মার্কিন নতুন ভিসা নীতি কি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়?

এবার বাংলাদেশিদের ভিসা প্রদানে নতুন নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশের ৫২ বছরের কূটনীতির ইতিহাসে নজিরবিহীন এক ঘটনা। শুধু নজিরবিহীন বললেই যথেষ্ট হবে না। কূটনৈতিক ব্যর্থতার উদাহরণ হয়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা প্রদানে নতুন নীতি। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিতে বলা হয়েছে, দেশে গণতন্ত্র, সুষ্ঠু নির্বাচন, মতপ্রকাশে স্বাধীনতায় বাধাদান এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন ও সহিংসতায় জড়ালে ভিসা দেওয়া হবে না।

জড়িত ব্যক্তি ছাড়াও তাঁদের স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানদের ভিসা দেওয়া হবে না বা ভিসা থাকলে তা বাতিল করা হবে। সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, বিরোধী রাজনৈতিক দল, বর্তমান ও সাবেক আমলা, বিচার বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা নতুন ভিসা নীতির আওতাভুক্ত থাকবেন।

আরও পড়ুন

কোনো সার্বভৌম দেশের জন্য অন্য কোনো দেশের এ ধরনের সিদ্ধান্ত বিব্রতকর।
কিছুদিন ধরেই দেশে ছিল নানা ধরনের গুজব ও গুঞ্জনে সয়লাব। রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ে নানা কথাবার্তা এখানে-সেখানে বলাবলি হচ্ছে। দেশে যেহেতু এখন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত, তাই এসব গুঞ্জন গ্রহণযোগ্য না হলেও একধরনের জনপ্রিয়তা থাকে। গুঞ্জনের অংশ হিসেবেই বেশ কিছুদিন ধরেই শোনা যাচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র আবারও নতুন করে নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে।

মূলত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণেই এসব গুঞ্জন জায়গা করে নেয় জনসমাজে। এর আগেও ২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে একদফা নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। ওই নিষেধাজ্ঞার পর বিনা বিচার হত্যা ও গুমের ঘটনা কমলেও বিরোধী মতের ওপর হামলা ও মামলা অব্যাহত ছিল। ফলে অনেকের মধ্যেই শঙ্কা ছিল, নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।

তবে এবার যা হয়েছে, তা নিষেধাজ্ঞার থেকেও ভয়াবহ। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতিগত অবস্থান খুবই পরিষ্কার ও শক্তিশালী। বাংলাদেশের জন্য এই নতুন ভিসা নীতি নিষেধাজ্ঞা জারি থেকেও কঠোর সিদ্ধান্ত। এ মাসের ৩ তারিখেই যুক্তরাষ্ট্র তাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে। যুক্তরাষ্ট্র চিঠি দেওয়ার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রেই অবস্থান করছিলেন।

এ ছাড়া ওই দিনই পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন মার্কিন আন্ডারসেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। ২৯ এপ্রিল থেকে ৪ মে পর্যন্ত শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রে সফরে ছিলেন।

আরও পড়ুন

আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রীর সফরকে সফল বলে দাবি করা হয়েছে ঠিকই কিন্তু এই সফরে কার্যত কোনো কূটনৈতিক সাফল্য আসেনি। এরপর লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত তাঁকে আর ক্ষমতায় রাখতে চাইছে না।

এ অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগেও করেছেন। তিনি বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র বিভিন্ন দেশে ক্ষমতার পালাবদলে ভূমিকা রাখে। তিনি আরও বলেছেন, ‘যারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, তাদের কাছ আমরা কিছু কিনব না।’ ৩ মের ওই চিঠির আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রীর নানা ধরনের কথাবার্তা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আওয়ামী লীগের দূরত্বের বহিঃপ্রকাশ। ফলে এ সফরকে কোনোভাবেই সফল বলার সুযোগ আপাতত নেই।

প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বশীল ব্যক্তির কথাবার্তা ও যুক্তরাষ্ট্রে নানা প্রতিক্রিয়ায় বোঝাই যাচ্ছে, কূটনৈতিক টানাপোড়েন ভালোভাবেই চলছে। এটা বোঝার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য আমলে নিলেই হবে। প্রধানমন্ত্রী সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ক্ষমতার পালাবদলে হস্তক্ষেপের অভিযোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কিছুদিন ধরেই গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ দিচ্ছে।

এই চাপকে আওয়ামী লীগ ও সরকার দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে পারেনি। আওয়ামী লীগ ও এর নীতিনির্ধারক বুঝতে পারেননি ২০০৮ সালের বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতি এবং ২০২৩ সালের পরিস্থিতি এক নয়। এ সময়ের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতির অগ্রাধিকারে নতুন নতুন ধারণা যুক্ত হয়েছে। সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধের পরিবর্তে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা—এ বিষয়গুলোর ওপর যুক্তরাষ্ট্র বেশি গুরুত্বারোপ করছে।

আরও পড়ুন

তাই আগের রাজনীতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে এখন মোকাবিলা করা কঠিন। আগের মতো এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখাও সম্ভব না ভূরাজনীতির নতুন বিন্যাসের কারণে। বাণিজ্যিক সুবিধার পরিবর্তে কূটনীতির মূল আলোচ্য বিষয় হচ্ছে, আঞ্চলিক রাজনীতিতে নিজ নিজ প্রভাব বিস্তার করা। যুক্তরাষ্ট্র তার নতুন প্রভাববলয় তৈরি করতে চাইছে। এখন সাগরে খনিজ অনুসন্ধানের নামে বাণিজ্যিক সুবিধা, গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, ট্রানজিট, পদ্মা সেতু নির্মাণের কাজ, সাবমেরিন রিফুয়েলিং স্টেশনের কাজ দিয়ে সব পক্ষকে হাতে রাখা মুশকিল হবে।

এ বিষয়গুলো নিয়ে পররাষ্ট্রবিষয়ক পরামর্শকেরা সরকারকে বা আওয়ামী লীগকে সুপরামর্শ দিতে পারছে বলে মনে হয় না। বরং উসকে দিয়ে পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।

ভিসার প্রদানে বিধি-নিষেধ ও পরিবারের সদস্যদের ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত সাধারণ নিষেধাজ্ঞার থেকেও কঠিন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে সরকারের জন্য। নিষেধাজ্ঞা সাধারণ কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আরোপ করা হয়। এতে নিষেধাজ্ঞা পাওয়া ব্যক্তিদের বাইরে অন্যরা সুবিধা নিতে পারেন। অনির্দিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার প্রভাব গভীর হতে বাধ্য।

পুলিশ হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রাখে। এরপর যখন যাকে সামনে পায়, তাকেই ধরে নিয়ে যায়। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফলে কখন কাকে নিষেধাজ্ঞা দেবে, তা আগেভাগেই ঠাহর করা মুশকিলেরই বিষয় হবে।

নতুন নীতির কারণে আওয়ামী লীগের নিজস্ব লোকজনসহ বিচার বিভাগের লোকজন, আমলা, পুলিশ, র‌্যাব সদস্যরা আগের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনে যুক্ত হতে চাইবে না। যেমন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আবদুস সোবহান গোলাপই নির্বাচনে বাধাদান বা অগণতান্ত্রিক কোনো ঘটনা থেকে দূরে থাকতে চাইবেন।

কারণ, যুক্তরাষ্ট্রে তাঁর সম্পদ ও আত্মীয়স্বজন আছেন। তিনি চাইবেন না নতুন বিপদ সৃষ্টি করে সম্পদ হাতছাড়া করতে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের অনেক লোক ও সরকারি কর্মকর্তাদের সম্পদ যুক্তরাষ্ট্রে রয়েছে, অনেকের সন্তান পড়াশোনাসহ বিভিন্ন কাজে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন।

তাঁদের সবাই ২০১৮ সালের মতো নির্বাচনে কাজ করতে দ্বিতীয়বার চিন্তা করবেন। এতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে নিজেদের লোকজন ছাড়াও সরকারের বিভিন্ন কর্মকর্তার দূরত্ব তৈরি হবে। অনেকেই সরকারের নির্দেশ মানতে অনীহা প্রকাশ করতে পারে।

কারণ কেউ জানে কে কখন কোনো কারণে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার জালে আটকে যাবে। এটা হবে অনেকটা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বা পুলিশের অজ্ঞাতনামা হাজার হাজার আসামির বিরুদ্ধে মামলার মতো। যেমন অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা বলে কখন কার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কে মামলা করবে, বোঝা মুশকিল।

পুলিশ হাজার হাজার অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে রাখে। এরপর যখন যাকে সামনে পায়, তাকেই ধরে নিয়ে যায়। তেমনি যুক্তরাষ্ট্র অজ্ঞাতনামা ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা প্রদানের হুমকি দিয়ে রেখেছে। ফলে কখন কাকে নিষেধাজ্ঞা দেবে, তা আগেভাগেই ঠাহর করা মুশকিলেরই বিষয় হবে।

এতে সরকারনিয়ন্ত্রিত প্রশাসনে অনাস্থা ও ভীতি তৈরি হতে পারে। কারণ, আগেই বলেছি, আমাদের রাজনীতিবিদসহ অনেকেরই নামে-বেনামে যুক্তরাষ্ট্রে সম্পদ আছে। পরিবার-পরিজন আছে। তাই অযথাই অনেকে ঝুঁকি নিতে চাইবে না। বিভিন্নভাবে পাচার করা সম্পদের মায়া পরিত্যাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভব না-ও হতে পারে।

  • ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক