বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের ভোগান্তি কমাতে এক দশক বছর ধরে আমরা সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবি জানিয়ে আসছিলাম। পত্রপত্রিকায় এ আলোচনার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য মাননীয় রাষ্ট্রপতির সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার তাগিদ দেওয়ার পরই কয়েক বছর ধরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বড় অংশ গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছে।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) গুচ্ছে সায় না দেওয়ায় সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার স্বপ্ন কিছুটা অধরা থেকে যায়।
তবে চলতি মাসের গোড়ার দিকে একটা খুশির সংবাদ দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে ‘একক ভর্তি’ পরীক্ষা নেওয়ার কথা জানিয়েছে সরকার।
ন্যাশনাল টেস্টিং অথরিটির (এনটিএ) অধীন হতে যাওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা শুধু শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি ও আর্থিক ব্যয়ই কমাবে না, বরং ভর্তিব্যবস্থাকে গতিশীল করতে পারে বলেই আভাস পাওয়া যাচ্ছে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রাথমিক এই সিদ্ধান্ত পত্রপত্রিকায় প্রকাশের ৩ দিনের মাথায় ২২টি সাধারণ ও বিজ্ঞান-প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (জেএসটি) যে গুচ্ছভিত্তিক ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করে আসছিল, সে তালিকা থেকে সম্প্রতি নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। প্রথম আলোয় প্রকাশিত খবর বলছে, গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববিদ্যালয়টি একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় সেই আগের নিয়মেই তিনটি আলাদা ইউনিটেই ভর্তি পরীক্ষা আয়োজনের কথা জানিয়েছে।
যদিও ওই সভায় ‘গুচ্ছের পক্ষে কথা বলায় ভূগোল ও পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতিকে মারধর করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক।
নির্যাতনের শিকার ওই শিক্ষক বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম একাডেমি সভায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু হঠাৎ নিজেদের কেন গুচ্ছ থেকে প্রত্যাহার করে নিচ্ছে, তার ব্যাখ্যা সবার সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সে ব্যাখ্যা না দিয়েই গুচ্ছ থেকে বের হয়ে যাওয়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা শুধু অগ্রহণযোগ্যই নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর শামিল।
সরকার যখন অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের কষ্ট লাঘবে ভর্তি পরীক্ষাকে গতিশীল করার চেষ্টা করছে, তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গঠিত জেএসটির গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষা থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিল। ফলে গুচ্ছ পদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে একধরনের সংকট তৈরি হলো। অথচ দুই সপ্তাহ আগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছে থাকার সিদ্ধান্ত জানিয়েছিল। ঠিক দুই সপ্তাহ পর কী এমন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছিটকে পড়ছে, তা বস্তুত স্পষ্ট নয়।
তবে ধারণা করছি, ভর্তি পরীক্ষায় ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি দুঃখ মোচনের উদ্দেশ্য কিংবা ঢাকা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদায় নিজেদের অবস্থান জাহির করার মতো বিষয়গুলো থাকতে পারে। তবে যে পন্থায় এই বিশ্ববিদ্যালয় অনভিপ্রেত অবস্থান নিয়েছে, তা কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য নয়, বরং দীর্ঘদিন ধরে গুচ্ছে যে কৃত্রিম সংকট তৈরি করা হয়েছিল, তার আয়নাবাজি স্পষ্ট হয়েছে।
আপনি যদি পত্রপত্রিকাগুলোয় খেয়াল করেন, তাহলে দেখবেন, গত কয়েকটি শিক্ষাবর্ষে গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষায় যে ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় আয়োজন করেছিল, সেগুলোর মধ্যে এ প্রক্রিয়া নিয়ে শুরু থেকে একধরনের অসন্তুষ্টির কথা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় জানিয়ে আসছিল। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় তেমন কোনো সমস্যার কথা না জানালেও এই বিশ্ববিদ্যালয় বারবার গণমাধ্যমে বলার চেষ্টা করেছে যে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য বারবার নোটিশ দেওয়ার পরও শিক্ষার্থী ভর্তি হচ্ছেন না কিংবা আসনসংখ্যা ফাঁকা থাকছে।
আমি ঠিক নিশ্চিত নই, গুচ্ছভিত্তিক পরীক্ষাকে অজনপ্রিয় করতেই কি ভর্তি পরীক্ষায় এসএসসি ও এইচএসসি শর্ত পূরণের পরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো শর্ত চালু করে রেখেছিল? এর কারণেই কি শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন সময় ভর্তি হতে এসে ভোগান্তিতে পড়েছিলেন? আবার মেধাতালিকা থেকে মাইগ্রেশনে দীর্ঘসূত্রতাসহ বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে শিক্ষার্থীদের একধরনের ভোগান্তির কথা গত দুই শিক্ষাবর্ষ থেকে আমরা জানছি।
এসব জটিলতা কীভাবে কাটবে, তা নিয়ে গত বছর প্রথম আলোয় একটা লেখা লিখেছিলাম, যার বিষয়বস্তুর প্রায়োগিক দিকগুলো জেএসটি গ্রহণ করলে এ সমস্যা থাকার কথা ছিল না। অথচ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে যদি তারা সূক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করত, তাহলে সমস্যাগুলো অচিরেই দূর করা যেত।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মতো সরকারের যুগান্তকারী একটি জনহিতৈষী সিদ্ধান্তকে আমরা এভাবে ভেস্তে দিতে পারি না। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যখন এক কাতারে ভর্তি পরীক্ষায় বসার আয়োজন চলছে, তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। তারা যদি মনে করে, গুচ্ছে সমস্যা রয়েছে, তাহলে সেগুলো সমাধানের পথ না দেখিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া কখনোই সুখকর বিষয় হতে পারে না।
কিন্তু গুচ্ছের সমস্যার দিকে মনোযোগ না দিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক কোন যুক্তিতে ভর্তি পরীক্ষার সন্নিকটে এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বোধগম্য নয়। তবে এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত আমরা হতাশ হয়েছি। যদিও গুচ্ছের এ ইস্যুতে আহ্বান করা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের সভাটি গত শনিবার স্থগিত করার কথা বলা হয়েছে (কালের কণ্ঠ, ৮ এপ্রিল) তবে একাডেমিক কাউন্সিলের সভায় নিজেদের গুচ্ছ থেকে বেরিয়ে আসা একগুঁয়েমি সিদ্ধান্তেরই ফসল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ কথা সত্য, ভর্তি পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দীর্ঘদিন ধরে আর্থিকভাবে লাভবান হয়ে আসছিল। এখন যদি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় মনে করে, গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষায় যাওয়ার কারণে আর্থিকভাবে তাদের ক্ষতিগ্রস্ত হতে হচ্ছে, শিক্ষকদের সম্মানী কমেছে, তাহলে গুচ্ছের সাময়িক সমস্যাগুলোর সমাধান না খোঁজা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কৌশল হতে পারে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা অমূলক হবে না।
আমাদের মনে রাখতে হবে, সাধারণ মানুষের করের পয়সায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পরিচালিত হয়ে আসছে, শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের জিম্মি করে ভোগান্তিতে ফেলার কোনো এখতিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার মতো সরকারের যুগান্তকারী একটি জনহিতৈষী সিদ্ধান্তকে আমরা এভাবে ভেস্তে দিতে পারি না। সব বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে যখন এক কাতারে ভর্তি পরীক্ষায় বসার আয়োজন চলছে, তখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত মেনে নেওয়া যায় না। তারা যদি মনে করে, গুচ্ছে সমস্যা রয়েছে, তাহলে সেগুলো সমাধানের পথ না দেখিয়ে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া কখনোই সুখকর বিষয় হতে পারে না।
হ্যাঁ, এ কথা সত্য, গুচ্ছে ভর্তি পরীক্ষা নতুন, সেখানে কিছু সমস্যা তৈরি হবে—এটাই স্বাভাবিক। তাই বলে ভয় পেয়ে পিছিয়ে যাওয়াটা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীয় চরিত্রের সঙ্গে যায় না। এমন নয় যে দেশে কেবল ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করছে, এখানে প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একটি গুচ্ছে গিয়েছে, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো করছে, সেখানে এই জেএসটির ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন সমস্যায় পড়ছে, তা কি ভেবেছেন? অন্যরা যদি সফলভাবে ভর্তি–পরবর্তী প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করতে পারে, তাহলে এই ২২টি বিশ্ববিদ্যালয় কেন নয়?
গুচ্ছ পরীক্ষা থেকে শেষ বেলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছিটকে পড়াটা উচিত হবে না। সেটি দেখতেও শোভনীয় হবে না। আগামী বছর থেকে সরকার যেহেতু সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার আয়োজন করতেই যাচ্ছে, সেহেতু নতুন করে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় বিতর্কিত হোক, তা আমরা চাই না। নিজেদের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে এবারও জেএসটিতে থাকুক তারা।
বিশ্বাস করি, আগামী শিক্ষাবর্ষ থেকে ভর্তি পরীক্ষায় সব ধরনের জটিলতা এড়ানো সম্ভব হবে। পারিপার্শ্বিক সৌহার্দ্য দেশের উচ্চশিক্ষায় নতুন একটি দিগন্তের সূচনা হবে, সে প্রত্যাশা করি।
ড. নাদিম মাহমুদ গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। ই–মেইল: [email protected]