আনু মুহাম্মদের কলাম
‘বৈষম্যহীন’ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় যেসব পরিবর্তন প্রয়োজন
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের ওপর দাঁড়িয়ে। এর প্রভাবেই শ্রেণি, লিঙ্গ, জাতি, ধর্মীয় বৈষম্যবিরোধী কথাবার্তা দিয়ে সংবিধানের শুরু। কিন্তু শ্রেণিবিন্যাস, ক্ষমতা ও সম্পদ কেন্দ্রীভবনে শাসকশ্রেণির আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে গিয়ে এই সংবিধানই দিন দিন স্বৈরতন্ত্রী, সাম্প্রদায়িক ও বৈষম্যবাদী হয়ে উঠেছে। সংবিধানকে কীভাবে গণমুখী করা যায়, তা নিয়ে লিখেছেন আনু মুহাম্মদ
১৯৭১–এর মুক্তিযুদ্ধের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ছিল বৈষম্যহীন সর্বজনের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। কিন্তু ১৯৭২ থেকেই শুরু হয় সেই আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার ওপর আঘাত। এই কয়েক দশকে সামরিক ও বেসামরিক স্বৈরশাসনই ছিল প্রধান প্রবণতা। এত বছরে আমরা কখনোই স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পাইনি।
বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বদলে উল্টো বৈষম্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈষম্যবাদী রাজনীতি, অর্থনীতি, সংস্কৃতির দাপট বেড়েছে। ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র নাম করে এ যাত্রায় সবচেয়ে ভয়ংকর ছিল শেখ হাসিনা ও তাঁর দলবলের শাসন। ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান সেই ‘বৈষম্যহীন সর্বজনের বাংলাদেশ’ প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাকে আবার সামনে এনেছে। সে কারণে আমি মনে করি, ২৪–এর গণ–অভ্যুত্থান আসলে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে জনগণের লড়াই ও প্রত্যাশারই ধারাবাহিকতা।
এ পরিপ্রেক্ষিতে সংবিধানকে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যাত্রার সহযোগী করতে এর বেশ কিছু অনুচ্ছেদে/শব্দ/নীতি পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। সংক্ষেপে তার কয়েকটি দিক এখানে তুলে ধরছি।
১. সংবিধানের শুরু হবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি, মুক্তিযুদ্ধে জনগণের বিপুল অংশগ্রহণ ও লড়াইয়ের সংক্ষিপ্ত বিবরণ এবং এর মাধ্যমে অর্জিত রাষ্ট্রের প্রধান আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে। এর সঙ্গে ১৯৯০ ও ২০২৪–এর গণ–অভ্যুত্থানসহ গত ৫৩ বছরে স্বৈরশাসনবিরোধী লড়াইয়ের উল্লেখ থাকতে হবে।
২. সংবিধানে ইংরেজিতে বাংলাদেশের নাম যথার্থভাবেই ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’। এর বাংলা করা হয়েছে ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’। আমি মনে করি, রিপাবলিকের বাংলা ‘প্রজাতন্ত্র’ ঠিক হয়নি। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেই এই রিপাবলিক ধারণা। প্রজা বলতে এখানে নাগরিকদেরই বোঝানো হয়েছে, কিন্তু রূপক হোক আর যা–ই হোক, প্রজা শব্দের সঙ্গে প্রচলিত ধারণা রাজা সন্ধান করে।
আমাদের অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের রাজা/রানি/জমিদার হওয়ার সামন্তবাদী প্রবণতা প্রজা শব্দের পরিবর্তন আরও জরুরি করে তুলেছে। এই শব্দের ভালো বিকল্প আছে। আমি মনি করি, বাংলা যথার্থ নাম হতে পারে ‘জনতন্ত্রী’, ‘জনগণতন্ত্রী’ বা ‘সর্বজনতন্ত্রী’ বাংলাদেশ।
৩. মূলনীতি: ৮ (১) অনুচ্ছেদে বর্ণিত চার মূলনীতির বদলে আমরা এক মূলনীতিতে আসতে পারি। তা হতে পারে এ রকম, ‘জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ, ভাষা নির্বিশেষে সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করে সর্বজনের বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা।’
এভাবে লিখলে জাতীয়তাবাদের নামে একটি জাতির দাপট দেখা যাবে না, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র শব্দ ঝুলিয়ে রেখে ‘উল্টোযাত্রা’র প্রহসনও হবে না। সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও কাজ পরিষ্কার হবে। সব ক্ষেত্রে ধর্ম বিষয়ে রাষ্ট্রকে অবশ্যই পক্ষপাতহীন বা নিরপেক্ষ অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে, সংবিধান এবং আইন বিধিব্যবস্থার সব ক্ষেত্রে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবস্থার এটি প্রাথমিক শর্ত।
৪. নির্বাচন ও ক্ষমতার ভারসাম্য: সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক করার দিকে ক্রমে যেতে হবে। নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা বাড়াতে হবে। ‘না’ ভোট এবং নির্বাচিত সংসদ সদস্য প্রত্যাহারের বিধান যোগ করতে হবে।
৫. রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী: রাষ্ট্রপতির পদবি ও দায়িত্বের পরিবর্তন দরকার। রাষ্ট্রপতির বদলে বলা যেতে পারে রাষ্ট্রপ্রধান। সংসদ নির্বাচনের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনও হতে পারে প্রত্যক্ষ ভোটে; মানে প্রধানমন্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল নন এবং তাঁর ক্ষমতার আলাদা এখতিয়ার থাকবে।
প্রধানমন্ত্রী সংসদে বিজয়ী দলের নেতা হিসেবে নির্বাচিত হবেন। নির্বাচিত হওয়ার পর দলীয় প্রধানের পদ ছেড়ে দিতে হবে। ভারসাম্যের জন্য রাষ্ট্রপ্রধান নির্দলীয় হতে পারেন। রাষ্ট্রপ্রধান ও প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বকাল অবশ্যই দুই মেয়াদের বেশি নয়। সরকারের মেয়াদ হতে পারে চার বছর।
৬. নাগরিকদের পরিচয়: বাংলাদেশের নাগরিকদের পরিচয় হবে বাংলাদেশি। আর এই সীমানায় বসবাসরত বাঙালিসহ সব জাতি তার নিজ নিজ জাতিগত পরিচয়ে পরিচিত হবে, তার সাংবিধানিক স্বীকৃতি থাকতে হবে।
৭. বর্তমান সংবিধানে প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদে ১৪ এবং ১৫–তে জনগণের জন্য রাষ্ট্রের যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করা হয়েছে, তা প্রয়োজনীয় হালনাগাদ করে অব্যাহত রাখতে হবে।
৮. অনুচ্ছেদ ১৭–তে রাষ্ট্র: ‘(ক) একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষাদানের জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ এবং ১৮ (১) ‘জনগণের পুষ্টির স্তর-উন্নয়ন ও জনস্বাস্থ্যের উন্নতি সাধনকে রাষ্ট্র অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য বলিয়া গণ্য করিবেন।’ এগুলো বলবৎ রাখতে হবে। উপরন্তু দেশের সব নাগরিকের শিক্ষা ও চিকিৎসাকে সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে। এসব ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক তৎপরতার বদলে রাষ্ট্র মূল দায়িত্ব পালন করবে।
৯. অনুচ্ছেদ ১৮ক–তে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’ এর সঙ্গে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নকল্পে নদীকে ‘জীবন্ত সত্তা’ হিসেবে গ্রহণ এবং বন, খাল, উন্মুক্ত স্থান ও জলাভূমি সংরক্ষণ–সংক্রান্ত হাইকোর্টের রুল সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
১০. জাতির পিতা: এ–সম্পর্কিত ৪ক অনুচ্ছেদে বাতিলযোগ্য। ‘বাঙালি জাতির পিতা’ ধারণাটিই সমস্যাজনক। কারণ, বাঙালি জাতি শুধু বাংলাদেশে বাস করে না। আর বাংলাদেশে শুধু বাঙালি জাতি বাস করে না, অন্যান্য জাতিও আছে। তা ছাড়া বলাই বাহুল্য, বাঙালি জাতির বয়স আরও অনেক বেশি। তবে সংবিধানে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্মানজনক উল্লেখ থাকতে পারে।
১১. ৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতে হবে। তবে এই অনুচ্ছেদের বাতিল সংসদ সদস্য কেনাবেচার পথ যাতে না খুলে দেয়, তার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল করতে হবে।
১২. ‘মৌলিক অধিকারের সহিত অসমঞ্জস আইন বাতিল’: অনুচ্ছেদ ৭(১) ও (২)–এ বলা হয়েছে, ‘প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ’...‘অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।’ এই বক্তব্যের মর্মবস্তু রক্ষা করতে হবে।
২৮(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী–পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।’ ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা হইতে কোন ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাইবে না।’ রাষ্ট্রের এ অবস্থান নিশ্চিত করতে সংবিধানের ভেতরেই এর সঙ্গে অসমঞ্জস ধারা, উপধারা বাতিল করতে হবে।
শর্ত জুড়ে দিয়ে অধিকারের পথ কণ্টাকাকীর্ণ করা যাবে না। যেমন ৩৭, ৩৯ (১), ৩৯ (২), ৪১ (১) অনুচ্ছেদে সকল মৌলিক অধিকার শর্তসাপেক্ষ করা হয়েছে। যেমন ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে...’ ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রসমূহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, জনশৃঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে...’ বা ‘আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে...’ ইত্যাদি। কিন্তু এসব শর্ত পরীক্ষা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ার সরকারের হাতে থাকায় নাগরিকদের অধিকার কার্যত অকার্যকর হয়ে যায়।
১৩. সংবিধানের ২৩ক অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বিভিন্ন উপজাতি, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা, নৃ-গোষ্ঠী ও সম্প্রদায়ের অনন্য বৈশিষ্ট্যপূর্ণ আঞ্চলিক সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য সংরক্ষণ, উন্নয়ন ও বিকাশের ব্যবস্থা গ্রহণ করিবেন।’ উপজাতি ধরনের অপমানজনক শব্দ বাদ দিতে হবে এবং দেশের সব জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি নিশ্চিত করতে হবে। সব জাতির ভাষা, সংস্কৃতি, মালিকানার বিশেষ ধরনের স্বীকৃতি থাকতে হবে।
১৪. মালিকানা: ১৩ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘উৎপাদনযন্ত্র, উৎপাদনব্যবস্থা ও বণ্টনপ্রণালীসমূহের মালিক বা নিয়ন্ত্রক হইবেন জনগণ এবং এই উদ্দেশ্যে মালিকানা-ব্যবস্থা নিম্নরূপ হইবে: (ক) রাষ্ট্রীয় মালিকানা, (খ) সমবায়ী মালিকানা, (গ) ব্যক্তিগত মালিকানা...।’ এখানে যোগ করতে হবে ‘সর্বজনের মালিকানা’ বা ‘যৌথ মালিকানা’ এবং দেশে এর অস্তিত্ব নির্দিষ্ট করে তার সাংবিধানিক নিরাপত্তা দিতে হবে।
১৫. চুক্তি, প্রকল্প ও আয়–ব্যয়ে স্বচ্ছতা: সংবিধানের ৪৫ (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘...সকল চুক্তি ও দলিল রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রণীত বলিয়া প্রকাশ করা হইবে’ কিন্তু ‘...রাষ্ট্রপতি কিংবা অন্য কোন ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে দায়ী হইবেন না।’ এই অস্বচ্ছতা ও স্ববিরোধিতা গ্রহণযোগ্য নয়। সংবিধানে নিশ্চিত করতে হবে যে জনগণের জীবন ও সম্পদ নিয়ে স্বাক্ষরিত সব চুক্তি সংসদে এবং সর্বজনের মধ্যে আলোচিত হবে। জনসম্মতি নিশ্চিত করে দেশি–বিদেশি পক্ষের সঙ্গে চুক্তি ও বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। ‘রাষ্ট্রের স্বার্থ’ অজুহাত দেখিয়ে জনগণের কাছ থেকে আর্থিক লেনদেন/বরাদ্দ/ঋণ গোপন রাখা যাবে না। রাষ্ট্রের আয় ব্যয়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। সব উন্নয়ন প্রকল্পের আয়–ব্যয় প্রকাশ্য থাকতে হবে। আয়–ব্যয় পরীক্ষা–নিরীক্ষার জন্য স্বাধীন সাংবিধানিক কর্তৃপক্ষ থাকতে হবে।
আইন বা বিধিব্যবস্থায় অস্বচ্ছতা ও স্ববিরোধিতার পথ বর্জন করতে হবে। যেমন গত ২৮ নভেম্বর রাষ্ট্রপতির এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে যে দায়মুক্তি আইন দিয়ে হাসিনা সরকার যথেচ্ছাচার লুণ্ঠন ও সর্বনাশা সব চুক্তি করেছেন, তা অন্তর্বর্তী সরকার রহিত করেছে। কিন্তু অধ্যাদেশে সঙ্গে সঙ্গে এ–ও বলা হয়েছে যে এই ‘রহিতকরণ সত্ত্বেও (ক) উক্তরূপ রহিতকরণের অব্যবহিত পূর্বে উক্ত আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তি বা সম্পাদিত চুক্তির অধীন গৃহীত কোনো ব্যবস্থা বৈধভাবে সম্পাদিত বা গৃহীত হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে; (খ) উক্ত আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তির অধীন চলমান কোনো কার্যক্রম এমনভাবে অব্যাহত থাকিবে অথবা নিষ্পন্ন করিতে হইবে যেন উক্ত আইন রহিত হয় নাই...।’
তার মানে আগের সব চুক্তি বহাল থাকবে; এই আইনের অধীন সব প্রকল্প অব্যাহত থাকবে। এ ধরনের স্ববিরোধিতা বা প্রহসন পরিত্যাজ্য; কারণ, তা জনস্বার্থের পরিপন্থী।
১৬. রাজনৈতিক দল: এ দেশে জাতীয় ভিত্তিতে কর্মরত রাজনৈতিক দলের জন্য কিছু শর্ত সংবিধান নির্দেশ করে দিতে পারে। যেমন জাতীয় সংগঠনের বৈশিষ্ট্য রক্ষার জন্য এ রকম দলে দেশের সব ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ ও শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে। দলে নারী অংশগ্রহণ কমপক্ষে ৩০ শতাংশ হতে হবে। দলের কেন্দ্র থেকে প্রান্ত সব পর্যায়ে নির্বাচনের মাধ্যমে কমিটি গঠিত হতে হবে। উচ্চ পদে নেতাদের মেয়াদ ও অবসর গ্রহণের বয়স নির্দিষ্ট করতে হবে, যাতে নতুন নেতৃত্ব তৈরি হতে পারে।
১৭. ভাষার প্রশ্ন: স্বাধীনতার ৫৩ বছরে দেশের প্রায় সব নীতিমালা-পরিকল্পনা-সমীক্ষা দলিল বরাবর ইংরেজি ভাষায় লিখিত হয়েছে। এর ফলে দেশের অধিকাংশ মানুষ দেখেনও না, জানেনও না, বুঝতেও পারেন না তাঁদের জীবন ও সম্পদ নিয়ে কী নীতি হচ্ছে, কীভাবে কী সিদ্ধান্ত হচ্ছে। হয়তো এই ‘বিচ্ছেদ’ নিশ্চিত করতেই এ ব্যবস্থা। এই পরিস্থিতির পরিবর্তন অত্যাবশ্যক। তাই সংবিধানে এটা নিশ্চিত করতে হবে যে দেশের সব নীতিমালা ও পরিকল্পনা, দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ভাষা বাংলায় প্রণয়ন করতে হবে। দেশের অন্যান্য ভাষাতেও তার সারসংক্ষেপ প্রকাশ করতে হবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এখনই এ ধারায় পরিবর্তনের সূচনা করতে পারে। দেশের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেকগুলো কমিশন হয়েছে। তাদের তৈরি দলিল অনেক গুরুত্বপূর্ণ হবে আশা করি। এগুলো বাংলায় রচনা করে সব মানুষের কাছে সুলভ করতে হবে। দেশের সর্বস্তরের মানুষ জানবে তাদের নিয়ে কী কথাবার্তা হচ্ছে, আলোচনা তর্কবিতর্ক হবে। আর প্রয়োজনে ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষায় এগুলোর অনুবাদেরও ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিশেষে এটা মনে রাখা জরুরি যে সংবিধান নিজে নিজে ক্ষমতা তৈরি করে না, বরং আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, ক্ষমতা সংবিধানকে প্রয়োজনমতো ব্যবহার/অব্যবহার/অপব্যবহার/সুবিধামতো সংশোধনী সব করে। কাজেই মূল প্রশ্ন রাজনৈতিক ক্ষমতা কার হাতে। বর্তমান অন্তর্বর্তী সময়ে এসব বিষয়ে প্রশ্ন যত উঠবে, তত জনপন্থী পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত হবে।
আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক