প্রতি ঈদেই ঢাকা শহর ফাঁকা হয়ে যায়।
এবার ঈদে কত মানুষ ঢাকা শহরের বাইরে যাবেন, সেই হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে গত বছরের ঈদের একটা হিসাব আছে। সাবেক টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছিলেন, ওই সময়ে ঢাকা ছেড়েছেন এক কোটির ওপরে সিম ব্যবহারকারী মানুষ। সিম ব্যবহার করেন না, এমন মানুষও নিশ্চয়ই ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
আমাদের প্রাজ্ঞ মন্ত্রীদের দাবি, দেশের অর্থনীতি অনেক ভালো, মানুষের সামর্থ্য বেড়েছে বলে বেশি দামে পণ্য কিনতেও তাঁদের কোনো সমস্যা হয় না। সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী তো বলেই দিয়েছিলেন, বাংলাদেশে চার কোটি মানুষ ইউরোপীয় মানের জীবনযাপন করেন। কিন্তু তিনি এ কথা বলেননি কত কোটি মানুষ দক্ষিণ সুদান বা সোমালিয়ার মানের জীবনযাপন করছেন। এবারের ঈদ ও বাংলা নববর্ষ মিলে ছয় দিন ছুটি। সে ক্ষেত্রে ঢাকা ছাড়া মানুষের সংখ্যাও আরও বেশি হবে।
এই লেখা যখন লিখছি, রোববার দুপুরেই ঢাকা শহরে যানবাহন অনেক কমে গেছে। সকালে মতিঝিল থেকে কারওয়ান বাজার আসতে লেগেছে ১৫ মিনিট। অন্য সময়ে লাগত কম পক্ষে এক ঘন্টা।
ঈদের সময় এই যে বিপুলসংখ্যক মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন, তাঁরা কোথায় যান? তাঁদের গন্তব্য কোথায়?
একশ্রেণির মানুষ ঈদের সময় বিদেশে যান, দেশে ঈদ করতে তাঁদের ভালো লাগে না। তাঁদের কেউ ধনী, কেউ অতিধনী। দেশের পোশাকও তাঁদের পছন্দ নয়। তাঁরা ঈদ কিংবা বিয়ের বাজারও করেন বিদেশে। ব্যাংকক, দুবাই কিংবা সিঙ্গাপুরে। অনেকের বিদেশে ‘সেকেন্ড হোম’ আছে। একসময় সেকন্ড হোমও ফার্স্ট হোম হয়ে যায়। তখন বছরে একবার ‘নেটিভ’ দেশটিতে বেড়াতে আসেন। এখানকার টার্মিনাল কিংবা পরিবহনে বিশৃঙ্খলা দেখে উষ্মা প্রকাশ করেন। তারপরও তাাঁরা দেশে আসেন নিছক দেশপ্রেমের তাগিদে।
দান–খয়রাত ও ভিক্ষাবৃত্তিকে সম্বল করে কত মানুষ বেঁচে আছেন, সেই হিসাব নেতাদের জানা আছে কি? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যদি লাখ লাখ মানুষকে দানখয়রাত ও ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভর করতে হয়, সেটা উন্নতির লক্ষণ নয়। তাঁরা কি দেশকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেন না, যেখানে নেতাদেরও আড়ম্বর করে গরিব মানুষের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করতে হবে না। প্রতিটি নাগরিক নিজের ইফতার সামগ্রী নিজেই কিনে নিতে পারবেন।
দ্বিতীয় শ্রেণির মানুষ আছেন, ছুটি পেলে দেশের ভেতরই কোথাও বেড়াতে যান। কক্সবাজার, কুয়াকাটা, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি কিংবা সিলেট, সুন্দরবন, শ্রীমঙ্গল, টাঙ্গুয়ার হাওর ইত্যাদি।
তৃতীয় শ্রেণির মানুষ আছেন, যাঁরা শহরে থাকেন কিন্তু শহরের মালিক নন। তাঁরা এই শহরের ভবন, রাস্তাঘাট, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করেন। কিন্তু সেসব ভবনে তাঁদের থাকার এবং বাহনে চলার অধিকার নেই। তাঁরা শহরে আসেন জীবিকার জন্য। মাস শেষে যে মাইনে পান, সেটা গ্রামে থাকা স্বজনদের কাছে পাঠান। ধারকর্জ করে হলেও ঈদের সময় স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, মা, বাবার জন্য নতুন জামাকাপড় কেনেন।
তৈরি পোশাক কারখানা হওয়ার পর এখন গ্রামের মেয়েরাও শহরমুখী এবং স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছেন। তাারাও ঈদে স্বজনদের জন্য কেনাকাটা করেন। ঈদ কারও কারও জন্য আনন্দের হলেও অনেকের দুঃখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিবছরই ঈদের আগে শ্রমিকদের বেতন-বোনাস দেওয়া নিয়ে ঝামেলা হয়। শ্রম প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম চৌধুরী ঈদের আগে সব কারখানায় শ্রমিকদের বেতন–বোনাস দেওয়ার জন্য মালিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু সব মালিক তাঁর কথা শোনেননি।
ঈদের আগে বেতন–বোনাস না দিয়েই কয়েকটি কারখানা বন্ধ করে দিয়েছেন মালিক। এসব কারখানার শ্রমিকেরা ঈদ করতে পারবেন না। হয়তো বাড়িও যেতে পারবেন না।
আর অনানুষ্ঠানিক খাতে যেসব শ্রমিক কাজ করেন, তাঁদের অবস্থা আরও শোচনীয়। অনেক প্রতিষ্ঠানে মজুরিকাঠামো নেই। পুরোটাই চলে মালিকের মর্জির ওপর। অনেক মালিক পুরোনো শ্রমিকদের বাদ দিয়ে নবীন ও নবিশ শ্রমিক নিয়োগ করেন; যাতে বেতন–ভাতা কম দিতে হয়। এমন মালিকও আছেন, শ্রমিক কিংবা গাড়ির চালকদের বছর পুরো করতে দেন না। বছর পুরো হলেই বোনাস দিতে হয়।
অনেক মালিক ঈদের সময় শ্রমিকেরা গ্রামে চলে গেলে খুবই অসন্তুষ্ট হন। ঈদে শ্রমিক বাড়ি গেলে ঘরবাড়ি দেখবে কে? গাড়ি চালিয়ে পরিবারের সদস্যদের পছন্দের জায়গায় নিয়ে যাবে কে?
তারপরও এই গরিবগুরবো মানুষগুলো ছুটি পেলেই বাড়ি যান। কেননা ঢাকা শহরে তাঁদের কোনো বাড়ি নেই। যে গ্রামে তাঁদের জন্ম, সেই গ্রামে মা–বাবার ভিটেটুকুই তাঁর বাড়ি। সেখানে হয়তো বিধবা মা সন্তানের পথের দিকে তাকিয়ে থাকেন। আদরের ছোট বোন আশা করে, ঈদের সময় ভাই তার জন্য নতুন জামা নিয়ে আসবেন। তারা পোশাক চেনে না। পোশাক হলো বড়লোকদের। নানা বাহারের পোশাক। প্রতি ঈদে নতুন নামে নতুন পোশাক। এই শ্রেণির মানুষ আগের ঈদের ডিজাইনের পোশাক আর পরেন না। অথচ দিনযাপনের গ্লানি বয়ে বেড়ানো মানুষের জন্য ফুটপাতের কাপড়ই একমাত্র ভরসা।
এই মানুষগুলোর দেশে যাওয়ার জন্য ব্যক্তিগত গাড়ি নেই। মাইক্রোবাস ভাড়া করে যাবেন, সেই সামর্থ্য নেই। এসি বাসও তাঁদের কল্পনার বাইবে। ফলে কম ভাড়ার লক্কড়ঝক্কড় বাস, ট্রেন কিংবা লঞ্চ যান। দক্ষিণাঞ্চলে যাঁদের বাড়ি, তাঁরা জানেন, লঞ্চে প্রথম বা দ্বিতীয় শ্রেণির কিছু কেবিন থাকে, এর বাইরে সবই ঢালাই বিছানা। যিনি আগে যেতে পারেন, তিনি মাথা পাতার জায়গাটুকু পান। পরে গেলে সারা পথ বসেই যেতে হয়। অনেকে ট্রেনের টিকিট না পেয়ে দাঁড়িয়ে যান। চেকারকে কিছু পয়সা দেন। তারাও গরিবের পয়সায় ভাগ বসান। তবু তাঁদের বাড়ি যেতে হবে আপনজনদের কাছে। কেননা ঢাকা শহরে তাঁদের আপনজন বলতে কেউ নেই।
আরেক শ্রেণির মানুষ আছেন, বিশেষ করে রিকশাচালক, সিএনজি চালক, তারা ঈদের দিনে বাড়ি যান না। বাড়ি যান ঈদের পর দিন। ঈদের দিনে শহরে রিকশা চালালে কিছু বেশি টাকা আয় করা যায়। ঈদের আনন্দের চেয়ে ভবিষ্যতের নিরাপত্তাই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
এবার ঈদের আগে ঢাকা শহরে ভিক্ষুকের সংখ্যা বাড়া নিয়ে রাজনীতিকদের মধ্যে একপশলা বাহাস হলো। ব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি প্রসঙ্গে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, চারদিকে বেদনার্ত মানুষের আহাজারি আর কান্না। কয়েক বছর আগেও রাস্তা-ঘাটে এত ভিক্ষুক দেখা যায়নি।
জবাবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ঈদের সময় ঢাকাসহ বড় বড় শহরে দান-খয়রাতের আশায় কিছু গরিব মানুষ আসেন। কিন্তু এ পর্যন্ত না খেয়ে মানুষ রাস্তায় পড়ে মরে আছে—এমন কেউ নেই।
দান–খয়রাত ও ভিক্ষাবৃত্তিকে সম্বল করে কত মানুষ বেঁচে আছেন, সেই হিসাব নেতাদের জানা আছে কি? স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরও যদি লাখ লাখ মানুষকে দানখয়রাত ও ভিক্ষাবৃত্তির ওপর নির্ভর করতে হয়, সেটা উন্নতির লক্ষণ নয়। তাঁরা কি দেশকে এমন অবস্থায় নিয়ে যেতে পারেন না, যেখানে নেতাদেরও আড়ম্বর করে গরিব মানুষের মধ্যে ইফতার সামগ্রী বিতরণ করতে হবে না। প্রতিটি নাগরিক নিজের ইফতার সামগ্রী নিজেই কিনে নিতে পারবেন।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি