সেদিন ছিল ১৩ নভেম্বর, তখনো বিশ্ব শিশু দিবসের (২০ নভেম্বর) অনেক বাকি। কমলাপুর রেলস্টেশনে সাতসকালে হাজির হয়েছি সুন্দরবন এক্সপ্রেস ধরব বলে। আমেনার (ছদ্মনাম) ফোন আসে। আমেনা নতুন এক দৈনিকে ‘চাইল্ড বিট’ (শিশুদের নিয়ে লেখা/খবর) দেখছেন।
বলেন, একটা বাইট (মন্তব্য/অভিমত) দেন বিশ্ব শিশু দিবস উপলক্ষে। যে বছর আমার জন্ম, সেই বছর থেকে আলাদা করে বিশ্ব শিশু দিবস পালন শুরু হয়। তাতে আমার কোনো বুজরুকি ছিল না। সেই হিসাবে গত উনসত্তর বছর সারা দুনিয়ায় ২০ নভেম্বর ‘শিশু দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
এখনো শিশুরা পথে পথে ঘোরে, রাস্তায় ঘুমায়, বড়রা ইচ্ছেমতো পেটায়, খাটায়, অবহেলা ও শোষণ করে। শিশুরা যেন মানুষ নয়। কোনো কিছুতেই শিশুদের পছন্দ–অপছন্দের তোয়াক্কা তাঁরা করে না। কিন্তু এ দুনিয়ায় এমন কোনো কাজ নেই, যা শিশুর জীবনকে প্রভাবিত করে না।
সেটা পদ্মা সেতুই হোক আর আমাদের গ্রামে ঢোকার এক বাঁশের লকলকে সেতুই হোক। এ বছরে শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘শিশুদের ক্ষমতায়ন’, সেদিকে আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনের নির্দিষ্ট কামরার সামনে পায়চারি করতে করতে আমেনাকে এভাবেই শিশু দিবসের ‘বাইট’ দিতে থাকি। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরী তার ছোট ভাইকে নিয়ে আমার বক্তৃতা শুনছিল।
ধরা যাক, কিশোরীর নাম হামিদা আর তার ছোট ভাই আট বছরের ছেলেটির নাম আতা বা আতাউর। আমি তার সঙ্গে দু–একটা কথা বলি। হামিদার হাতে সস্তা এক পলিথিন ব্যাগে বড়দের একটা পুরোনো সোয়েটার। আমার পিছে পিছে সে–ও তার ভাইকে নিয়ে উঠে পড়ে সুন্দরবন এক্সপ্রেসে। যেন বাপ চলেছে বেটা–বেটি নিয়ে। ঘড়ির কাঁটা ধরে ছুটে চলে সুন্দরবন। একদমে ভাঙ্গা গিয়ে থামবে। সকালে যে প্রতিদিনের মতো আজও তিন গ্লাস পানি পেটে চালান করা ঠিক হয়নি, তা ক্রমেই টের পেতে থাকি। আমি দাঁতে দাঁত চেপে ভাঙ্গা রেলস্টেশনের জন্য অপেক্ষা করি।
চলন্ত ট্রেনে আমি পারি না। অনেক কষ্টে হাজির হই টয়লেটের কাছে। আমার মতো অদূরদৃষ্টির মানুষের অভাব নেই। আমি তিনজনের পরে সুযোগ পেতে পারি। দেখি সেই কিশোরী তার ভাইকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে টয়লেট স্পেসের সামনে। ইশারা দিয়ে জানতে চাই, টয়লেটের তাড়া আছে কি না। কাছেই দাঁড়িয়ে থাকা টিটি সাহেব এগিয়ে আসেন। জানালেন, ‘ওরা রাজবাড়ী নেমে যাবে।’ বুঝলাম টিটি সাহেবের বদান্যতায় দুই ভাইবোন ঢাকা থেকে এই অনিশ্চয়তার মধ্যে দূরের এক জেলায় যাচ্ছে একটা পুরোনো সোয়েটার নিয়ে শূন্য হাতে।
হামিদা আর আতাউর যাচ্ছে তাদের বাবার সঙ্গে দেখা করতে, তাদের বাবা জেলহাজতে। আজকে কোর্টে তুলবে। সেখানেই দেখা হওয়ার ক্ষীণ আশা নিয়ে তাদের যাত্রা। গন্ডগোলে ‘গারমেন’ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাবা খানখানাপুরে দেশের বাড়িতে এসেছিলেন। কাছেই রাস্তার ধারে আহ্লাদিপুরের এক চায়ের দোকানে বসে গপসপ করার সময় তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। দেশ গেরামের জায়গাজমির মামলায় তাঁকে ধরা হয়েছে, তা কিছুই জানা নেই দুই শিশুর। জানাল, ‘মায়ে কইতে পারে। গারমেনের চাকরি, তাই মা আইতে পারেনি।’
হামিদা আর আতাউরকে দেখে মনে পড়ে মিসরের দুই বোন হামস আর হায়ার কথা। ২০১৯ সালের জুনে সারা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছিল তাদের এক অসহায় ছবি। মিসরের এক জেলখানার গ্রিল ধরে ছয় আর আট বছরের দুই অবুঝ শিশুর করুণ মুখ অসংখ্যবার শেয়ার হয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে।
মিসরের শেখ জায়েদ শহরের বাসিন্দা শিশু দুটি তাদের মায়ের অপেক্ষায় জেলখানার গেটে দাঁড়িয়ে। মিসরের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত একমাত্র প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসি আটক অবস্থায় মারা যাওয়ার পর শোক প্রকাশ করায় গ্রেপ্তার করা হয় শিশু দুটির মা আয়া আলাকে। এ জন্য তাঁকে ১৫ দিনের জেল দেয় মিসরের কর্তৃপক্ষ। মাকে ছাড়া অবুঝ দুটি শিশু থাকতে চায় না বাড়িতে। কিন্তু জেলখানায় গিয়ে মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুমতিও মিলছিল না।
গ্রেপ্তারের পর শিশু দুটির মা আয়া আলাকে ১২ দিন পর্যন্ত আদালতে হাজির করা হয়নি। গ্রেপ্তারের বিষয়টিও স্বীকার করেনি পুলিশ। পরে তাঁকে ১৫ দিনের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এ সময় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়, স্বামীর মুক্তির বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে যোগাযোগের ‘অপরাধে’। আলার স্বামী পেশায় সাংবাদিক। ২০১৫ সালের শুরুতে তাঁকেও গ্রেপ্তার করেছিল মিসরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাঁর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিসহ বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছিল। সে সময় স্বামীর মুক্তির জন্য আয়া আলা যে দৌড়ঝাঁপ করেছেন, সেটিকেই অপরাধ হিসেবে দেখেছে মিসরের সামরিক জান্তা।
শুধু যে রাজনৈতিক কারণে শিশুদের পিতামাতা আটক হন, তা নয়। তাঁরা অভিযুক্ত হয়ে আসামি হয়েও কারাগারে বা হাজতে বন্দী থাকতে পারেন। ‘সমাজ’ আটক মানুষদের সন্তানদের কী চোখে দেখে, তা কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করেছিলেন জহির রায়হান তাঁর জীবন থেকে নেয়া ছায়াছবিতে। শাশুড়ি মানতেই পারেননি যে চোর–ডাকাত ছাড়া অন্য কেউ জেলে থাকতে পারে। টঙ্গীর যে স্কুলে হামিদা পড়ে, সেখানে শিক্ষকেরা রটিয়ে দিয়েছেন, ‘হামিদা’ এক আসামির মেয়ে।
মানবাধিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক যৌথ কমিটি ৯ সেপ্টেম্বর ২০১৯ সালে খুব পরিষ্কার করে জানিয়েছিল, যেসব শিশুর মা–বাবাকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে, তাদের পারিবারিক জীবনের অধিকারকে সম্মান করার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করা উচিত। পারিবারিক জীবনের অধিকারকে সম্মান করার অর্থ রাষ্ট্র না বুঝলে কে বুঝবে?
হামিদা স্কুলে যেতে পারছে না, সেখানে সে প্রায় একঘরে। বাবার সোয়েটার পৌঁছাতে তাকে এই বৈরী পথ পেরোতে হচ্ছে নানা শঙ্কা নিয়ে। বাবাকে দেখতে পাবে কি না, সেটাও সে জানে না। ফেরার গাড়িতে আরেকজন মানবিক টিটি না–ও থাকতে পারেন। বাবা জেলে শুনলে তিনি হয়তো আরও গুটিয়ে যাবেন। খাবে কী সারা দিন?
হামিদার ভাগ্য ভালো তার বাবা জেলে। মা জেলে থাকলে তার কী হতো? তা ভাবতে গা শিউরে ওঠে। জর্জিয়ার এক কিশোরী জাতিসংঘের তথ্য সংগ্রহকারীদের বলেছিল, ‘আমি জানি, তোমরা মনে কর, আমার মা অন্যায় করেছেন এবং তার শাস্তি প্রাপ্য, কিন্তু আমরা আরও বড় শাস্তি পাচ্ছি যে।’
দিবস পালনে বাধা নেই, কিন্তু ভাবতে হবে সব শিশুকে নিয়ে। যেসব শিশুর মা–বাবা আটক আছেন, তাদের নিয়ে আমাদের আলাদা করে ভাবতে হবে। তাদের নিরাপত্তা, মা–বাবার সঙ্গে নিরাপদে দেখা করার সুবিধা নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। ভাবতে হবে আমাদের কোনো বৈরী আচরণে যেন তাদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে না যায়। তারা সমাজচ্যুত না হয়।
দায়মুক্তি প্রবচন: এ লেখাটি দেশের বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে লেখা নয়। কোনো মিল পাওয়া গেলে তা নিতান্তই কাকতালীয়। কর্তৃপক্ষের কোনো দায় নেই। সব দায় লেখকের।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক