দফায় দফায় সহিংসতা বিস্ফোরণের মতো ছড়িয়ে পড়ার দিক থেকে ভারত অপরিচিত কোনো দেশ নয়। কিন্তু দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য মণিপুরের সাম্প্রতিক ভয়াবহতা গোটা দেশকে নাড়া দিয়েছে এবং পার্লামেন্টকে একেবারে চলনশক্তিহীন করে দিয়েছে। এর আর আশু সমাধানও দেখা যাচ্ছে না।
জমি, উপজাতীয় মর্যাদা, মাদক ব্যবসা ও অভিবাসন নিয়ে মেইতেই ও কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি ভয়ংকর দ্বন্দ্বের কারণে মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী ছোট রাজ্য মণিপুর গত মে মাসের গোড়া থেকে কেঁপে কেঁপে উঠেছে।
এই হানাহানি অপমান, আঘাত ও মৃত্যুর একটি ভয়ংকর পথ উন্মুক্ত করে গেছে। সেখানে নারীদের প্রকাশ্যে বস্ত্র হরণ করা হয়েছে, প্রতিদ্বন্দ্বী গোষ্ঠীগুলো তাদের সম্ভ্রম কেড়ে নিয়েছে এবং বিশেষ কিছু ভয়ংকর ক্ষেত্রে তাদের ধর্ষণ ও হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে। অগণিত জীবনকে মুছে দেওয়া হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের সম্পত্তির ধ্বংসাবশেষ তাদের নিরাপত্তাহীনতার ভয়াবহ অনুস্মারক হিসেবে রয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকার ও বিরোধী দলগুলো ভয়াবহতার অবসান ও শান্তি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে যে অগ্রগতি পেয়েছে, তা খুবই নগণ্য।
মণিপুরের এই সংঘাত একেবারে রাতারাতি শুরু হয়নি। বর্তমানে যে পরিস্থিতি সেখানে চলছে, তার পেছনে অনেকগুলো জটিল কারণ আছে। এর মধ্যে জনসংখ্যাগত ভারসাম্যহীনতার বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
মেইতেইদের বক্তব্য হলো, গোটা রাজ্যে যত লোক আছে, তার ৫৩ শতাংশই তাদের সম্প্রদায়ের; অথচ তারা রাজ্যের মাত্র ১০ শতাংশ জমির মালিক। অন্যদিকে কুকিরা মোট জনসংখ্যার মাত্র ১৬ শতাংশ হলেও তারা নাগা সম্প্রদায়ের (এই সম্প্রদায়ের লোকেরা রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ২৪ শতাংশ) লোকদের সঙ্গে এক হয়ে রাজ্যের ৯০ ভাগ জমি ভোগ করে থাকে। কুকিদের নিয়ন্ত্রণে যে ৯০ ভাগ জমি আছে, সেই জমির ৯০ শতাংশই অনুর্বর, পাথুরে ও পাহাড়ি। অন্যদিকে মেইতেইদের দখলে থাকা জমিগুলো উর্বর এবং সমৃদ্ধভাবে তা চাষাবাদ করা হয়।
কুকি আর নাগাদের বেশির ভাগই খ্রিষ্টান। তাঁরা ভারতের জটিল এনটাইটেলমেন্ট ব্যবস্থার আওতায় উপজাতির মর্যাদা ভোগ করে থাকেন; যার অর্থ হলো অ-উপজাতিরা তঁাদের জমি কিনতে পারে না, এমনকি সেখানে বসতিও গড়তে পারে না। অন্যদিকে মেইতেইরা প্রধানত হিন্দু (অবশ্য তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ খ্রিষ্টানও আছেন) এবং তাঁরা সে ধরনের কোনো সুবিধা ভোগ করতে পারেন না।
গত মার্চে মণিপুর হাইকোর্ট একটি রায়ের মাধ্যমে শুকনো কাঠখড়িতে জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠি ছুড়ে দিয়েছেন। আদালত রাজ্য সরকারকে তফসিলি উপজাতির মর্যাদা দেওয়ার বিষয়ে ১০ বছরের পুরোনো সুপারিশ অনুসরণের নির্দেশ দিয়েছেন এবং এর পাশাপাশি মেইতেইদের জন্য এ–সংক্রান্ত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা সংরক্ষণের আদেশ দেন। এটি কুকি–অধ্যুষিত এলাকায় প্রতিবাদ মিছিলের সূত্রপাত ঘটায় এবং এর পাল্টা জবাব হিসেবে মেইতেই গোষ্ঠীর দিক থেকে কিছু সহিংস হামলা আসে।
পরিস্থিতি ক্ষিপ্রতায় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। জুলাইয়ের শুরুতে দাঙ্গায় আনুমানিক ১২০ জন নিহত হন এবং ৭০ হাজার লোক বাস্তুচ্যুত হয়ে আশ্রয় শিবিরে ঠাঁই নেন।
কুকি গ্রুপগুলো এই সহিংসতাকে উসকানি দেওয়া ও স্থায়ী করার জন্য মেইতেইদের দুটি চরমপন্থী গ্রুপকে দোষারোপ করেছে। তাদের একটি হলো মেইতেই লিপান, অপরটি হলো আরামাবাই তেঙ্গল। দুটি গ্রুপের বিরুদ্ধেই আরও হামলার উসকানি হিসেবে কুকি এবং অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায় সম্পর্কে ঘৃণাসূচক বক্তব্য, গুজব ও ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
সমস্যার জট আরও পাকিয়ে গেছে। মিয়ানমার থেকে অভিবাসীদের যে স্রোত এসেছে, তাদের বেশির ভাগই বার্মিজ চিন সম্প্রদায়। এদের সঙ্গে স্থানীয় কুকিদের আত্মীয়তা আছে। তারা স্থানীয় জমিজমা ও সম্পদে ভাগ বসানোয় তা অ-কুকি সম্প্রদায়কে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলে দিয়েছে।
এদিকে, কুকিরা অভিযোগ করেছে, মেইতেই নেতৃত্বাধীন সরকার যে ‘মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছে, তার মাধ্যমে মূলত তাদের নিশানা করা হচ্ছে। তাদের দাবি, তাদের সম্প্রদায়কে ভিটেছাড়া করার অজুহাত হিসেবে রাজ্য সরকার এই মাদকবিরোধী অভিযান চালাচ্ছে। তবে সম্প্রতি একজন উচ্চপদস্থ মণিপুরি পুলিশ কর্মকর্তা পদত্যাগ করে বলেছেন, রাজ্যটির মেইতেই গোষ্ঠীভুক্ত বিজেপি দলীয় মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং ও তাঁর সরকার মাদক সম্রাটদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছেন এবং মাদক–সংক্রান্ত তদন্তে হস্তক্ষেপ করে মাদক কারবারিদের ছেড়ে দিচ্ছেন।
এই গোলকধাঁধার আরেক কারণ হলো মেইতেইদের আদি উপজাতীয় সানামাহি ধর্ম ও আদি আদিবাসী সংস্কৃতির পুনরুজ্জীবনবাদী আন্দোলন। অষ্টাদশ শতকে হিন্দু ব্রাহ্মণদের প্রভাবে তখনকার মণিপুরি রাজা পামহিবা ও তাঁর প্রজারা সানামাহি থেকে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। এর বাইরে মিশনারিদের প্রভাবে তাঁদের কেউ কেউ সাম্প্রতিক যুগে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।
সানামাহি আন্দোলন চায় মেইতেই সম্প্রদায় এই উভয় ‘নতুন’ ধর্মকে পরিত্যাগ করুক। এর কিছু সদস্য হিন্দু ও খ্রিষ্টান উভয় সম্প্রদায়ের সম্পত্তির ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত। সানামাহিদের কেউ কেউ তাঁদের ধর্মকে তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় জাহির করার ও বহিরাগত আধিপত্যকে প্রতিরোধ করার উপায় হিসেবে দেখে থাকেন।
কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী মণিপুরে সফর করেছেন। তবে সেখানে তিনি সরকার ও বিরোধী দলের বাধার মুখে পড়েছেন। আর নরেন্দ্র মোদি তো এ নিয়ে কোনো কথাই বলেননি। প্রতিদিনই সেখান থেকে সহিংসতা ও হত্যার নতুন খবর আসছে। মানবিক ট্র্যাজেডির বাইরে, মণিপুর সংকট মোদির সুশাসনের দাবিকেও সংশয়াচ্ছন্ন করছে। এ অবস্থায় এগিয়ে যাওয়ার একমাত্র উপায় হলো দ্বন্দ্ব মেটানোর কার্যকর পদক্ষেপ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
শশী থারুর ভারতের কংগ্রেস পার্টির এমপি ও দেশটির সাবেক পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী এবং জাতিসংঘের সাবেক সহকারী মহাসচিব