২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফর মুছে দিল খাসোগি-শিরিনের রক্ত

খাসোগি-শিরিনের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রায় সরদারের ভূমিকা রেখেছে ট্রাম্প-বাইডেন প্রশাসন।
ছবি: এএফপি

ক্ষমতা গ্রহণের পর দীর্ঘ মার্কিন ঐতিহ্য ভেঙে ট্রাম্প প্রথম বৈদেশিক সফরে গিয়েছিলেন সৌদি আরবে। ট্রাম্পের ওই সফরে ছিল মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কিছু ঘটার আভাস। ‘শতাব্দীর চুক্তি’র মাধ্যমে পরিষ্কার হয়েছে ট্রাম্পের আভাস। ট্রাম্পের প্রশাসন, বিশেষ করে ট্রাম্পের জামাতা জ্যারেড কুশনারের অঙ্কিত ‘শতাব্দীর চুক্তিতে’ একমত হয়ে ইসরায়েলের দখলদারি মেনে নিয়েছিল সৌদি বলয়ভুক্ত বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র। ক্ষমতা গ্রহণের আড়াই বছর পর জো বাইডেন এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যে। সফরের উদ্দেশ্য পরিষ্কার; ইসরায়েলকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে সংযুক্ত করা। সেই উদ্দেশ্যেই বাইডেন সফর করেছেন ইসরায়েল ও সৌদি আরবে।

ট্রাম্প যেভাবে ‘শতাব্দীর চুক্তির’ নামে ফিলিস্তিনিদের ভূমি দখলের আয়োজন করেছিলেন, ঠিক একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যে ‘শান্তি আর সুরক্ষার’ নামে বাইডেন বন্দোবস্ত করছেন দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষাকে স্তিমিত এবং সৌদি আরব ও ইসরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার। তবে বাইডেনের সফর ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়েছে খোদ মার্কিন মুলুকেই। বার্নি স্যান্ডার্স থেকে শুরু করে প্রগতিশীলদের বিশাল একটি অংশ খোলাখুলি ব্যক্ত করেছেন অসন্তুষ্টির কথা। এ অবস্থানের প্রধান কারণ পরপর ঘটে যাওয়া দুটি হত্যাকাণ্ড। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে জামাল খাসোগি ছিলেন প্রথমজন। দ্বিতীয়জন শিরিন আবু আকলেহ।

খাসোগি ও শিরিন আর অচেনা কোনো নাম নয়। ২০১৮ সালের গ্রীষ্মে ইস্তাম্বুলে সৌদি কনস্যুলেটের মধ্যে মোহাম্মাদ বিন সালমানের ‘নিজস্ব বাহিনীর’ কর্তৃক খুন হয়েছিলেন খাসোগি। তুরস্ক ও যুক্তরাষ্ট্রের নথিতে উঠে এসেছে এ ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ। কনস্যুলেটের মধ্যে মানুষ খুনের নজির সম্ভবত আধুনিক জামানায় নেই। এ ঘটনায় হতবিহ্বল মানুষের বিক্ষোভকে বিন সালমান অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে সামাল দিয়েছেন ট্রাম্প ও কুশনারের মিত্রতায় ভর করে। দ্বিতীয় হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছে চলমান এই গ্রীষ্মে। আরব বিশ্বের প্রখ্যাত নারী সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ নিহত হন ইসরায়েলি সৈন্যদের গুলিতে পশ্চিম তীরের জেনিন শরণার্থীশিবিরে। শিরিনের স্মরণে আল-জাজিরার প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং শিরিনের সহকর্মী মারওয়ান বিশারা লিখেছেন, মাতৃভূমি দখল করে নেওয়া ইসরায়েলিদের সঙ্গে নিয়মিত মোকাবিলা করেছেন শিরিন। নিঃস্ব ফিলিস্তিনিদের কণ্ঠের আওয়াজ ছিলেন তিনি। প্রতিনিয়ত নির্ভরতা জুগিয়েছেন আধিপত্যবাদবিরোধীদের বিক্ষোভে। রাবাত থেকে রিয়াদের লাখ লাখ ঘরে শিরিন ছিলেন প্রেরণা ও প্রতিরোধের নাম।

খাসোগি-শিরিনের হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের মুক্তি দিতে প্রায় সরদারের ভূমিকা রেখেছে ট্রাম্প-বাইডেন প্রশাসন। খাসোগি হত্যার শুরুর দিন থেকেই বিন সালমানের পক্ষ হয়ে ট্রাম্পের ওকালতি নির্ধারিত করে দিয়েছিল হত্যাকাণ্ডের ভবিষ্যৎ গতিপ্রবাহকে। বাণিজ্য, উন্নয়ন আর আধুনিকতার খোলসে পশ্চিমাকরণে সৌদি আরবকে উন্মুক্ত করা থেকে শুরু করে নানান আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ ছিল ট্রাম্পের ওকালতির প্রধান কারণ। আর ইউরোপীয়রা অন্ধের মতন অনুসরণ করেছে ট্রাম্পকে। যার দরুন বিন সালমান খাসোগি হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে শুধুই রেহাই নিয়েই ক্ষান্ত হননি, বরং সৌদির আর্থিক বিনিয়োগের সক্ষমতাকে ব্যবহার করে পশ্চিমের বহু দেশে বহুবার নিয়েছেন লালগালিচার সংবর্ধনা। নিউক্যাসল ক্লাবের মালিকানা ক্রয়সহ পশ্চিমাদের নানান দেশে বিন সালমানের মিলিয়ন মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ মুছে দিয়েছে খাসোগি হত্যার রক্ত। ট্রাম্প-কুশনারের কল্যাণে যেভাবে বিন সালমান রেহাই পেয়েছিলেন, অনুরূপ ধারাতেই বাইডেন ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন জুটির সমর্থন বৃহৎ অর্থে শিরিন হত্যাকাণ্ড থেকে মৌখিক রেহাই মিলেছে ইসরায়েলের। পার্থক্য শুধুই ট্রাম্প প্রকাশ্যে বিন সালমানের পক্ষ নিয়েছিলেন আর বাইডেন নরম গলায় উভয়ের সমালোচনা করেছেন।

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারের পক্ষে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান সম্ভব হবে না। সম্ভবত, এ কারণেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিরা বারবার উৎখাত হয়েছেন। গণতন্ত্র আর নারী অধিকারের কথা বলে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্বিষহ সেনা শাসন। অতীতের আলজেরিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের মোহাম্মাদ মুরসি, তিউনিসিয়া কিংবা সুদান যার নিখাদ নজির। অগণতন্ত্রীরাই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের অবিচ্ছেদ্য মিত্র। এই মিত্ররাই আবার ইসরায়েলের দখলদারির বৈধতা দিয়ে চলছে।

কয়েক বছর আগে যখন ট্রাম্প মার্কিন সমাজকে খ্রিষ্টীয় শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের উন্মাদনায় প্রায় আড়ষ্ট করে ফেলেছিলেন, তখন বাইডেন নির্বাচনী প্রচারণায় ‘ইনশা আল্লাহ’ বলে ওয়াদা করেছিলেন আবার মার্কিন মুলুককে নিজস্ব গতিপথে ফিরিয়ে আনার। একই সঙ্গে জনসমক্ষে অঙ্গীকার করেছিলেন সৌদি আরবকে ‘আন্তর্জাতিক পর্যায়ে অবাঞ্ছিত’ করার এবং বিন সালমানকে অবশ্যই এ খুনের জন্য পরিণাম ভোগের বাধ্য করার কথা। কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বাইডেন শুধু অঙ্গীকার ভঙ্গ করেই ক্ষান্ত হননি, বরং প্রেসনোট জারি এবং বিন সালমানের সঙ্গে বৈঠক করে রেহাই দিয়েছেন খাসোগি হত্যা মামলা থেকে।

বিশ্বের, বিশেষ করে মার্কিন গণমাধ্যমগুলো বাইডেনের এই সফরকে রাশিয়া-ইউক্রেনের যুদ্ধের দরুন জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধির ইস্যুকে ব্যবহার করে দাঁড় করিয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট পঠন। জ্বালানি তেলের মূল্যহ্রাসের জন্যই বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষ করে সৌদি সফর ওই সুনির্দিষ্ট পঠনের মূলমন্ত্র। নানাবিধ কারণে মার্কিন গণমাধ্যমগুলোর পঠনের সঙ্গে একমত পোষণের সুযোগ অত্যন্ত কম। মূলত, এ সফর ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যকার সম্পর্ককে স্বাভাবিকীকরণের দ্বিতীয় ধাপ। প্রথম ধাপ সম্পূর্ণ হয়েছিল ট্রাম্পের জামানায়। সেই ধাপে সৌদি বলয়ভুক্ত দেশ আমিরাত ও বাহরাইন সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে ইসরায়েলের সঙ্গে। দ্বিতীয় ধাপে সৌদি তার আকাশসীমা খুলে দিয়েছে ইসরায়েলের জন্য। বাইডেন ছিলেন ইসরায়েল থেকে ইসরায়েলের জন্য উন্মুক্ত সৌদি আকাশের প্রথম যাত্রী। তৃতীয় ধাপে সম্ভবত আগামী মার্কিন নির্বাচনের আগে কিংবা পরে এই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক পুরো মাত্রায় স্বাভাবিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিতর্কিত এই সফরে মধ্যপ্রাচ্যের গণতন্ত্রমনা মানুষের জন্য পরিষ্কার দুটি বার্তা রেখে গিয়েছেন বাইডেন।

আরও পড়ুন

প্রথমত, ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদানই গণতন্ত্র হয়ে ওঠার একমাত্র পথ। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সবকিছুই মার্কিন-ইসরায়েল-সৌদি বলয়ের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকলেও আরবদের থেকে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি আদায়ে ক্রমাগত ব্যর্থ হয়েছে, যার প্রধান কারণ সাধারণ আরবদের ইসরায়েলের দখলদারির বিরুদ্ধে ক্রমাগত আন্দোলন। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কোনো সরকারের পক্ষে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি প্রদান সম্ভব হবে না। সম্ভবত, এ কারণেই গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ব্যক্তিরা বারবার উৎখাত হয়েছেন। গণতন্ত্র আর নারী অধিকারের কথা বলে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে দুর্বিষহ সেনা শাসন। অতীতের আলজেরিয়া ও তুরস্কের সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের মোহাম্মাদ মুরসি, তিউনিসিয়া কিংবা সুদান যার নিখাদ নজির। অগণতন্ত্রীরাই মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিনদের অবিচ্ছেদ্য মিত্র। এই মিত্ররাই আবার ইসরায়েলের দখলদারির বৈধতা দিয়ে চলছে। দমন করে যাচ্ছে গণতন্ত্রপন্থীদের গণ-আন্দোলন।

দ্বিতীয়ত, অব্যাহত থাকবে বিচারহীনতার সংস্কৃতি। পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৯২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলের হাতে নিহত হয়েছেন ২৫ জনেরও বেশি গণমাধ্যমকর্মী। বিন সালমানের বাহিনী যেভাবে খাসোগিকে হত্যা করেছে, ঠিক একইভাবে ২০২১ সালের মে মাসে ইসরায়েলি বাহিনী গাজায় অ্যাসোসিয়েট প্রেসসহ বিশ্বের খ্যাতনামা সাংবাদিকদের অবস্থানরত গাজা মিডিয়া টাওয়ার ভবনটি ধ্বংস করেছিল। বিশ্বের প্রায় সব গণমাধ্যম সেই দৃশ্য সরাসরি সম্প্রচার করেছিল। আর সাম্প্রতিক ইসরায়েল হত্যা করেছে শিরিন আবু আকলেহকে। কিন্তু বিচার হয়নি। আর বিচার হওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এই বিচারহীনতা ভয়ের সৃষ্টি করেছে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে। আগ্রহী পাঠক প্রশ্ন তুলতেই পারেন, ভয় কি যথেষ্ট নয় সত্যকে আড়াল করে একটি নির্দিষ্ট অবয়বে খবর প্রকাশের জন্য?

যখন বাইডেনের এই সফর আলোচিত এই দুই হত্যা থেকে ইসরায়েলি ও সৌদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে বৈধতা দিয়ে চলছে, তখন মনে পড়ল দারিন তাতোর নামের একজন তরুণ ফিলিস্তিনি কবির কথা। কবিতা লেখার জন্য তাতোরকে পাঁচ মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন ইসরায়েলের আদালত। কবিতা লেখার জন্য তাতোরের হয়েছে কারাদণ্ড আর খাসোগি-শিরিন হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা পেয়েছেন মুক্তি। ইসরায়েলি দখলদারির বিরুদ্ধে শিরিনের প্রতিবাদে সঙ্গী ছিল ক্যামেরা আর শিরিনের কণ্ঠ আর তাতোর বেছে নিয়েছিলেন কবিতা। তাতোর লিখেছেন ‘প্রতিহত করো, হে আমার জনতা, রুখে দাও ওদের’। যখন মধ্যপ্রাচ্যের এই রাজপরিবারগুলো ইসরায়েলের দখলদারত্বকে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টায় লিপ্ত, তখন শিরিন-তাতোরই আশার প্রদীপের আলো জ্বালিয়ে রাখার অবিরাম চেষ্টায় নিয়োজিত আছেন। বিচারহীনতা, দখলদারি আর নব্য উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি থাকুক। খাসোগি-শিরিনের হত্যার বিচারহীনতার বিলাপ প্রতিনিয়ত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খুঁটিকে আঘাত করে যাচ্ছে।

  • রাহুল আনজুম যুক্তরাষ্ট্রের ক্যানসাস স্টেট ইউনিভার্সিটির নৃবিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা সহকারী।

আরও পড়ুন