বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান। কিন্তু ইতিহাস থেকে জানা যায় যে বাংলাদেশে সংসদ খুব কম সময়ই কার্যকর ছিল। এ জন্য বাংলাদেশের সংবিধানের কতগুলো বিধানকে দায়ী করা যেতে পারে। বর্তমান অন্তবর্তী সরকার দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্র সংস্কারের জন্য বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। এগুলোর মধ্যে সংবিধান সংস্কার কমিশন অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এই কমিশন সংবিধান সংশোধনের সুপারিশ করার মধ্য দিয়ে দেশের সব কটি সেক্টরে সংস্কার আনার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। একইভাবে বাংলাদেশের অকার্যকর সংসদকে কার্যকর করতে সংবিধান সংস্কার কমিটির অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে।
সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রধান দুটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটি হলো, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় আইনকানুন, নিয়মনীতি জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী তৈরি হবে। অর্থাৎ সংসদে যেসব আইনকানুন, বিল বা প্রস্তাব পাস হবে, তাতে বেশির ভাগ জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে। অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো রাষ্ট্রের শাসন বিভাগ, অর্থাৎ মন্ত্রিপরিষদ সংসদের কাছে তথা জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকবে। অর্থাৎ মন্ত্রীরা যৌথভাবে ও এককভাবে সংসদ সদস্যদের কাছে তথা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন। দুটি বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান থাকলে রাষ্ট্রের সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য বিকশিত হয়, জনগণই রাষ্ট্রের মালিক হিসেবে আবির্ভূত হয়।
পক্ষান্তরে ওই বৈশিষ্ট্যগুলো বিদ্যমান না থাকলে সংসদীয় গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায় এবং জনগণ শোষিতের শ্রেণিতে অবস্থান করে। সংসদীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যদ্বয় কার্যকর কি না, তা নির্ভর করে ওই রাষ্ট্রের সংসদ কতটুকু কার্যকর, তার ওপর। বাংলাদেশে সংসদীয় গণতন্ত্র বিদ্যমান রয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে; কিন্তু এ দেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায়, জনগণ বরাবরই শোষিতের শ্রেণিতে অবস্থান করেছে এবং রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাঁরা প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁরা শাসক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। কিন্তু বাস্তবে এ রকম হওয়ার কথা ছিল না; বরং উল্টোটা হওয়ার কথা ছিল। তাহলে কী ধরে নেওয়া যায়, সংসদীয় গণতন্ত্রের ওই গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য কার্যকর নয়। সংসদ কি কার্যকর ভূমিকায় নেই।
আমরা যদি আলোচ্য প্রথম বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকাই, অর্থাৎ সংসদে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে আইনকানুন, বিভিন্ন বিল, প্রস্তাব পাস হয়, তাতে কি জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাই, নাকি কোনো একক কিংবা গুটিকয়েক ব্যক্তির ইচ্ছার প্রতিফলন দেখতে পাই। এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাব, যদি আমরা বাংলাদেশের সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পর্যালোচনা করি।
৭০ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে যে কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হলে তিনি যদি (ক) ওই দল থেকে পদত্যাগ করেন অথবা (খ) সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করেন, তাহলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হবে। তবে তিনি সে কারণে পরবর্তী কোনো নির্বাচনে সংসদ সদস্য হওয়ার অযোগ্য হবেন না। অর্থাৎ ৭০ অনুচ্ছেদের (খ) দফা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে সংসদ সদস্য বিবেচিত হলে তিনি যদি সংসদের ওই দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করেন, তাহলে তিনি আর সংসদ সদস্যই থাকবেন না। অর্থাৎ ওই দফার কারণে সেই সংসদ সদস্য জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে কোনো আইন কিংবা কোনো বিল কিংবা কোনো প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে দলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করতে পারবেন না।
অর্থাৎ দলীয়প্রধান কিংবা গুটিকয়েক দলীয় নেতা সংসদে যে আইন কিংবা কোনো বিল কিংবা প্রস্তাব পাস করতে চান, ওই দলের সংসদ সদস্যদের তা সমর্থন করতে হচ্ছে, এমনকি নিজের ইচ্ছার বিপক্ষে হলেও দলের পক্ষে ভোট দিতে হচ্ছে। তা না হলে তাঁর সংসদ সদস্য পদই বহাল থাকবে না। ফলে সংসদে কোনো আইন বা কোনো বিল বা কোনো প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে না, বরং দলীয়প্রধান কিংবা গুটিকয়েক নেতার ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে। এতে করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার পরিবর্তে শাসকদের এক নায়কতান্ত্রিক মনোবৃত্তি প্রকট হয়ে ওঠে এবং একই সঙ্গে সংসদের কার্যকারিতা দুর্বল হয়ে পড়ে।
এতে করে সংসদীয় গণতন্ত্রের মূল উদ্দেশ্যই ব্যাহত হয়। আমরা দেখতে পাচ্ছি, এমন পরিস্থিতির জন্য সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের (খ) দফায় বর্ণিত বিধানই অনেকাংশ দায়ী। ফলে ওই দফা বাতিল করা আবশ্যিক। অর্থাৎ কোনো নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হয়ে কোনো ব্যক্তি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে সংসদে ওই দলের বিপক্ষে ভোট দান করলে সংসদে তাঁর আসন শূন্য হওয়ার যে বিধান রয়েছে, তা বাতিল করতে হবে। তাহলে সংসদ সদস্যরা জনগণের কথা চিন্তা করে কোনো বিল বা প্রস্তাবের পক্ষে কিংবা বিপক্ষে ভোট প্রদান করতে পারবেন এবং সংসদও কার্যকর সংসদে পরিণত হবে।
সরকারকর্তৃক উত্থাপিত কোনো বিলের বিপক্ষে ভোট দিতে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের মধ্য যে আরেকটি ভীতি কাজ করে, তা হলো, সরকারপ্রধান ও দলীয়প্রধান একই ব্যক্তি হওয়ায় সরকারদলীয় কোনো সংসদ সদস্য সরকারকর্তৃক আনীত কোনো বিলের বিপক্ষে ভোট প্রদান করলে ওই সরকারপ্রধান দলীয়প্রধান হিসেবে ওই সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে দলীয়ভাবে কোনো ব্যবস্থা নেওয়ার আশঙ্কা থাকে, যা ওই সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের সংসদে স্বাধীনভাবে ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো ব্যক্তি সরকারপ্রধান তথা প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি একই সঙ্গে দলীয়প্রধান থাকতে পারবেন না মর্মে বিধান করা যেতে পারে। সংবিধানের ৫৭ নম্বর অনুচ্ছেদের (১) দফায় কী কী কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে, তা উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই দফায় উল্লেখ রয়েছে যে প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে যদি (ক) তিনি কোনো সময়ে রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র প্রদান করেন, অথবা (খ) তিনি সংসদ সদস্য না থাকেন। এই দুটি উপদফার সঙ্গে (গ) উপদফা হিসেবে সংযোগ করা যেতে পারে যে ‘তিনি যদি কোনো দলীয়প্রধান হয়ে থাকেন, তাহলে ৩ দিনের মধ্যে ওই দলীয়প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ না করেন অথবা তিনি যদি নতুন করে কোনো দলীয়প্রধানের পদ গ্রহণ করেন, তাহলে তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ শূন্য হবে।’
এই বিধান করা হলে প্রধানমন্ত্রী দলীয়প্রধান হিসেবে ওই বিপক্ষে ভোট প্রদানকারী সরকারদলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারবেন না। এতে করে সংসদ সদস্যরা সংসদে নির্বিঘ্নে ভোট প্রদান করতে পারবেন এবং সংসদে তাঁর কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারবেন।
সংসদীয় গণতন্ত্রের অপর গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো মন্ত্রীরা যৌথভাবে ও ব্যক্তিগতভাবে সংসদের কাছে তথা জনগণের কাছে জবাবদিহি করবেন। মন্ত্রীরা যদি যৌথ ও ব্যক্তিগতভাবে সংসদের কাছে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকেন, তাহলে তাঁরা তাঁদের কাজে অনিয়ম করা থেকে বিরত থাকবেন। মন্ত্রিসভার শুধু যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার বিধান থাকলে, তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। কারণ, কোনো বিষয়ে মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হলে এবং মন্ত্রিসভা অনাস্থা ভোটের সম্মুখীন হলে সরকারদলীয় সংসদ সদস্যদের ওই মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। এতে করে মন্ত্রিসভা আইনবহির্ভূত কাজ করে পার পেয়ে যায়।
কিন্তু কোনো মন্ত্রীর যদি এককভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকার বিধান থাকে, তাহলে তা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। কারণ, কোনো মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এককভাবে অভিযোগ আনা হলে সরকারদলীয় ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যের মধ্যে সেই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে ভোট না দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায় না। এতে করে কোনো মন্ত্রী আইনবহির্ভূত কাজ করলে সে জন্য ওই মন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়ন করলে সংসদ সদস্যরা তাঁর বিরুদ্ধে ভোট দিতে দ্বিধাগ্রস্ত হবেন না। ফলে যেকোনো মন্ত্রী তাঁর কাজের জন্য এককভাবে সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকবেন এবং তাঁর বেআইনি কাজের জন্য তাঁকে তাঁর পদ থেকে অপসারণ করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সংবিধানের ৫৫ অনুচ্ছেদের ৩ দফায় মন্ত্রিসভা যৌথভাবে এবং কোনো মন্ত্রী এককভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন মর্মে উল্লেখ করা যেতে পারে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অকার্যকর সংসদকে কার্যকর করতে সংবিধান সংশোধনের বিকল্প নেই। আর গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করার ক্ষেত্রে উল্লেখিত বিষয়গুলো সুপারিশ করার মধ্য দিয়ে সংবিধান সংস্কার কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
মো. শরিফুল হক আইনবিষয়ক গবেষক ও লেখক