চার্লসটন যুক্তরাষ্ট্রের রাজ্য সাউথ ক্যারোলাইনার সমুদ্রবন্দর নগরী। আটলান্টিকের পাড়ের এই নগরী ছিল দাস-বাণিজ্যের অন্যতম কেন্দ্র। একসময়ে পুরো যুক্তরাষ্ট্রে আফ্রিকা থেকে যত মুক্ত মানুষকে দাস বানিয়ে আনা হতো, তাদের অর্ধেকই এই বন্দর দিয়ে আসত।
বন্ধু দম্পতি শের খান ও ড. তারানা দীবার উদ্যোগে এই নগরীতে যেতে পারলাম। যেখানে এনে দাস কেনাবেচা হতো, সেই বাজারকাঠামো এখনো আছে। পুরোনো বাজারের ঘরগুলো সেভাবেই আছে। সেগুলো মেরামত করে কয়েকটিতে এখন এসি লাগানো হয়েছে।
বাকিগুলো খোলা। সেখানে এখন নানা গয়নাগাটি, কাপড়চোপড়, হস্তশিল্প কেনাবেচা হচ্ছে। ওপরে একটা জাদুঘর আছে। কিন্তু কোথাও দাস-বাণিজ্যের কথা উল্লেখ নেই। তার চিহ্নও নেই কোথাও।
ইতিহাস মুছে ফেলায় বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র সবার চেয়ে এগিয়ে। কেননা ইতিহাস এই দেশের শাসকদের জন্য খুবই অস্বস্তিকর। এই রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মিত হয়েছে ভয়ংকর গণহত্যা, লুণ্ঠন, জালিয়াতি ও জবরদস্তির ওপর।
এই অঞ্চলের পুরোনো সভ্যতা ধ্বংস আর স্থানীয় প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষকে হত্যা করে ইউরোপের সম্প্রসারিত অংশ হিসেবে এই রাষ্ট্রের যাত্রা শুরু। এখানকার আদি অধিবাসীরা, যাদের ভুল করে ‘রেড ইন্ডিয়ান’ বলা হয়, তাদের এখন খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই রক্তাক্ত দখলকার্য শেষ হওয়ার পর ইউরোপীয় দখলদারদের চিনি, কফিসহ নানা আবাদ শুরু হলো। সেখানে শ্রমিক লাগবে।
ভারতসহ বিভিন্ন উপনিবেশ থেকে জোরজবরদস্তি করে লোকজন এনে ক্যারিবীয় বিভিন্ন অঞ্চলে কাজ চলল। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চাহিদা বাড়ছিলই। ক্রমে আফ্রিকা দখল ও পুরো মহাদেশকে দাস জোগানোর উৎস বানানোর ভয়ংকর পর্ব শুরু হলো। এই নিয়ে পর্তুগিজ, ডাচ, স্প্যানিশ, ফরাসি, ব্রিটিশ শাসক বণিকদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ও দখল সম্প্রসারণও একসঙ্গেই চলতে থাকল। এই দাসদের এনে ফেলা হতো যেসব বন্দরে, তার মধ্যে প্রধান ছিল এই চার্লসটন। হঠাৎ হঠাৎ দাস বিদ্রোহের কারণে শ্বেতাঙ্গ মালিকদের সার্বক্ষণিক অস্ত্র রাখা এবং ‘প্রয়োজনে ব্যবহার’ তখনই বিধিসম্মত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের নাম–পরিচয়েও দখলযজ্ঞের অভিযোগ আছে। এই দেশকে প্রায় সবাই আমেরিকা বলে। যুক্তরাষ্ট্রকে আমেরিকা বললে, মিডিয়া প্রচারে এই নাম ব্যবহারে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয় দক্ষিণ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান মানুষেরা। আমি তাদের অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনেছি, যার সারকথা হলো, ‘ইউএস শাসকেরা আমাদের দেশ, সম্পদ—সবই দখল করেছে, আমাদের রক্তক্ষয়ের ইতিহাস অনেক লম্বা। তারা আমাদের নাম-পরিচয়ও দখল করতে চায়। কিন্তু আমেরিকা আমাদেরও।’
আবার চার্লসটনই ছিল উনিশ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের উত্তর-দক্ষিণ গৃহযুদ্ধে দক্ষিণের অন্যতম কেন্দ্র। একদিকে ইউনিয়ন, অন্যদিকে কনফেডারেশন। লিংকনের নেতৃত্বে ইউনিয়নপন্থীরাই জয়ী হয়। দাসপ্রথা আনুষ্ঠানিকভাবে নিষিদ্ধ হয়, যদিও আরও বহুদিন নানাভাবে এই ব্যবসা অব্যাহত থেকেছে। বৈষম্য ও নিপীড়ন এখনো নানাভাবে কাজ করে।
দাস ব্যবসা শুরুর কয়েক শতক পর ক্রমে শিল্পকারখানা গড়ে উঠতে থাকল বড় আকারে। শিল্পবিপ্লবে পুঁজিপতি শ্রেণি সংহত হওয়ার সঙ্গে শ্রমিকশ্রেণিও বিস্তৃত একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে এখানে স্পষ্ট অবয়ব নিতে থাকে। শ্বেতাঙ্গ, কৃষ্ণাঙ্গ, নারী-পুরুষ, বিভিন্ন জাতির মানুষের শ্রেণিগত ঐক্যের ক্ষেত্র এখানেই তৈরি হয়। ইউরোপের শ্রমিক আন্দোলনের সঙ্গেও তার সংযুক্তি ঘটে। উনিশ শতকের শেষার্ধে এই শ্রমিক আন্দোলন শুধু যে শ্রমঘণ্টা ও মজুরির দাবিকেই সামনে আনে তা-ই নয়, একই সঙ্গে তার রাজনীতি ও মতাদর্শও প্রবল শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে শ্রমিক আন্দোলনের বিস্ফোরণ ঘটে ১৮৮৬ সালের মে মাসে। আট ঘণ্টা শ্রমদিবসের সাধারণ দাবিতে সমবেত বিশাল সমাবেশের ওপর পুলিশি আক্রমণে হতাহত হওয়ার পরও সাজানো বিচারে ফাঁসি দেওয়া হয় কয়েকজন সংগঠককে। মে মাসে শিকাগোতে এই রক্তাক্ত গণবিস্ফোরণকে স্মরণে রাখতে প্রতিবছর ১ মে বিশ্বজুড়ে শ্রমিক অধিকারের দিবস হিসেবে পালনের কর্মসূচি শুরু হয়।
বিস্ময়কর যে যুক্তরাষ্ট্রের ঘটনা হলেও এখানে মে দিবস রাষ্ট্রীয়ভাবে পালিত হয় না। মে দিবসের ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে এখানে শ্রমিক দিবস পালন করা হয় ৪ সেপ্টেম্বর। ভার্জিনিয়ায় আইনজীবীসহ বেশ কয়েকজন পেশাজীবীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে জানলাম, তাঁরাও মে দিবস সম্পর্কে জানেন না।
যুক্তরাষ্ট্রে মূলধারার কোনো আলোচনায়, সংবাদমাধ্যমে মে দিবস প্রসঙ্গ আনা হয় না। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভেতর শুধু শাসক আর মিডিয়া-আচ্ছন্ন মানুষেরা বাস করেন না। বৈষম্য-নিপীড়নবিরোধী শক্তিশালী লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা ধরে রাখায় সচেষ্ট সজাগ মানুষও সেখানে আছেন। সে জন্য আমি একবার এই মে দিবসেই নিউইয়র্কে দেখেছিলাম, পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্তর্জাতিক সংহতির আওয়াজ তুলে দীর্ঘ মিছিল ও মে দিবস পালন।
ফল-ফসল, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ যুক্তরাষ্ট্রের আরেক প্রান্ত প্যাসিফিক তীরের ক্যালিফোর্নিয়া। প্রবাসী স্বজন মলি রতন এবং জবি সনতোষের সৌজন্যে গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন হয়ে মেক্সিকো সীমান্তে যাওয়ার সুযোগ হলো। আমাদের পথপ্রদর্শক বাংলাদেশের হিমু এবং মেক্সিকোর এভা মোরালেস।
এখানে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের মতো বিস্ময়কর শতকোটি বছর পুরোনো মাটি-পাথরের গঠন ও ভূবৈচিত্র্য দেখা যায়, আছে প্রশান্ত মহাসাগর, পাহাড়, আর শত শত মাইল ফল-ফসলের মাঠ। আছে কলোরাডো নদীর ওপর বিশ্বের অন্যতম পুরোধা প্রকৌশলবিদ্যার প্রয়োগ—হুবার বাঁধ। এই বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে শতাধিক মানুষকে, প্রধানত কালো, জীবন দিতে হয়েছিল। হুবার বাঁধ নির্মাণ আর গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন এলাকা ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে বসতিমুক্ত করায় আদিবাসীরা আবারও উচ্ছেদ হন।
ক্যালিফোর্নিয়া সবুজ অঞ্চল, যুক্তরাষ্ট্রের ফল, ফসল, সবজি, দুধ, ডিমের বড় অংশ এখান থেকেই জোগান যায়। এই কৃষি লাভজনক করার অন্যতম উৎস হচ্ছে মাটির নিচের ও ওপরের পানিসম্পদ। এ ছাড়া বহু বেআইনি অভিবাসী খুবই নিম্ন মজুরিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে এসব অঞ্চলে কাজ করেন। সেকরামেন্টোতে পানিবিশেষজ্ঞ ড. শ্যামল চৌধুরী জানালেন, কৃষিতে বেশুমার পানির ব্যবহারের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
কিছুদিন আগে এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে আইন হয়েছে। তিনি আরও বললেন, কলোরাডো নদীর ধারে নদীশাসনসহ নানা কাজে খোঁড়াখুঁড়ি করলে এখনো মানুষের হাড়গোড় গার্হস্থ্য জিনিস পাওয়া যায়। কারণ, এই নদীর ধার দিয়েই আদিবাসীরা বসবাস করতেন। আরও লক্ষণীয় যে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস, নিউ মেক্সিকো, অ্যারিজোনা—এসব রাজ্য একসময় মেক্সিকোর অংশ ছিল। এখন উঁচু দেয়াল দিয়ে সেই মেক্সিকোর মানুষদের ঠেকাতেই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের নাম–পরিচয়েও দখলযজ্ঞের অভিযোগ আছে। এই দেশকে প্রায় সবাই আমেরিকা বলে। কিন্তু এই পৃথিবীতে ‘আমেরিকা’ নামের কোনো দেশ নেই। এই নামে আছে দুই মহাদেশ—উত্তর আমেরিকা ও দক্ষিণ আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রকে আমেরিকা বললে, মিডিয়া প্রচারে এই নাম ব্যবহারে সবচেয়ে ক্ষুব্ধ হয় দক্ষিণ, লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয়ান মানুষেরা। আমি তাদের অনেককেই ক্ষোভ প্রকাশ করতে শুনেছি, যার সারকথা হলো, ‘ইউএস শাসকেরা আমাদের দেশ, সম্পদ—সবই দখল করেছে, আমাদের রক্তক্ষয়ের ইতিহাস অনেক লম্বা। তারা আমাদের নাম-পরিচয়ও দখল করতে চায়। কিন্তু আমেরিকা আমাদেরও।’
আশার কথা এই যে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাস লুকিয়ে রাখার নানা আয়োজন, মিডিয়া আর ‘জ্ঞানচর্চা’ই এখানকার শেষ কথা নয়। কান পাতলে এই ইতিহাসের সত্য উন্মোচন করে জাতি-লিঙ্গ-শ্রেণি-বর্ণবৈষম্য ও নিপীড়নবিরোধী মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার কণ্ঠও সেখানে শোনা যায়, চোখ খুললে তাদের তৎপরতা দেখা যায়।
একসময়ের নায়ক হিসেবে নন্দিত দখলদারদের মূর্তি এখন টেনে নামাচ্ছেন তাঁরা। যুক্তরাষ্ট্রের শাসকদের সাম্রাজ্যবাদী ধ্বংসাত্মক ভূমিকার পাশাপাশি এই ভিন্ন স্বরের মানুষদের দিকেও আমাদের তাকাতে হবে।
কেননা এই মানুষদের জ্ঞানচর্চা, সংগঠন ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে এই দেশের বহুজাতিক মানুষেরা যেমন নানা অধিকার অর্জন করেছে, বিশ্বে মানুষের সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের স্বরও তারা জোরালো করছে। এই ভিন্ন স্বর নিয়ে ভবিষ্যতে কখনো লিখব।
আনু মুহাম্মদ শিক্ষক, লেখক এবং ত্রৈমাসিক জার্নাল সর্বজনকথার সম্পাদক
ই–মেইল: [email protected]