, এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, এরদোয়ান উত্তর সিরিয়ায় সেনা পাঠিয়ে কুর্দিদের কিছু ভূখণ্ড দখল করেছেন, অনেক কুর্দিকে বাস্তুচ্যুত করেছেন এবং ওয়াশিংটনের মিত্র কুর্দিদের বিরুদ্ধে নিষ্ঠুর ড্রোন হামলা চালিয়েছেন।
আপাতত যুক্তরাষ্ট্র তুরস্কের এ তৎপরতাকে একেবারে ঠেলে সরিয়ে দেওয়ার বদলে দমিয়ে রাখার নীতি নিয়েছে। তুর্কি সরকার নিরবচ্ছিন্ন প্রচারের মাধ্যমে তাদের জনগণকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছে, শুধু কুর্দিরাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রও এখন তুরস্কের জন্য বড় হুমকি। সাম্প্রতিক এ দুটি হামলা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্কের শীতলতা বাড়িয়েছে, যা এরদোয়ানের জন্য একধরনের সুযোগ করে দিয়েছে।
ওয়াশিংটন আঙ্কারাকে ১৪ মে অনুষ্ঠেয় তুরস্কের জাতীয় নির্বাচনের আগে সিরিয়ার কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করতে বলেছে। উচ্চপদস্থ মার্কিন কর্মকর্তারা সম্প্রতি উত্তর সিরিয়া সফর করে তুরস্ককে এ বিষয়ে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে।
অন্যদিকে ভয়াবহ ভূমিকম্পে নাজুক অবস্থায় পড়ে যাওয়া তুর্কি অর্থনীতির যে বাইরের সহায়তা দরকার, সেটিও যুক্তরাষ্ট্র এরদোয়ানকে মনে করিয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র এ বার্তা দিয়েছে যে আমেরিকা তুরস্ককে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার সামর্থ্য রাখে, কিন্তু আমেরিকান সেনাদের ওপর গুলি চালিয়ে সেই সহায়তা পাওয়া যাবে না।
তবে জো বাইডেন ইচ্ছা করেই ড্রোন হামলা নিয়ে এরদোয়ানের সঙ্গে বিবাদে জড়াননি। তবে এরদোয়ানের সঙ্গে তিনি দূরত্ব বজায় রাখছেন। তিনি হোয়াইট হাউসে এরদোয়ানকে আমন্ত্রণ জানাতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন। এরদোয়ান চান তুরস্কের নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র তুর্কিবিরোধী কড়া অবস্থান নিক।
এটি ভোটারদের কাছে তাঁর জনপ্রিয়তা বাড়াবে। এ বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্র বুঝতে পারছে। সে কারণেই বাইডেন তুরস্কের বিরুদ্ধে কঠোর কিছু বলছেন না। অবশ্য কংগ্রেস তুরস্কের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বাইডেনকে চাপ দেওয়ার পক্ষে। তবে বাইডেন তুরস্কের নির্বাচনের আগে সে ধরনের কিছু করতে রাজি নন।
এরদোয়ান উসকানি দিয়ে ওয়াশিংটনকে রাগিয়ে দিয়ে আগামী নির্বাচনে ফায়দা তুলতে চাইছেন। এটি বুঝে ততোধিক সতর্ক হচ্ছেন বাইডেন।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
হেনরি জে বার্কি পেনসিলভানিয়ার বেথলেহেমের লেহাই ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক