কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে হলিউডে হইচই

টাইম ম্যাগাজিনের ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সম্ভাবনার নতুন যুগ’ শীর্ষক বিশেষ সংখ্যায় সন্নিবেশিত লেখাগুলোর ওপর ভিত্তি করে প্রথম আলোর ধারাবাহিক আয়োজন। আজকের মূল লেখাটি লিখেছেন সুসান হর্নিক। সারাংশ, ভাষান্তর ও প্রাসঙ্গিক তথ্য-ব্যাখ্যা যুক্ত করেছেন ইশতিয়াক মান্নান। আগামী সপ্তাহের লেখা ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: সংবাদের জগতে।’

আপনাদের কি ‘জুরাসিক পার্ক’ সিনেমায় বৃষ্টির মধ্যে ডাইনোসরের তেড়ে এসে গাড়ি উল্টে ফেলার ভয়ংকর দৃশ্যটা মনে আছে? কিংবা ‘কিউরিয়াস কেস অব বেঞ্জামিন বাটন’–এর সেই দৃশ্য, যেখানে দেখা যাচ্ছিল যে ব্র্যাড পিটের বয়স কমে যাচ্ছে? এসবই কিন্তু এআইয়ের কাজ।

ভিজ্যুয়াল ইফেক্ট, সম্পাদনা, পোস্টপ্রোডাকশন—এসব কাজে বেশ কয়েক দশক ধরেই হলিউডে এআই ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আসলে শুধু এআই নয়, সিনেমায় বা টেলিভিশনের জন্য কনটেন্ট তৈরিতে এআইয়ের সঙ্গে অনেক প্রযুক্তির একধরনের চমৎকার সমন্বিত ব্যবহার করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই, দর্শক–শ্রোতাদের হৃদয়ে গেঁথে যাওয়ার, চমৎকৃত, বিনোদিত ও আনন্দিত হওয়ার মতো অভিজ্ঞতা সৃষ্টি করা। হোক ঘরের টেলিভিশন কিংবা সিনেমা হলের বড় পর্দায়, এসব অভিজ্ঞতা নিঃসন্দেহে আমাদের আগে কখনো হয়নি।

সম্প্রতি আমরা দেখছি সিনেমায় কম্পিউটারের তৈরি করা ছবির ব্যবহার (সিজিআই প্রযুক্তি)। ২০১৬ সালে তৈরি করা স্টার ওয়ার্সের সিনেমা ‘রোগ ওয়ান’–এ ১৯৯৪ সালে প্রয়াত পিটার কুশিংকে দেখা গেছে।

এআই–ভিত্তিক প্রযুক্তির মাধ্যমে ২০২৩ সালে ‘ইন্ডিয়ানা জোনস অ্যান্ড দ্য ডায়াল অব ডেসটিনি’ ছবির শুরুতে তরুণ হ্যারিসন ফোর্ডের ছবিকে তাঁর অশীতিপর শরীরের ওপর প্রতিস্থাপন করে দেখানো হয়েছে।

যে সাইমন কাওয়েলকে ‘আমেরিকা গট ট্যালেন্ট’–এর (এজিটি) বিচারকের আসনে একজন ভীতিকর, প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে ও ঠোঁটকাটা মানুষ বলে সবাই জানে, এআই যখন তাঁকে দিয়ে এজিটির একজন প্রতিযোগী হিসেবে মঞ্চে গান গাওয়ায়, তখন সেটা নির্মল ও অভিনব বিনোদন তো বটেই।

এআই আমাদের নিত্যনতুন বিনোদিত ও চমৎকৃত করছে ঠিকই, কিন্তু পর্দার পেছনে কাজ করা মানুষদের জীবনে যা ঘটছে তা কিন্তু বিনোদন নয়; বরং জীবন ও জীবিকার সংকটের বাস্তবতা।

২০২৩ সালে গল্প-স্ক্রিপ্ট লেখক, অভিনেতা, সিনেমাটোগ্রাফাররা একজোট হয়ে হলিউডের ইতিহাসে দ্বিতীয় দীর্ঘতম ১৪৬ দিনের ধর্মঘটে গিয়েছিলেন। তাঁদের দর-কষাকষির মধ্যে একটা প্রধান বিষয় ছিল—এআইয়ের ব্যবহার এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত সৃষ্টিশীল কাজ ও মেধার মূল্যায়নের বিষয়। আশার কথা, ধর্মঘট শেষ হয়েছে পর্দার পেছনে কাজ করা মানুষদের স্বার্থ রক্ষা করেই। যুক্তরাষ্ট্রের রাইটার্স গিল্ড, হলিউড কর্মকর্তাদের সঙ্গে দর-কষাকষিতে শেষ পর্যন্ত এআই–বিষয়ক বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হয়েছেন।

এই ধর্মঘটের পেছনে সংশ্লিষ্ট সবার মধ্যে যে ধারণা বা ভয় কাজ করেছে, তা হলো—অচিরেই একটা পুরো চলচ্চিত্র বা টেলিভিশন ধারাবাহিকই তৈরি হবে এআই দিয়ে, যেখানে মানুষের ভূমিকা প্রায় থাকবে না বললেই চলে। যাঁদের মধ্যে ভয়টা সবচেয়ে বেশি কাজ করেছে, তাঁরা হচ্ছেন লেখক সম্প্রদায়, যদিও চুক্তির পর তাঁদের অনেকেই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছেন।

অন্য সব কাজের ক্ষেত্রের মতোই রুপালি পর্দার জগতেও এআইয়ের প্রবেশ ও প্রভাব এবং সম্ভাব্য প্রতিপত্তি নিয়ে দুই ধরনের প্রতিক্রিয়া আছে। যাঁরা সৃজনশীলতার সনাতনী ধারার পক্ষে, তাঁরা বিরক্ত ও আতঙ্কিত হয়ে বলছেন, এই প্রযুক্তি যেন আমাদের গল্প বলার সহজাত পদ্ধতিটাকে নষ্ট করে না দেয়, সে জন্য সব সময় সতর্ক ব্যবস্থা রাখতে হবে। তাঁদের কথা হচ্ছে, যতই সিজিআই দিয়ে বাস্তবের মতো করে কাউকে পর্দায় দেখানো হোক না কেন, আসলে তো সেটা প্রযুক্তির বানানো একটা মরীচিকা, তার ভেতরে তো কোনো আত্মা নেই। কেউ হতাশ হয়ে বলছেন, ‘আমাদের অলস করে দেওয়ার ফন্দি সব।’

যাঁরা প্রযুক্তির পরিবর্তনটাকে মেনে নিতে পারছেন, তাঁরা বলছেন যে দ্রুত সবাই কোনো না কোনোভাবে এআই ব্যবহার করতে শুরু করবে এবং এর উপকারটাও বুঝতে পারবে। এমি পুরস্কার জেতা একজন প্রযোজক বলছেন, ‘(ধর্মঘটের পর) কাজের চুক্তিগুলো করতে পেরে সবাই স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে ভাবছেন, এআইয়ের হাত থেকে বড় বাঁচা গেল।

কিন্তু তিন বছর পর চুক্তি নবায়নের সময় দেখা যাবে, সবকিছু নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। কারণ, সবাই তখন এআই ব্যবহার করেই কাজ করতে অভ্যস্ত হয়ে যাবে। আসল আলোচনা শুরু হবে তখন। আমাদের কাজের ক্ষেত্রে বেশ কিছু ওলট–পালট হতে যাচ্ছে, এটা হবেই, যন্ত্রণাদায়ক হলেও একে এড়ানোর কোনো উপায় নেই।’

এসব আশা-আশঙ্কার ডামাডোলে এআই কিন্তু থেমে নেই। যাঁরা প্রযুক্তি ও বিনোদনের মেলবন্ধনের কাজে যুক্ত আছেন এবং যাঁরা এআই প্রযুক্তিকে আগেভাগেই ব্যবহার করতে শুরু করেছেন, তাঁরা বলছেন যে নব্বইয়ের দশকে ইন্টারনেটের ব্যবহারের মতোই অচিরেই হলিউডের ৯০ শতাংশ কাজ হবে এআই–ভিত্তিক।

‘মেটাফিজিক’–এর মতো এআই সফটওয়্যার কোম্পানি মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে এমন স্টুডিও তৈরি করেছে, যেখানে ‘ডিপফেক’ তৈরি করা হচ্ছে। ডিপফেক দিয়ে যে কারও চেহারা, যেকোনো বয়সের মতো করে তৈরি করা যাচ্ছে, সেটা যে কারও শরীরের ওপর বসিয়ে দেওয়া যাচ্ছে; এবং তা দিয়ে যেকোনো কাজ (অভিনয়) করানো যাচ্ছে।

আপনারা নিশ্চয় কয়েক মাস ধরে অভিনেত্রী স্কারলেট জোহানসনের সঙ্গে প্রথমে ‘লিসা এআই’ এবং পরে খোদ ‘ওপেন এআই’–এর সঙ্গে বিরোধের পাড়া গরম করা খবর পড়ছেন। এই অভিনেত্রীর ছবি ও কণ্ঠ ব্যবহার নিয়ে; তাঁর পূর্বানুমতি, নৈতিকতা, স্বত্ব, ক্ষমা চাওয়া, কনটেন্ট নামিয়ে নেওয়া, চিঠি চালাচালি—এসব মিলিয়ে প্রায় লঙ্কাকাণ্ড বেধেছে।

কিছু কোম্পানি সেলিব্রিটিদের সঙ্গেও কাজ করছে, যেন তাঁরা তাঁদের ডিজিটাল যমজদের কাজের মেধাস্বত্ব দাবি করতে পারেন। যদিও পর্দার পেছনে কাজ করা অভিনেতারা বলছেন, নামমাত্র মজুরিতে তাঁদের শরীর, নানা ভঙ্গি ও নড়াচড়াকে স্ক্যান করিয়ে নেওয়া হচ্ছে হরদম—পয়সাও নেই, স্বীকৃতিও নেই। অথচ এই স্ক্যান করা ছবিগুলো এবং তার ডিজিটাল তথ্য বছরের পর বছর নানা কাজে ব্যবহার করা হবে।

এআই যে শুধু ভার্চ্যুয়াল রিয়্যালিটি তৈরির কাজে ব্যবহৃত হবে তা নয়, মিডিয়া এজেন্সি ওয়ার্ল্ডওয়াইড এক্সআরের প্রধান নির্বাহী ট্রেভিস ক্লয়েড বলছেন, ‘কোনো ছবি বক্স অফিস মাতাবে কি ফ্লপ করবে, এআই এই রকম অনুমানগুলোও আমাদের করে দিতে পারে। এই প্রযুক্তির সুযোগ ও সম্ভাবনা যত বেশি ব্যবহার করা যায়, আমাদের সবার জন্য সেটা ততই ভালো।’

ক্লয়েডের কোম্পানি ‘ব্যাক টু ইডেন’ নামে একটা সাই-ফাই মুভি বানাচ্ছে। এই মুভিতে কিংবদন্তি অভিনেতা জেমস ডিনকে পুনর্জীবিত করা হয়েছে (জেমস ১৯৫৫ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন)। এআই দিয়ে তারা তৈরি করছে সত্যিকারের ঝড়ের দৃশ্য, অদ্ভুত সব প্রাণী, দম বন্ধ করা মহাকাশের দৃশ্য কিংবা বহু বছর আগের ঐতিহাসিক পরিবেশ। শুধু দেখার অভিজ্ঞতা নয়, যাঁরা নিজে উপস্থিত থেকে ‘ইমার্সিভ’ অভিজ্ঞতা নিতে চান, এমন ভক্তদের জন্য রক হাডসন বা বেটি ডেভিসের মতো প্রয়াত সেলিব্রিটিদের বাস করা বাড়িতে এআই দিয়ে অনন্য সব ভার্চ্যুয়াল বাস্তবতা তৈরি করেছে এই কোম্পানি।

‘ফিল্ম ইনডিপেনডেন্ট’ একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যারা ফিল্ম বানাতে প্রযোজক-পরিচালকদের নানাভাবে সাহায্য দিয়ে আসছে। তার প্রেসিডেন্ট জশ ওয়েলশ হলিউডের ধর্মঘট–পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বলছেন, ‘লেখক ও সৃজনশীল মানুষের জন্য এটা খুবই ভালো খবর যে চুক্তি করে সৃজনশীল লেখা, সাহিত্যকর্ম বা পুনর্লিখনের ক্ষেত্রে এআইয়ের ব্যবহার আপাতত বন্ধ করা গেছে। কিন্তু এআইয়ের ব্যবহারের উদ্দেশ্য ভালো গল্প বা ভালো মুভি তৈরি করা নয়, আমি মনে করি এর মূল উদ্দেশ্য লেখক, অভিনেতাসহ সংশ্লিষ্ট সব সৃজনশীল মানুষকে কীভাবে কম পয়সা দেওয়া যায়।’

জশ অন্য অনেকের মতোই বলছেন, ‘এআই চলে যাচ্ছে না, বরং হয়তো আরও চমৎকার কিছু নিয়ে আসবে, যা আমাদের কল্পনার অতীত। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, আমরা এতই গোড়ার দিকে আছি এবং সবকিছু এতই ঝড়ের গতিতে এগোচ্ছে যে কেউ এখনো জানি না কোথায় যাচ্ছি। এমনকি যাঁরা এআই তৈরি করছেন তাঁরা জানেন না।’

  • ইশতিয়াক মান্নান আন্তর্জাতিক সংস্থায় কর্মরত বিশেষজ্ঞ