ফ্রম প্রেসিডেন্ট টু পপার (রাষ্ট্রপতি থেকে নিঃস্ব) উভয়েই এবং সবাই একই বায়ুমানের অধীন। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে আমাদের প্রধান শহর ঢাকা বায়ুদুর্গত শহরে পরিণত হয় যার প্রভাব পড়ে সারা দেশে। এই দূষণের অন্যতম কারণ আইন না মানা। দেশের ভেতর এই আইন না মানা নাগরিকেরা যখন সীমানা পাড়ি দেন, তখন আবার নিয়ম–প্রটোকল সব মানতে বাধ্য থাকেন। বর্ডার প্রটোকল মেনে চলতে বাধ্য থাকেন সীমানার দুই প্রান্তের মানুষেরা এবং মেনে চলা নিশ্চিত করতে যৌথভাবে দায়িত্বে থাকেন সীমান্তবর্তী দুই দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিতকারী আইন প্রয়োগকারী কর্মীরা। বায়ু, পানির তা মেনে চলা বা সীমান্ত অতিক্রম ঠেকানোর কোনো প্রটোকল নেই। কিন্তু সময় এসেছে এদিকেও নজর দেওয়ার। কারণ, এক দেশের দূষিত বায়ু প্রবাহিত হয়ে দূষিত করছে অন্য দেশের বায়ু, পরিবেশ, প্রতিবেশ। পরিবেশবিজ্ঞানীদের গবেষণা বলছে, সীমান্তের বাইরে থেকে ক্ষতিকর বিভিন্ন বস্তুকণা বাতাসে ভেসে বাংলাদেশে উড়ে আসার কারণে ঢাকার বায়ু আরও বেশি দূষিত হয়ে পড়েছে।
বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত ‘রাজধানীর বায়ুদূষণের জন্য প্রায় ৩০ ভাগ দায়ী ভারত ও মিয়ানমারের মতো প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা এসব অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। ঢাকায় পরিবেশবিষয়ক একটি গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন বা এসডোর চালানো গবেষণায় এসব তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত তিন বছর ধরে এসব গবেষণা চালানো হয়।’
বাংলাদেশ, ভারত নেপাল আর পাকিস্থান একত্র হয়ে বায়ুদূষণ কমাতে যৌথ রোড ম্যাপ মেনে কাজ করতে সম্মত হয়েছে। কিন্তু নদীর পানিসংক্রান্ত বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশের যৌথ নদী কমিশনের অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়। যেমন শেষ বৈঠকটিই গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে এক দশক পর। এ অভিজ্ঞতা মাথায় রেখে এটা বোধ করি খুব বেশি প্রত্যাশা নয় যে বায়ুদূষণ কমাতে যৌথভাবে একটি লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্কের প্রয়োজন। মান্যতা প্রশ্নে রোড ম্যাপের তুলনায় আইনি কাঠামো বেশি বাধ্যবাধকতা আরোপ করবে। ট্রেইল স্মেল্টার কেস এ বিষয়ে পথ দেখাতে পারে।
এ অঞ্চলের শহরগুলোর মধ্যে দিল্লি অন্যতম দূষিত। দিল্লির আকাশ দেখাই যায় না নভেম্বর–ডিসেম্বরের বায়ুদূষণে। বছরের ওই সময় দিল্লি যেন পরিণত হয় ভয়ংকর এক গ্যাস চেম্বারে। সমুদ্রের অনুপস্থিতিতে স্থলঘেরা দিল্লি ও এর আশপাশের এলাকায় বায়ুপ্রবাহ গিয়ে ঠেকে প্রায় শূন্যের কোঠায়। নিয়ম করে প্রায় প্রতিবছরই বন্ধ করে দিতে হয় দিল্লির সব স্কুল। সতর্কতা জারি করা হয়, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া প্রবীণ ও শিশুরা যেন ঘরের বাইরে না যায়।
সরকারের টনকে নাড়া দিতে দিল্লির আইনজীবী রাজ কুমার কাপুর সুপ্রিম কোর্টের নজর দাবি করেন রাজধানীর দূষণ নিয়ন্ত্রণ করতে। তাতে সাড়া দিয়ে প্রধান বিচারপতি দীপক মিশ্রর বেঞ্চ বিষয়টি শুনে বলেন, দিল্লিতে আসলে আপৎকালীন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কাপুরের আবেদন ছিল, ‘কেন্দ্রীয় সরকার যেন দিল্লি, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তর প্রদেশ সরকারকে রাস্তার ধুলা নিয়ন্ত্রণ ও ফসলের গোড়া পোড়ানো বন্ধ করতে নির্দেশ দেয়। সেই সঙ্গে সৌরবিদ্যুৎ ও বিদ্যুচ্চালিত গাড়ির ব্যবহার বাড়ানোর নির্দেশনা দিক। আর্জিমাফিক কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলোকে নোটিশ জারি করেছে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট।’
সরকারের তরফ থেকে যেকোনো পর্যায়ের নীতিনির্ধারকই হোন না কেন, ‘মানুষ বাড়ছে তাই দূষণ বাড়ছে’ বলে দায় এড়ানোর আবহমান চেষ্টা আমরা দেখি। পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ বাড়ছে, কিন্তু ওদের পরিবেশ নষ্ট হয়নি। কারণ, সেসব দেশের নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করেন।
বায়ুদূষণ প্রশ্নে ঢাকা–দিল্লির দূরত্ব বেশি নয়। ‘বিশ্বে দূষিত বায়ুর শহরগুলোর মধ্যে দ্বিতীয় অবস্থানে ঢাকা। শীর্ষে রয়েছে ভারতের দিল্লি। ঢাকার পরই রয়েছে পাকিস্তানের করাচি ও চীনের বেইজিং। ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে বিশ্বে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভারত ও বাংলাদেশে। আর এই দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির ঝুঁকিতে আছে বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। পরিবেশের নির্মলতার নিরিখে বছর বছর তালিকা করে থাকে নানা বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান।
সরকারের তরফ থেকে যেকোনো পর্যায়ের নীতিনির্ধারকই হোন না কেন, ‘মানুষ বাড়ছে তাই দূষণ বাড়ছে’ বলে দায় এড়ানোর আবহমান চেষ্টা আমরা দেখি। পৃথিবীর সব দেশেই মানুষ বাড়ছে, কিন্তু ওদের পরিবেশ নষ্ট হয়নি। কারণ, সেসব দেশের নীতিনির্ধারকেরা যথাযথ পরিকল্পনা ও নীতি প্রণয়ন করেন।
বাংলাদেশে প্রথম বিধিবদ্ধ পরিবেশ সংরক্ষণ অধ্যাদেশ ১৯৭০ সালে প্রণীত হয় ‘পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭০’ নামে। যদিও পরিবেশসম্পর্কিত বাংলাদেশের প্রথম প্রবিধান ছিল ১৯৬৫ সালের কলকারখানাসংক্রান্ত অধ্যাদেশ। তবে দূষণ তখন এই সময়ের মতো বিপজ্জনক মাত্রায় ছিল না বলে এসব অধ্যাদেশে বায়ুদূষণ সমস্যা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তবে পরবর্তীকালে এসব অধ্যাদেশে সংশোধনী আনা হয় এবং পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৭৭ প্রণয়ন করা হয়। এই অধ্যাদেশে পরিষ্কারভাবেই গ্যাসীয়, তরল, কঠিন অথবা অন্যান্য পদার্থ দ্বারা সৃষ্ট বায়ু, ভূপৃষ্ঠস্থ ও ভূগর্ভস্থ পানি এবং মৃত্তিকা দূষণ রোধ সম্পর্কে সরকারি নীতিমালা ও দায় বর্ণিত হয়েছে। যদিও আইন বিভাগে ইপিসি-১৯৭৭ পাস করা হয়, কিন্তু কখনো এই আইনের যথাযথ প্রয়োগে শাসন বিভাগকে কঠোর হতে দেখা যায়নি। তবে একাধিক দেশের সমন্বয়ে করা যৌথ প্রটোকল মানতে শৈথিল্য হয়তো কম দেখাবে।
প্রায় আট দশক আগে ট্রেইল স্মেল্টার কেস দিয়ে আন্তসীমান্ত পরিবেশগত ক্ষতিকে আন্তর্জাতিক আইনে বিচারের আওতায় নিয়ে আসার নিবন্ধিত প্রথম ঘটনা। এই মামলা আন্তসীমান্ত পরিবেশগত দূষণের ক্ষেত্রে প্রথম কোনো মামলা, যাতে ‘ট্রান্সবাউন্ডারি হার্ম’ বিষয়টিকে প্রতিষ্ঠা করা হয়, যখন আন্তর্জাতিক আইনের পরিসীমায় এমন কোনো নজির ছিলই না। সেই সঙ্গে ক্ষতির কারণের উদ্গাতাকেই ক্ষতিপূরণ দিতে হবে, যা এই মামলায় ‘পলিউটার পেইস’ নীতি নামে প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল আর পাকিস্তান একত্র হয়ে বায়ুদূষণ কমাতে ট্রেইল স্মেল্টার কেস বিবেচনায় রেখে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক তৈরি করলে যৌথ বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।
এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট