টিকটকের নিষেধাজ্ঞা তুলে সর্বনাশ ডেকে আনছেন ট্রাম্প

ডোনাল্ড ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, কংগ্রেস এবং সুপ্রিম কোর্টের মধ্যে যখন একসঙ্গে অস্থির ভাব দেখা যায়, তখন সাধারণত তার পেছনে বড় কোনো সংকট বা গুরুত্বপূর্ণ নীতি পরিবর্তনের বিষয় থাকে। কিন্তু এবার এসব প্রতিষ্ঠানের অস্থিরতার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে টিকটক। এটি একটি চীনা মালিকানাধীন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। এই মাধ্যমে নাচ, গান, মজার ভিডিওসহ নানা ধরনের কনটেন্ট শেয়ার করা হয়। 

যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু হোয়াইট হাউসে ফেরার প্রথম দিনেই ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাহী আদেশে সেই নিষেধাজ্ঞা স্থগিত করেছেন। এর মধ্য দিয়ে তিনি কংগ্রেস ও সুপ্রিম কোর্টের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের এই আদেশ চীনা মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানটিকে আনন্দিত করেছে। 

ট্রাম্পের আদেশের কারণে টিকটকের অনলাইন কনটেন্ট নির্মাতারাও স্বস্তি পেয়েছেন। তাঁদের অনেকের মতে, নিষেধাজ্ঞা (অথবা অ্যাপটি কোনো মার্কিন কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা) তাঁদের জন্য বড় ক্ষতি ডেকে আনতে পারত। তবে টিকটক অনেক মার্কিন নাগরিকের কাছে এখনো আতঙ্ক। আমি এই আতঙ্কের নাম দিয়েছি ‘টিকটক্যালিপস্‌’। 

টিকটকের নিরাপত্তাঝুঁকি এবং কনটেন্ট নির্মাতা ও ইন্টারনেট প্ল্যাটফর্মগুলোর স্থিতিশীলতা সম্পর্কিত ভুল ধারণার ফলে এই আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। টিকটকের ১৭ কোটি মার্কিন ব্যবহারকারী প্রতিদিন গড়ে ৯০ মিনিট অ্যাপটি ব্যবহার করেন, যা আমেরিকানদের খাবার ও পানীয় গ্রহণের সময়ের চেয়ে বেশি। ফলে চীন এমন একটি নজরদারি হাতিয়ার পেয়েছে, যা একসময় স্তালিন কিংবা জেমস বন্ডের ভিলেন ব্লোফেল্ড কেবল স্বপ্নেই কল্পনা করতে পারতেন। 

এটি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। তাই কোনো বিদেশি সংস্থা যদি বিপুলসংখ্যক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, তাহলে এটি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে কেবল আবেগ দিয়ে ভাবা ঠিক হবে না; বরং বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। 

চীন এমনিতেই বড় পরিসরে গোয়েন্দাগিরি চালায়। ১৪ জানুয়ারি এফবিআই ঘোষণা দিয়েছে, ‘মুস্তাং পান্ডা’ নামের চীনা সরকারি হ্যাকার গ্রুপ হাজার হাজার কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার ছড়িয়ে সংবেদনশীল নিরাপত্তা–তথ্য চুরি করেছে। গত বছর এফবিআই জানিয়েছিল, চীন এমন এক সাইবার আক্রমণ চালিয়েছিল, যা দেখে মনে হয়েছিল, আইডিয়াটি হলিউডের ডাই হার্ড সিনেমা থেকে নেওয়া। ওই সময় চীনা হ্যাকাররা যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত নেটওয়ার্কে ঢুকে পড়েছিল। যদি মার্কিন সরকার এই সাইবার আক্রমণ ঠেকাতে না পারত, তাহলে হ্যাকাররা পানীয় জল সরবরাহ, গ্যাস পাইপলাইন, বিমান চলাচল নিয়ন্ত্রণসহ নানা গুরুত্বপূর্ণ ব্যবস্থা অচল করে দিতে পারত।

 চীনের কিছু হাস্যকর গোয়েন্দা তৎপরতা (যেমন ২০২৩ সালের ‘বেলুন–কাণ্ড’) নিয়ে ঠাট্টা করা যেতেই পারে। কিন্তু এটিও মাথায় রাখতে হবে, চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং তাঁর ‘ধোঁয়াবিহীন যুদ্ধ’ নীতির মাধ্যমে বিশ্বে আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তাই টিকটকের ঝুঁকিকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত হবে না। 

টিকটকের মূল কোম্পানি ‘বাইটড্যান্স’ দাবি করেছিল, তারা মার্কিন ব্যবহারকারীদের তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের সার্ভারে সংরক্ষণ করবে। কিন্তু ফাঁস হওয়া অভ্যন্তরীণ বৈঠকের অডিওতে শোনা গেছে, চীনের প্রকৌশলীরা বারবার টিকটক ব্যবহারকারীদের ‘লোকেশন, ব্রাউজিং হিস্ট্রি’সহ নানা তথ্য সংগ্রহ করেছে। যখন ১৮-২৯ বছর বয়সী আমেরিকানদের ‘৩৯ শতাংশ’ (যার মধ্যে সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মচারীরাও রয়েছেন) নিয়মিত টিকটক ব্যবহার করেন, তখন এটি আর শুধু নাচগানের বা মেকআপ টিপসের বিষয় থাকে না; বরং তা জাতীয় নিরাপত্তার গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে ওঠে।

টিকটকের অ্যালগরিদম শুধু আমেরিকানদের ওপর নজরদারি করে না; বরং এটি যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক আলোচনাকেও প্রভাবিত করে। ‘অ্যালায়েন্স ফর সিকিউরিং ডেমোক্রেসি’ নামক একটি গবেষণা সংস্থা দেখিয়েছে, টিকটক প্রায়ই রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার কনটেন্ট ঠিকভাবে লেবেল করাকে নস্যাৎ করে দেয়। ফলে ইউক্রেন যুদ্ধের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে রুশ প্রোপাগান্ডা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। 

আগে দেশপ্রেমিক নাগরিকেরা সরাসরি বিদেশি প্রভাবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিত। কিন্তু এখন তা আইনি কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ। অনেক কনটেন্ট নির্মাতা ভাবছেন, বাইটড্যান্সকে টিকটক বিক্রি করতে বাধ্য করা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। কিন্তু আজকের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতায় বোঝা যায়, তা মোটেও হবে না। কারণ, টিকটকের বিকল্প হিসেবে অনেক জনপ্রিয় প্ল্যাটফর্ম আছে। সেখানে তাঁরা সহজেই তঁাদের ভিডিও প্রকাশ করতে পারবেন। ইনস্টাগ্রাম রিলস প্রতি মাসে ২০০ কোটির বেশি ব্যবহারকারী পর্যন্ত পৌঁছায়, আর ইউটিউব শর্টস প্রতিদিন ৭ হাজার কোটির বেশিবার দেখা হয়। ২০১৭ সালে যখন ভিডিও প্ল্যাটফর্ম ভাইন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, তখন এর নির্মাতারা হারিয়ে যাননি; বরং ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম এবং স্ন্যাপচ্যাটের মতো নতুন প্ল্যাটফর্মে তাঁরা নিজেদের জায়গা করে নিয়েছিলেন। 

ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন টিকটক নিয়ে একটি চুক্তি করতে চান এবং টিকটক কিনতে আগ্রহী মার্কিন কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে বাইটড্যান্স অনেক বড় অঙ্কের অর্থ পেতে পারে। এই অঙ্ক ১০১ বিলিয়ন ডলারের স্পটিফাইয়ের মূল্যকে ছাড়িয়ে যেতে পারে এবং নেটফ্লিক্স বা ডিজনির মতো শত শত বিলিয়ন ডলারের কোম্পানির পর্যায়ে পৌঁছালেও অবাক হব না। 

বর্তমান বিশ্বে তথ্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, যাকে অনেক ক্ষমতাধর দেশ ও কোম্পানি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। এখনকার যুগে তথ্যকে ‘নতুন যুগের পারমাণবিক অস্ত্র’ হিসেবে দেখা হয়। কারণ, এটি অত্যন্ত শক্তিশালী হাতিয়ার হতে পারে। তাই কোনো বিদেশি সংস্থা যদি বিপুলসংখ্যক মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখে, তাহলে এটি নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। সুতরাং এই ক্ষেত্রে কেবল আবেগ দিয়ে ভাবা ঠিক হবে না; বরং বিচক্ষণতার সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়াই শ্রেয়। 

টড জি বুকহলজ সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশের প্রশাসনের অর্থনৈতিক নীতির পরিচালক এবং টাইগার হেজ ফান্ডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ