দারিদ্র্যের কলঙ্কতিলক নিয়ে অর্ধশতাধিক বছর পার করেছে রংপুর বিভাগ। যে কটি কারণে দেশ স্বাধীন করার ডাক দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তার মধ্যে অন্যতম কারণ ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া।
৩০ লাখ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশের বৈষম্য দূরীকরণে জরুরি ভিত্তিতে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। বাংলাদেশের সংবিধানও বলছে পিছিয়ে পড়া নাগরিকদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা। এসব এখন কাগজের বিষয়ে পরিণত হয়েছে।
বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুর অঞ্চলের জন্য বরাদ্দ সব সময়ই কম থাকে। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে রংপুর বিভাগের জন্য ১ শতাংশের কম বরাদ্দ ছিল। সেই বছরে ১২ থেকে ১৪ লাখ মানুষের একটি জেলার জন্য ৫ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। আমরা গণমাধ্যম সূত্রে সে বছরের বরাদ্দ জানতে পেরেছিলাম।
নিশ্চয়ই কোনো কোনো বছর এর চেয়েও কম বরাদ্দ দেওয়া হয়। জেলাভিত্তিক বরাদ্দের পরিমাণ অবাধ তথ্যপ্রবাহে যুক্ত হলে আমরা সেগুলোও জানতে পারতাম। রংপুর বিভাগের সঙ্গে বৈষম্যের ব্যবধান ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।
কেবল তিস্তা সুরক্ষাতেই কমতে পারে রংপুরের সঙ্গে অন্য যেকোনো অঞ্চলের উন্নয়নবৈষম্য। বৈষম্য দূর করতে হলে নদী সুরক্ষার পাশাপাশি এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে
যে বৈষম্য দূরীকরণের জন্য মহান মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, সবার আগে সেই লক্ষ্য বাস্তবায়নে আমাদের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজনে বৈষম্য দূরীকরণ মন্ত্রণালয় গঠন করতে হতো। কেবল রংপুর বিভাগের গরিব জেলাগুলো নয়, পার্বত্য জেলাসহ পিছিয়ে পড়া অন্য জেলাগুলোর উন্নয়নবৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। এমনকি উচ্চ শ্রেণির সঙ্গে নিম্ন শ্রেণির বৈষম্যও দূর করা উচিত। এই ঔচিত্যবোধ নিয়ে বড় বড় বক্তৃতা শোনা গেলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দৃষ্টিগোচর হয়নি কখনো।
যেকোনো সভা-সেমিনারে রংপুর নিয়ে আলোচনার সুযোগ থাকলে রংপুরের প্রায় সবাই বৈষম্যের বিষয়কেই সামনে হাজির করেন। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির ‘বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা ২০২৩-২৪ প্রস্তুতি আলোচনা’ ছিল। সেখানে ভার্চ্যুয়াল আলোচনায় রংপুরের যাঁরাই অংশ নিয়েছিলেন, তাঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বৈষম্য দূরীকরণের বাজেট চেয়ে বক্তব্য দিয়েছেন।
দেশের ১০টি গরিব জেলার ৫টি রংপুর বিভাগে। এর মধ্যে দিনাজপুর ছাড়া কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা ও রংপুর জেলার দারিদ্র্যের প্রধানত কারণ নদীভাঙন, সামান্য পানিতে বন্যা। দেশের সবচেয়ে গরিব উপজেলা রাজীবপুর সম্পূর্ণটাই নদীবেষ্টিত। নদীর পরিচর্যা না থাকার কারণে দেশের সবচেয়ে গরিব উপজেলায় পরিণত হয়েছে রাজীবপুর। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে রংপুরের বৈষম্য কমাতে তিস্তা নদী সুরক্ষার জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে।
তিস্তার ভাঙনে গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হচ্ছে। লাখ লাখ হেক্টর জমি ফসলসহ নদীগর্ভে বিলীন হচ্ছে। ভাঙনে আর বন্যায় এক বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়, এর অর্থমূল্য বাংলাদেশে চলমান সব মেগা প্রকল্পের টাকার চেয়ে কম হবে বলে মনে হয় না। নদীর এই ভাঙন সম্পূর্ণ রোধ করা যাবে না, কিন্তু কমানো সম্ভব। আমরা নদীগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে প্রবাহিত হতে দিইনি। আবার নদীগুলোর কোনো পরিচর্যাও করিনি। ফলে নদীগুলো বিধ্বংসী আচরণ করছে।
রংপুর বিভাগে কোনো মেগা প্রকল্প নেই। এ বিভাগে নতুন করে যতগুলো অর্থনৈতিক অঞ্চল হওয়ার কথা ছিল, সেগুলো হয়নি। রংপুরের দারিদ্র্যের হার কমাতে হলে এখানে উন্নয়নবৈষম্য দূরীকরণে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হবে। দারিদ্র্যের মাত্রা অপরিবর্তিত রাখতে হলেও নদীভাঙন ও বন্যা রোধে ব্যবস্থা নিতে হবে। রংপুর বিভাগের চারটি জেলা এমনই ভয়াবহ অবস্থায় আছে যে নদীগুলোর পরিচর্যা করা না করলে দারিদ্র্য বৃদ্ধির হার রোধ করা যাবে না।
তিস্তা নদীতে একটি মহাপরিকল্পনা নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে। এই মহাপরিকল্পনা এখনো দৃশ্যমান হয়ে ওঠেনি। দাবি উঠেছে বিজ্ঞানসম্মতভাবে মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার। তিস্তাপারের সাধারণ মানুষ নদীবিজ্ঞান-নদীপ্রযুক্তি—এসব বোঝে না। তারা প্রধানত চায় ভাঙন আর বন্যা রোধ হোক। অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনার জন্য ভারত ও বাংলাদেশ উভয়ে মিলে বাংলাদেশ-ভারত আন্তসীমান্তীয় নদীগুলো সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন ছিল।
সেটি অসম্ভব। কেননা, ভারতই বাংলাদেশের নদীগুলোকে মেরে ফেলার প্রধান কারণ। সে জন্য নিজ দেশীয় ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলাই আপাতত পথ। তবে ভারত থেকে বাংলাদেশের পানি পেতেই হবে।
অববাহিকাভিত্তিক নদী ব্যবস্থাপনা ছাড়া কেবল একটি নদীর একটি অংশে পরিচর্যা করলেই নদী রক্ষা করা সম্ভব হবে না। যেমন তিস্তা নদী প্রচুর পরিমাণে পলি বহন করে। বাংলাদেশ অংশে ১১৫ কিলোমিটার তিস্তার পরিচর্যা করে যদি শেষ করা হয়, তাহলে পলি ব্যবস্থাপনার কী হবে?
মহাপরিকল্পনায় এসব বিষয়ে কী বলা আছে, সেটি আমাদের জানা নেই। তিস্তা গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে ব্রহ্মপুত্রে মিলিত হয়েছে। এরপর নাম হয়েছে যমুনা। যমুনা গঙ্গার সঙ্গে মিলিত হওয়ার পর নাম হয়েছে পদ্মা। শোনা যায়, মহাপরিকল্পনায় তিস্তার প্রস্থ এক থেকে দুই কিলোমিটারে নিয়ে আসা হবে। তিস্তার পানির প্রবল স্রোতে পলি চলে যাবে ভাটিতে। যমুনা কিংবা পদ্মা থেকে সেই পলি দ্রুত সমুদ্র পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে। নয়তো সেই পলি আবার ভাটির জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে।
রিভারাইন পিপল, তিস্তা বাঁচাও নদী বাঁচাও সংগ্রাম পরিষদ, তিস্তা নদী রক্ষা কমিটিসহ বিভিন্ন সংগঠন তিস্তা সুরক্ষার দাবি করছে। সবাই তিস্তা মহাপরিকল্পনার সঙ্গে একমত না করলেও প্রত্যেকে তিস্তার বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা চায়। বিজ্ঞানসম্মত পরিচর্যা হলেই তিস্তা বাঁচবে। ২০১৬ সালে করা সমীক্ষায় বলা হয়েছে ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কথা। অর্ধযুগ পর সেই টাকার পরিমাণ নিশ্চয়ই বাড়বে।
টাকা যতই বাড়ুক না কেন, আসন্ন বাজেটে এ বরাদ্দ থাকা খুব প্রয়োজন। কেবল তিস্তা সুরক্ষাতেই কমতে পারে রংপুরের সঙ্গে অন্য যেকোনো অঞ্চলের উন্নয়নবৈষম্য। বৈষম্য দূর করতে হলে নদী সুরক্ষার পাশাপাশি এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণ দিয়ে রংপুরের মানুষকে বিদেশে পাঠাতে হবে। এসব দাবি চর্বিতচর্বণ হলেও এর কোনো বিকল্প নেই। এসবই বাস্তবায়ন করতে হবে।
তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক