গত ২৪ সেপ্টেম্বর সবিতা রানীর (প্রকৃত নাম নয়) খুদে বার্তা ছিল এটি। গত বছরের ২৫ সেপ্টেম্বর দুপুরে পঞ্চগড় জেলার বোদা উপজেলার করতোয়া নদীর আউলিয়া ঘাটে বোদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ায় যোগ দিতে পুণ্যার্থীসহ দেড় শতাধিক মানুষ একটি নৌকায় নদীর পার হচ্ছিল। কিন্তু ধারণক্ষমতার চেয়ে নৌকায় অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়ার কারণে স্মরণকালের ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। এখনো নিখোঁজ সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া এলাকার শান্তি রানীর স্বামী সরেন্দ্রনাথ রায়। ‘মানুষটা সেদিন দুপুরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে গেলেন। এক দিন, দুই দিন এভাবে বছর হয়ে গেল, এখনো মানুষটার সন্ধান পেলাম না।’
গত বছর নৌকাডুবির পরপর দেখা হয়েছিল তাঁদের অনেকের সঙ্গে। তখনো লাশের আশায় মানুষ নদীর পাড়ে বসা। একে একে ৭১টি লাশ মিললেও সবার লাশ মেলেনি। উদ্ধার হওয়া সবাই ছিলেন সনাতন ধর্মের। শুধু একজন ছিলেন মুসলিম। তিনি ছিলেন সেই নৌকার মাঝি। এমন ভয়াবহ দুর্ঘটনায় শোকে স্তব্ধ হয়ে পড়ে পুরো পঞ্চগড়।
ত্রাণ আসতে থাকে, লাশ চিহ্নিত করা, হস্তান্তর, শেষকৃত্যের ব্যবস্থা, তার ওপর পানির বোতল আর মোবাইল হাতে ‘হিউম্যান স্টোরি’ সুলুকসন্ধানী সংবাদকর্মী। শোকস্তব্ধ জনপদ হঠাৎ সরগরম হয়ে আবার ঠান্ডা হয়ে যায়। অন্য খবরের খোঁজে আমাদেরও ফিরে আসতে হয়। শরীর ফিরলেও মন ফেরে না অনেকের। প্রতিটি ক্ষতই ভিন্ন। প্রতিটি ক্ষতই একেকটি জোরালো ‘হিউম্যান স্টোরি’। তাড়া করে সারা বছর। লেখার টেবিলে, ভাতের থালায়। ফেসবুকের ফিরে আসা পর্দায়। মোবাইলে যোগাযোগ থেকে যায় কারও কারও সঙ্গে। সেই সুবাদেই সবিতা রানীর খুদে বার্তা আসে, ‘দাদা, তুমি ভুলেই গেছ...’। মানুষের ধারণা হয়েছিল আমরা আবার যাব, খোঁজখবর রাখবে ঢাকার লোকেরা। আর কিছু না হোক এত প্রাণহানির পর অন্তত লেখালেখির জোরে সেতুটা নিশ্চয় হবে। সেতু দিয়ে নিরাপদে বোদেশ্বরী মন্দিরে গিয়ে তাঁরা মহালয়ায় যোগ দেবেন।
বড়শশী ও কাজলদীঘি কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নকে উপজেলা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সেতু না থাকায় বড়শশী ও কালিয়াগঞ্জ ইউনিয়নের মানুষের উপজেলা শহরে যেতে নৌকাই ভরসা। সেতুটি নির্মিত হলে বোদা ও দেবীগঞ্জের মানুষের যাতায়াত অনেক সহজ হয়ে যাবে। নদীতে সেতুর অভাবে রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স, কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যসহ যানবাহনগুলোকে জেলা শহরের ওপর দিয়ে প্রায় ৫০ কিলোমিটার পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হয়।
নৌকাডুবিতে স্বজনহারাদের চোখের জল শুকানোর আগে ২ অক্টোবর ২০২২ সালে মৃত ব্যক্তিদের পরিবারকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অর্থসহায়তা প্রদানের এক অনুষ্ঠান হয়েছিল। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এলাকার সন্তান রেলমন্ত্রী। সেদিন তিনি তাঁর বক্তৃতায় করতোয়া নদীতে দেশের বৃহত্তম ‘ওয়াই’ ব্রিজ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। শোকাতুর মানুষকে ব্রিজের নকশা দেখিয়ে বলেছিলেন এলজিইডির তত্ত্বাবধানে ১১৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ৮৯১ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭.৩২ মিটার প্রস্থের ইংরেজি ওয়াই আকৃতির ব্রিজ নির্মাণ করা হবে। কিন্তু এখনো কোনো উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
সহযোগিতা আর সাহায্যের মধ্যে ফারাক বিস্তর
আমাদের দুর্যোগে সাড়াদানের প্রায় সবটাজুড়েই আছে ‘রিলিফ’ বা সাহায্য। অনেকটা কাফফারা দেওয়ার মতো। টাকা বা আর্থিক সহযোগিতা যে এ রকম দুর্যোগের একমাত্র পাথেয় নয়, সেটা আমাদের চিন্তাতেও আসে না। এ ধরনের হঠাৎ দুর্ঘটনায় একটা নির্দিষ্ট এলাকার নানা বয়সের মানুষ নিহত হলে যে সামাজিক ও পারিবারিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়; যে সামাজিক মূলধনের বিনাশ ঘটে; যে মনঃসামাজিক অভিঘাতের মধ্য দিয়ে বেঁচে যাওয়া অবশিষ্ট মানুষের দিন চলে, তা টাকা দিয়ে মাপা যায় না। কীভাবে বেঁচে আছেন সেই নববধূ, যিনি বিয়ের পর প্রথম মহালয়ায় মেলা করেছিলেন স্বামী হিমালয়ের সঙ্গে? সেদিনের নববধূ বন্যা রানী নিজে নৌকাডুবির পর নিজেকে বাঁচাতে পারলেও স্বামীকে হারিয়ে নির্বাক এখনো।
সাহায্য পেয়েছে ছাত্র উজ্জ্বল কুমার রায়। কিন্তু একদম একা হয়ে গেছে এক ভাইকে নিয়ে। মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের বটতলীর উজ্জ্বল মা-বাবাসহ পরিবারের ছয় সদস্যকে একসঙ্গে হারিয়ে এখন একেবারেই অনুজ্জ্বল এক প্রাণ। সেদিন নৌকাডুবিতে সে হারায় মা–বাবা, পিসি, মাসি, নানা ও নানার বেয়াইকে। নিজের লেখাপড়ার খরচ, সংসারের খরচ, কৃষিকাজ সবই দেখতে হয় তাকে। এখনো লেখাপড়া চালিয়ে যাচ্ছে সে। ভাইসহ সামনের দিনে কীভাবে এগোবে, সেই চিন্তা তাকে কুরে কুরে খায় দিনরাত। মা–বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে তার দিন কাটে।
দুই নাবালক সন্তান আর বিধবা শাশুড়িকে নিয়ে পথ খুঁজছেন ফুলমতি রানী। স্বামীকে হারিয়ে জীবনের খেই হারিয়ে ফেলেছেন যেন। গত এক বছরে কেউ খোঁজ নেয়নি বলে আক্ষেপ তাঁর। এই খোঁজ মানে টাকা নয়, তাঁদের কথা শোনা। সমস্যাগুলো জানা।
পঞ্জিকা অনুযায়ী এবার মহালয়া হবে ১৪ অক্টোবর। সনাতন ধর্মমতে মহালয়া হলো প্রয়াত ‘পূর্বপুরুষদের’ প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর শেষ দিন, পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষের সূচনা। পুরাণমতে প্রলয়কালে পৃথিবী যখন মহাসমুদ্রে পরিণত হয়, তখন ভগবান বিষ্ণু অনন্তনাগকে সেই সমুদ্রে শুইয়ে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হন। বোদেশ্বরী মন্দিরের মহালয়া উদ্যাপন কমিটির প্রচারবিষয়ক সম্পাদক হরিশ্চন্দ্র রায় সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘এ বছর আমরা কোনো ধরনের প্রচারে যাব না। ছাপানো হবে না কোনো পোস্টার। সীমিত থাকবে আয়োজন। যত দিন পর্যন্ত সেতু নির্মাণ না হবে, তত দিন পর্যন্ত সীমিত আকারে মহালয়া উদ্যাপন করা হবে।’
এটা শুধু অভিমানের কথা নয়, কথা আস্থার নিরাপত্তার; ভুলতে না পারা স্মৃতি আর প্রিয়জনদের আর্তনাদের প্রতিধ্বনি।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক