বাংলাদেশের সঙ্গে আবারও রুপিতেই বাণিজ্য করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে ভারত। চেষ্টাটি নতুন নয়, ২০১৩ সালেও এ ধরনের উদ্যোগ নিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল ভারত, তখনো ডলারের বিপরীতে ভারতীয় রুপির ক্রমাগত মান পড়ছিল। তবে ২০২২ সালে ইউক্রেন আগ্রাসনে স্থানীয় মুদ্রার পতনের মুহূর্তে বৈশ্বিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিটাও বেশ জটিল এবং নাজুক।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক মুদ্রাবাজারে ডলারের দর বাড়ছে আর দরপতন হচ্ছে বিভিন্ন দেশের স্থানীয় মুদ্রার। ভারতীয় রিজার্ভ ব্যাংকের নতুন উদ্যোগের ফলে বর্তমান ব্যবস্থার পাশাপাশি ইনভয়েসিং, পেমেন্ট এবং আমদানি বা রপ্তানির সেটেলমেন্ট ভারতীয় মুদ্রার মাধ্যমে করা যাবে। অর্থাৎ চীন ও রাশিয়ার পর ভারতও ডলারকে পাশ কাটানোর নীতিতে যাচ্ছে।
ডলার বা অন্য কোনো হার্ড কারেন্সিকে এড়িয়ে দুটি দেশ যখন নিজেদের মধ্যে নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য চালায়, সেটিকে আর্থিক পরিভাষায় ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ বলা হয়। বাংলাদেশের সঙ্গে এ ধরনের ‘রুপি সোয়াপ’ প্রস্তাবনা প্রশ্নে দুটি মৌলিক প্রশ্ন উঠবে। প্রথমত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্পর্শকাতর এ বিষয়কে কীভাবে নেবে? দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশ রুপি আয় করবে কোথা থেকে?
যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব ও অবস্থান বোঝা গুরুত্বপূর্ণ
একটি দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদারদের সঙ্গে সরাসরি ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’, অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে ‘ভারতীয় রুপি সোয়াপ’ চুক্তি খারাপ কিছু নয়। ডলারের দাম ওঠা-পড়ার জন্য বর্তমানে দুই দেশের ব্যবসায়ীদেরই ভুগতে হচ্ছে। ফলে লেনদেন সরাসরি রুপিতে হলে তাতে দুই পক্ষই উপকৃত হতে পারে। মার্কিন ও আন্তর্জাতিক অবরোধের মুখে পড়ে ইরান খাদ্য ও ওষুধের বিপরীতে জ্বালানি তেল রপ্তানিতে ভারতের সঙ্গে রুপি সোয়াপ করেছে। বড় অর্থনৈতিক ও সামরিক শক্তিগুলো ডলারকে পাশ কাটিয়ে এমনটি করার উদাহরণ দু-একবার দেখালেও ছোট দেশের জন্য মার্কিন স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে এটা করে দেখানোটা বেশ কঠিন।
এমন উদ্যোগকে, যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থে আঘাত হিসেবে দেখবে কি না, সেটা বিবেচনায় নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, ভারতের তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের রপ্তানি বছরভেদে ১২ থেকে ১৩ গুণ বেশি। ফলে ডলার বাঁচাতে গিয়ে বাংলাদেশ যাতে প্রধানতম রপ্তানি বাজার বিকাশের পথে ‘নতুন বাধা’ কিংবা ‘খারাপ’ কিছু ডেকে না আনে।
তদুপরি যুক্তরাষ্ট্রের বাজার এমন যে সেখান থেকে বাংলাদেশ যা আমদানি করে, তার ১৮ থেকে ২০ গুণ বেশি রপ্তানি করে। আয় করা ডলার ওই বাজারে খরচ হয়ে যায় না। আনুমানিক ৭০০ মিলিয়ন ডলারের আমদানির বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রে বছরভেদে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি বাংলাদেশের। এর সুরক্ষা জরুরি। তবে শুধু বাংলাদেশ-ভারত নয়; বরং সার্কভুক্ত দেশগুলোর জন্য আলাদা একটি মুক্তবাণিজ্য অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করা গেলে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের বিষয়টি প্রাসঙ্গিক হবে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান আঞ্চলিক ক্ষমতাবিন্যাসে পাকিস্তানকে একঘরে করতে গিয়ে মূলত ভারতই সার্ককে অচল করে রেখেছে।
সব মিলে বৈধ রপ্তানিজাত রুপি এবং রেমিট্যান্সজাত রুপি আয়ের সরাসরি পথগুলো খুললে পরে রুপিতে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’-এ যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে ফিজিবল হবে। ডলার ভাঙিয়ে রুপি কিংবা ঋণ করে রুপি এনে তা দিয়ে রুপি সোয়াপ আত্মঘাতী হবে। এটা কোনোভাবেই বাণিজ্যিকভাবে ফিজিবল নয়। উপরন্তু আছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া।
বাংলাদেশ রুপি আয় করবে কোথা থেকে?
ভারতের ক্ষেত্রে আমদানি-রপ্তানির হিসাবটা যুক্তরাষ্ট্রের পুরো উল্টো। বাংলাদেশ ভারতের বাজারে যা রপ্তানি করে, তার পাঁচ থেকে ছয় গুণ বেশি আমদানি করে। যুক্তরাষ্ট্রের বাজার ডলার আয়ের উৎস হলেও ভারতের বাজার আমাদের ডলার খরচের জায়গা। বাড়তি ‘রুপি’ আয়ের কোনো উৎস নেই বাংলাদেশের; বরং ডলারেই আমদানি বাণিজ্য হয়। এক বা সোয়া বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির বিপরীতে ভারত থেকে সাত-আট বিলিয়ন ডলারের আমদানি করে বাংলাদেশ। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে বাণিজ্যবৈষম্যের অন্তত ছয় বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে রুপির উৎস কী?
বাংলাদেশ কি প্রবাসী আয় থেকে অর্জিত ডলারকে রুপিতে পরিবর্তন করে তারপর রুপিতে আমদানি করবে? যে ডলার সংরক্ষণের জন্যই ‘মুদ্রা বিনিময়ের’ প্রস্তাব, সেই রিজার্ভ মুদ্রা খরচ হয়ে গেলে আমাদের কী লাভ? অন্য উপায় হতে পারে, ভারতের ব্যাংক থেকে রুপিতে ঋণ করে সেটি দিয়ে ভারতীয় পণ্য কেনা। এটা সুদের দায় বাড়াবে। তদুপরি সুদের শর্তটা গুরুত্বপূর্ণ। অভিযোগ আছে, প্রতিবেশীর বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নে ভারত রাষ্ট্র হিসেবে বেশ অনুদার।
উপরন্তু বাংলাদেশের শ্রমবাজারে কাজ করে কয়েক লাখ ভারতীয় শ্রমিক রেমিট্যান্স নিয়ে যান। বাংলাদেশিরাও চিকিৎসা, ভ্রমণ, শপিংসহ অন্যান্য উদ্দেশ্যে ডলার নিয়ে ভারতে যায়। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের উপার্জিত ডলারের একটি বড় অংশ বৈধ কিংবা অবৈধভাবে ভারতে চলে যায়। তাহলে রুপি আয়ের বৈধ উপায় কী? এখানে বাংলাদেশকে রুপি আয় করার স্ট্যান্ডার্ড বা আন্তর্জাতিক মানসম্মত বাণিজ্য কূটনীতি সচল করতে হবে। অন্তত চারটি ইস্যু এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।
এক. কয়েক বছর আগে ভারত বাংলাদেশি কিছু পণ্যে শুল্ক উঠিয়েছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্য ভারতে এক বিলিয়ন ডলার পৌঁছেছিল। আশা করা হচ্ছিল, এটি দুই বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে খুব দ্রুত। অভিযোগ আছে ভারতে এ সিদ্ধান্তের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হওয়ায় ভারতীয় ব্যাংকগুলো কিছু পণ্যে এলসি খোলার ওপর পরোক্ষ বাধা দিয়ে থাকে। ফলে ভারতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আশা অনুযায়ী বাড়ছে না। এসব ছোট বা বড় পরিসরের পণ্যভিত্তিক পরোক্ষ রপ্তানি বাধা সরানোর সরাসরি উদ্যোগ নিতে হবে বাংলাদেশকে, যাতে রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্র প্রসারিত হয়।
দুই. ভারত উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি পণ্যে আমদানি নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। উল্লেখ্য, বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে চীন ২০২০ সালের জুলাই থেকে ট্যারিফ লাইনের আওতায় ৯৭ শতাংশ (আগের ৬১ শতাংশ) বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা চালু করেছে। শতভাগ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা না দিলে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়বে না, বৈদেশিক মুদ্রা কিংবা রুপিও অর্জিত হবে না।
তিন. ভারত পাট, পাটজাত পণ্য, বাংলাদেশে তৈরি হাইড্রোজেন পার-অক্সাইড ও মাছ ধরার জালের ওপর অ্যান্টি-ডাম্পিং শুল্ক আরোপ করায় বাংলাদেশের কিছু খাতে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব চর্চা পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে। অর্থাৎ রুপি সোয়াপ চাইলে ভারতকে পণ্যভিত্তিক যাবতীয় প্রত্যক্ষ বাণিজ্য বাধা, পরোক্ষ বাণিজ্য বাধা এবং বাংলাদেশি পণ্যে যাবতীয় অ্যান্টি-ডাম্পিং নিষেধাজ্ঞা সরাতে হবে।
চার. শ্রমবাজার উন্মুক্তকরণ। রপ্তানির চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি বলে বাংলাদেশ মূলত প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা জমা করে। কিন্তু ভারতীয় বাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকের প্রবেশাধিকার নেই। বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাসগুলো থেকে অফিশিয়ালি স্বল্প দক্ষ কিংবা দক্ষ কোনো খাতেই বাংলাদেশিদের কাজের অনুমতি বা ‘ওয়ার্ক পারমিট’ দেওয়া হয় না। ফলে ভারত থেকে রুপি হিসেবে বৈধ রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয় আনার কোনো উৎসই নেই। ভারত রুপিতে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’ চাইলে সবার আগে তাকে বাংলাদেশিদের জন্য তার শ্রমবাজার উন্মুক্ত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে ব্যবহৃত যেকোনো মুদ্রার একটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, এটি অবশ্যই সহজে পাওয়া যাবে। বাংলাদেশকে তার নিজস্ব শর্তে ভারতের রুপিতে সহজলভ্য প্রবেশাধিকার (স্ট্যান্ডার্ড ইকোনমিক অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট অ্যাকসেস) নিশ্চিত করতে হবে, যেটা ভারতের দ্বারা একপক্ষীয়ভাবে নির্দেশিত ও নিয়ন্ত্রিত হবে না। তাই বাংলাদেশ রুপি কীভাবে আয় করবে এবং রুপির বিপরীতে টাকার দরপতন কীভাবে ঠেকানো হবে, এই দুটো প্রশ্নের উত্তর খুঁজে এগোতে হবে।
টাকা ও রুপির মান ধরে রাখা ও সুইফট-সংযোগ
ভারত করোনার আগে-পরে রুপির দরপতন ঘটিয়েছে; কিন্তু বাংলাদেশ টাকার মান ধরে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। অর্থাৎ সঠিক মূল্যায়িত রুপির বিপরীতে অতি মূল্যায়িত টাকার প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ। রুপির বিপরীতে পতনশীল টাকার বিনিয়ম হারের কালে রুপিতে বাণিজ্য করলে বাংলাদেশের লোকসান হবে কারণ, এখনো বাংলাদেশ টাকার মান ধরে রাখতে বদ্ধ পরিকর, ফলে রুপির বিনিময় হারে বৈষম্য দেখা দেবে। উল্লেখ্য যে ২০১৬ সালে ভারত ৫০০ ও ১০০ রুপির নোট বাতিল করলে বাংলাদেশ ব্যাংকে কিংবা বাংলাদেশের মানি এক্সচেঞ্জের পুরোনো রুপির বিনিময়ে নতুন নোট ইস্যু করেনি বলে অভিযোগ আছে।
ডলারকে পাশ কাটিয়ে ভারতীয় রুপিতে বাণিজ্য করার লক্ষ্য হচ্ছে রুগ্ণ রুপিকে শক্তিশালী করা। ভারতের সঙ্গে যেহেতু বাংলাদেশের বাণিজ্যবৈষম্য ব্যাপক, স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে যে এত রুপি আমরা কোথায় পাব? উল্টো যখন রুপির বিপরীতে টাকার দরপতন হবে, তখন দফায় দফায় বাড়বে আমদানি ব্যয় ও মূল্যস্ফীতি। যেহেতু বাংলাদেশ খাদ্যপণ্য ও কাঁচামাল ভারত থেকে একচেটিয়া আমদানি করে, তাই বাংলাদেশের অর্থনীতিতে রুপির বিপরীতে টাকার দরপতন একটি ভয়াবহ বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিতে পারে।
ডলার ও ইউরো মুদ্রা দুটি এত ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হওয়ার একটি কারণ সহজলভ্যতা, অন্যটি তার সুইফট-সংযোগ। ভারতীয় মুদ্রার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সুইফট-সংযোগ কিংবা ভিসা, মাস্টারকার্ড পেপালসহ যাবতীয় আন্তর্জাতিক পেমেন্ট গেটওয়ে-সংযোগের আয়োজন সীমিত বলে পেমেন্ট গেটওয়ে-সংযোগের দিক থেকেও সরাসরি ‘কারেন্সি সোয়াপ’ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
বিপরীতে বাংলাদেশ-ভারত দ্রব্য বিনিময় পদ্ধতিতে যেতে পারে। অর্থাৎ বাংলাদেশের এক বিলিয়ন সমপরিমাণ রপ্তানিযোগ্য পণ্যের বিপরীতে ভারত সমপরিমাণ থেকে আমদানি পণ্যের লেনদেন হতে পারে। সে ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ‘কারেন্সি সোয়াপ’ বা মুদ্রা বিনিময়ের মার্জিন হবে এক বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রুপি।
সব মিলে বৈধ রপ্তানিজাত রুপি এবং রেমিট্যান্সজাত রুপি আয়ের সরাসরি পথগুলো খুললে পরে রুপিতে ‘কারেন্সি সোয়াপ অ্যারেঞ্জমেন্ট’-এ যাওয়া বাংলাদেশের পক্ষে ফিজিবল হবে। ডলার ভাঙিয়ে রুপি কিংবা ঋণ করে রুপি এনে তা দিয়ে রুপি সোয়াপ আত্মঘাতী হবে। এটা কোনোভাবেই বাণিজ্যিকভাবে ফিজিবল নয়। উপরন্তু আছে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার খাঁড়া।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক। গ্রন্থকার: চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও বাংলাদেশ, বাংলাদেশ: অর্থনীতির ৫০ বছর, অপ্রতিরোধ্য উন্নয়নের অভাবিত কথামালা, উন্নয়ন প্রশ্নে বাংলাদেশের কিছু সংকট ও সম্ভাবনা [email protected]