জাতিসংঘ অধিবেশন: অতীত আর ভবিষ্যতের মধ্যে আটকা পড়া সম্মেলন

জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস

আন্তর্জাতিক সহযোগিতা যখন সবচেয়ে বেশি দরকারি হয়ে ওঠে, সে সময়ই তার দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে ওঠে। ২০২০ সালে জাতিসংঘের ৭৫তম বার্ষিকীতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর ঘোষণা অনুযায়ী চলতি সপ্তাহে বিশ্বনেতারা নিউইয়র্কে জাতিসংঘের ‘সামিট অব দ্য ফিউচার’ বা ‘ভবিষ্যতের সম্মেলনে’ জড়ো হয়েছেন। এই সম্মেলনের এজেন্ডা তার শিরোনামের মতোই উচ্চাকাঙ্ক্ষাপ্রসূত। কারণ, এখানে শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়ন, নতুন প্রযুক্তি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুরক্ষার বিষয়ে ঐকমত্য গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে। 

সদস্যরাষ্ট্রগুলো একটি বিষয়ে একমত হয়েছে। সেটি হলো আজকের বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলার জন্য ১৯৪৫ সালে প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে হালনাগাদ করতে হবে। এর মাধ্যমে বহুপক্ষীয় ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী করতে হবে। সুদান, মধ্য আফ্রিকা, গাজা, ইউক্রেন এবং আরও ডজনখানেক সংঘাতপূর্ণ এলাকায় যুদ্ধ বন্ধ করতে; নিদেনপক্ষে এসব যুদ্ধকে স্তিমিত করতে জাতিসংঘ যে কতটা অক্ষম, সে বিষয়ে সদস্যদেশগুলো ভালো করেই জানে। 

করোনার ধ্বংসযজ্ঞ দেখার পরও পরবর্তী মহামারি মোকাবিলায় বিশ্বকে প্রস্তুত করতে ব্যর্থ হওয়ার বিষয়টি তারা স্বীকার করে। ঋণসংকট, তীব্রতর জলবায়ু সংকট এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও জিন–সম্পাদনার মতো নতুন প্রযুক্তির উত্থানকে সামাল দিতে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে তারা সবাই স্বীকার করেছে। কিন্তু কথা হলো, বিশ্বব্যবস্থা ঠিক করার প্রয়োজনীয়তার ব্যাপারে তারা একমত হলেও কীভাবে তা করা হবে, তা নিয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য নেই। 

এক বছরের বেশি সময় ধরে ‘ভবিষ্যতের চুক্তি’ (প্যাক্ট ফর দ্য ফিউচার) নিয়ে দেশগুলোর মধ্যে আলাপ–আলোচনা হয়েছে। কিন্তু সম্মেলনে রোববার সকালে দেখা গেল, রাশিয়া চূড়ান্ত নথি পাসের বিষয়ে আপত্তি জানিয়ে বসল। অবশ্য দেশটির আপত্তি শেষ পর্যন্ত খারিজ করা হয়। ওই দিনই আর্জেন্টিনা চুক্তিটিকে একটি ‘সর্বগ্রাসী এজেন্ডা’ বলে নিন্দা জানায়। তবে বাস্তবতা হলো, নথিটিতে আগেকার সর্বসম্মত বিষয়গুলোই আছে; শুধু ভাষাগত পরিবর্তন আনা হয়েছে। 

কিন্তু এত লম্বা লম্বা আলাপের মধ্যেও বৈশ্বিক রাজনীতিকে এমন একটি নতুন আদল দেওয়ার চেষ্টা আছে, যা বর্তমান ও ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে সক্ষম। দুটো বিশ্বযুদ্ধের অভিজ্ঞতা অর্জনের এবং পারমাণবিক সংঘাতের ঝুঁকির মুখোমুখি হওয়ার পর জাতিসংঘের স্থপতিরা একটি বহুপক্ষীয় ব্যবস্থা তৈরি করেছিলেন, যাতে কয়েকটি বৃহৎ শক্তি বিশ্বকে শান্তির দিকে নিয়ে যেতে এবং তাদের নিজস্ব স্বার্থকে এগিয়ে নিতে পারে। বাস্তবতা হলো, এই ধরনের বৈশ্বিক শাসন আজকের বিশ্বের জন্য মোটেও উপযুক্ত নয়। বিশেষ করে ৩০ বছরের নিচে যে চার শ কোটি যুবক ও তরুণ রয়েছে, তাদের জন্য তো নয়ই। তাদের জন্য নতুন ব্যবস্থা দাঁড় করাতে হবে। 

বহু মহাদেশে এখন সংঘাত চলমান রয়েছে। তারপরও যুদ্ধই এখন আর একমাত্র বৈশ্বিক এজেন্ডা নয়। মহামারি, জলবায়ু পরিবর্তন, দারিদ্র্য, ব্যাপক অভিবাসন এবং প্রযুক্তিগত বিপর্যয়—এর সবগুলো বিষয়ে কার্যকর এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক আন্তর্জাতিক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। চীনের উত্থান এখন সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। তবে এটি বৈশ্বিক এজেন্ডা গঠনের একমাত্র দেশ নয়। বার্বাডোজ পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য চাপ দিয়েছে। সংযুক্ত আরব আমিরাত আঞ্চলিক সম্পর্ক পুনর্বিন্যাস করার চেষ্টা করেছে। 

অবিশ্বাস্যভাবে ‘ভবিষ্যতের চুক্তি’ বিশ্বের ক্রমবর্ধমান বহুমেরুত্বকে স্বীকৃতি দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদের সংস্কারের মতো সবচেয়ে কঠিন সমস্যা সমাধানে ক্রমান্বয়ে অগ্রগতি আসছে। সদস্যরাষ্ট্রগুলো ‘উন্নয়নশীল দেশ এবং ছোট ও মাঝারি আকারের রাষ্ট্রগুলোকে’ সাধারণ পরিষদে অন্তর্ভুক্ত করতে নীতিগতভাবে রাজি হয়েছে। এই চুক্তি সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের ব্যবহৃত ভেটো ক্ষমতার ‘ব্যাপ্তি ও ব্যবহার’ সীমিত করার বিষয়ে আলোচনা চালানোর প্রস্তাব করেছে। 

 ‘ভবিষ্যতের চুক্তি’ স্থানীয় এবং আঞ্চলিক সরকার, বেসরকারি খাত, একাডেমিক ও বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়, ধর্মীয় গোষ্ঠী এবং আদিবাসী জনগণসহ ‘সমগ্র সমাজে’ অংশীদারত্বকে ‘জোরদার করার’ অঙ্গীকার করে। সর্বোপরি, সম্মেলনটি দীর্ঘমেয়াদি বৈশ্বিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা বলছে। অনেকে যে ধরনের অগ্রগতি আশা করেছিলেন, ‘ভবিষ্যতের চুক্তিকে’ সেই আশার বাস্তবায়ন হয়তো বলা যাবে না, এটি এমন একটি নতুন ব্যবস্থার রূপরেখা তৈরি করতে শুরু করেছে, যা পুরোনো ব্যবস্থার ত্রুটিগুলো সংশোধন করতে পারে। 

টমাস হেল অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের গ্লোবাল পাবলিক পলিসির অধ্যাপক ও 

অ্যান-মেরি স্লটার ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের নীতি পরিকল্পনার সাবেক পরিচালক

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনূদিত