দেশের কয়েকজন অর্থনীতিবিদ বেশ কিছুদিন ধরেই ডলারের মূল্য নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে কথা বলছেন। তাঁদের মত হলো, ডলারের দাম নির্ধারণ বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে কিছুদিন ডলারের দাম বেড়ে একটা স্থিতিশীল পর্যায়ে এসে একক দামে ডলার বিক্রি হবে। এরপর হুন্ডিওয়ালারা ডলারের যে বেশি দাম দিচ্ছে, সে সমস্যা নাকি আর থাকবে না। আমি তাঁদের এই অবস্থান ও মতের বিরোধিতা করছি।
হুন্ডিপ্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারের চাহিদাকাঠামো সম্পর্কে যথেষ্ট গুরুত্ব না দেওয়ার কারণে তাঁরা এভাবে সমস্যার সহজ সমাধান দিচ্ছেন। আমি মনে করি, পুঁজি পাচারের জন্য ডলারের চাহিদাকারীদের দমন না করে শুধু ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে ডলারের দাম বাজারে যতই বাড়বে, তার চেয়ে পাঁচ-ছয় টাকা বেশি দাম দিয়ে হুন্ডিওয়ালারা প্রবাসীদের কাছ থেকে বিদেশে ডলার কিনে নেবেন।
কারণ, পুঁজি পাচারকারীদের কাছে তাঁদের অর্থ বিদেশে পাচার করাই মুখ্য উদ্দেশ্য। অতএব বাজারে ডলারের দামের চেয়ে হুন্ডিতে দাম কত বেশি, সেটা তাদের বিবেচ্য নয়। আইনি ঝামেলা ছাড়া নিরাপদে যেহেতু পাচারকারীরা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে অর্থ পাচার করতে পারে, তাই হুন্ডিওয়ালার কাছ থেকে তারা বেশি দামে ডলার কিনতে মোটেও অনাগ্রহী হবে না। এর মানে বাজারে ডলারের দাম বাড়তে থাকলেও হুন্ডি ব্যবস্থায় পুঁজি পাচার অব্যাহত থাকবে, বাজারে ডলারের একক দাম নির্ধারিত হবে না।
বাংলাদেশের ১ কোটি ৫৫ লাখ অভিবাসী বিভিন্ন দেশে বসবাস করছেন ও কর্মরত রয়েছেন। তাঁরা ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডিপদ্ধতিতে দেশে আসছে। আমার মতে, সিংহভাগ রেমিট্যান্স প্রেরক হুন্ডিপদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অতএব ২১-২২ বিলিয়ন ডলার যদি বৈধভাবে দেশে আসে, কমপক্ষে আরও ২১-২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স হুন্ডিপদ্ধতিতে আসছে। তার মানে প্রবাসী ও তাঁদের পরিবারের মধ্যে মধ্যে হুন্ডিপদ্ধতি বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ফলে শুধু দেশপ্রেমের ধুয়া তুলে তাঁদের এই ক্রমবর্ধমান আগ্রহকে সহজে দমন করা যাবে না।
বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য সরকার আগে ২ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা দিত, সম্প্রতি তা ৫ শতাংশে উন্নীত করেছে। এরপরও আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর ব্যাপারে প্রবাসীদের যথেষ্ট উৎসাহিত করা যাবে কি না, তা দেখার বিষয়। কারণ, হুন্ডি ব্যবসায়ীরাও বেশি দামে ডলার কিনে হুন্ডির আকর্ষণ ধরে রাখার চেষ্টা করবেন।
গত আগস্ট মাসে আগের বছরের একই মাসের চেয়ে ২১ শতাংশ কম রেমিট্যান্স এসেছে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে। সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৩৪ দশমিক ৩৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স এসেছে, যা ৪১ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। অথচ দুই বছর ধরে প্রতি মাসে লক্ষাধিক বাংলাদেশি অভিবাসী বিদেশে যাচ্ছেন বলে জানাচ্ছে জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো।
অবশ্য অক্টোবর মাসে ১৯৭ দশমিক ৭৫ কোটি ডলার রেমিট্যান্স ফরমাল চ্যানেলে দেশে এসেছে বলে পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে। এর আগের তিন মাসের চেয়ে অক্টোবরে বেশি রেমিট্যান্স আসায় এ ব্যাপারে কিছুটা স্বস্তি মিলেছে। তবু আমার দৃঢ় অভিমত হলো, হুন্ডিব্যবস্থার চাহিদাকাঠামোতে অবস্থানকারী পুঁজি পাচারকারীদের প্রতি অবিলম্বে সরকারের কঠোর দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ অপরিহার্য হয়ে পড়েছে।
বহুদিন ধরেই আমি বলে চলেছি, হুন্ডিব্যবস্থাকে কঠোরভাবে দমন না করলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স-প্রবাহকে বাড়ানো যাবে না। কারণ, হুন্ডিব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের অচিরেই এই সত্যটা মেনে নেওয়া উচিত। এর মানে দেশে পরিবারের কাছে রেমিট্যান্স প্রেরণে ইচ্ছুক প্রবাসীরা তাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রাগুলো (প্রধানত ডলার) বিদেশের হুন্ডি ব্যবসায়ীদের এজেন্টের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এর প্রধান কারণ, ডলারপ্রতি তাঁরা বাংলাদেশ ব্যাংক-নিয়ন্ত্রিত বাজারের ডলারের দামের চেয়ে ৫-৭ টাকা বেশি দাম পাচ্ছেন। ফলে তাঁদের পরিবারের সদস্যরা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের এ দেশীয় এজেন্টের মাধ্যমে ওই বর্ধিত দামে প্রেরিত রেমিট্যান্সের সমপরিমাণ টাকা অতি দ্রুত পেয়ে যাচ্ছেন কোনো ঝুটঝামেলা ছাড়াই।
হুন্ডিপদ্ধতিতে কোনো কাগজপত্র স্বাক্ষর করার প্রয়োজন হয় না। হুন্ডির স্থানীয় এজেন্ট প্রায়ই রেমিট্যান্স প্রেরক ও গ্রহীতাদের পূর্বপরিচিত থাকার কারণে এসব লেনদেনে ঠকে যাওয়ার আশঙ্কাও তেমন থাকে না। টেলিফোনে খবর পেয়ে যথাস্থানে গিয়ে বা নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা পেয়েই রেমিট্যান্স-গ্রহীতারা যথাসম্ভব দ্রুত তা নিকটবর্তী ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে আমানত হিসেবে জমা করে দেন। আগের দিনের মতো কেউ ছিনিয়ে নেবে, সেই আশঙ্কাও থাকে না। যেহেতু বিশ্বস্ততাই হুন্ডি ব্যবসার সাফল্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তাই সাধারণত রেমিট্যান্সের টাকা মার যায় না, লেনদেনের গোপনীয়তাও রক্ষা করা হয় সযতনে।
আমার মতে, হুন্ডিপদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে যোগ হওয়া রেমিট্যান্স ও অন্যান্য ব্যবস্থায় দেশে নিয়ে আসা বিদেশে উপার্জিত আয় ২৫-৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাচ্ছে প্রতিবছর। এখন দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারের বার্ষিক পরিমাণ প্রায় ১৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গেছে বলে ধারণা করা হয়।
পুঁজি পাচারের বহুল প্রচলিত পদ্ধতি আমদানির ওভার-ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার পাশাপাশি এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহুল ব্যবহৃত হুন্ডিপদ্ধতিতে রেমিট্যান্স প্রেরণের অভ্যাস বাংলাদেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের একটি সহজ বিকল্প উপহার দিয়েছে। বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে যে এখন আগের তিনটি প্রধান পদ্ধতিকে ছাড়িয়ে গেছে হুন্ডিপ্রক্রিয়ায় পুঁজি পাচার।
যে ‘হুন্ডি ডলার’ বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলোর চাহিদা জোগাচ্ছে প্রধানত দেশের দুর্নীতিবাজেরা ও কালোটাকার মালিকেরা এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘কালচার’ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা। টরন্টোর বেগমপাড়া কিংবা মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোমগুলো গড়ে তুলতে ‘হুন্ডি ডলার’ বড় ভূমিকা রাখছে। পুরোনো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি হুন্ডি ব্যবসা পুঁজি পাচারকে বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত করেছে। এই ক্রমবর্ধমান পুঁজি পাচারের কারণেই দেশের বৈদেশিক মুদ্রার নিট রিজার্ভ বিপজ্জনকভাবে কমে ১৭ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। টাকার বৈদেশিক মানের অবনমন, মারাত্মক ডলার-সংকট এবং মুদ্রাস্ফীতির তাণ্ডব ঘটাচ্ছে হুন্ডি ব্যবসা।
আনুষ্ঠানিক পথে রেমিট্যান্স পাঠালে ৫ শতাংশ প্রণোদনা প্রদানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও, পুঁজি পাচারের চাহিদাকে লক্ষ্য না করলে হুন্ডি ব্যবসা চাঙা থেকে যাবে। আমদানির ওভার-ইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডার-ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার সমস্যাগুলো পুরোনো সমস্যা। ওগুলোকে কঠোরভাবে দমনের ব্যবস্থা করতেই হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। এর পাশাপাশি ব্যাংকঋণ যাতে পুঁজি পাচারকারীদের দখলে না যায়, সেদিকেও কড়া নজর দিতে হবে।
ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সম্পর্কে বর্তমান অর্থমন্ত্রীর দৃষ্টিভঙ্গি গুরুতরভাবে ভুল। খেলাপি ঋণকে লুকিয়ে ফেলার আয়োজনকে যেভাবে জোরালো করা হয়েছে, সেটা পুঁজি পাচারকে একেবারেই সহজ করে দিয়েছে। পুঁজি পাচারকারী ব্যাংকঋণগ্রহীতাদের সম্পর্কে খোঁজখবর নিলে দেখা যাবে ইতিমধ্যে তাঁদের পরিবারের অধিকাংশ সদস্য বিদেশে চলে গেছেন। একসময় দেখা যাবে খেলাপি ঋণগ্রহীতা নিজেও নীরবে দেশত্যাগ করে বিদেশে পালিয়ে গেছেন। অতএব খেলাপি ঋণ ও পুঁজি পাচারের ওতপ্রোত সম্পর্ককে অস্বীকার করে সমস্যার সমাধান খুঁজতে যাওয়া আহাম্মকির শামিল।
ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক