দুর্গাপূজায় সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলা কীভাবে সম্ভব?

দুর্গাপূজায় দেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে পূজা উদ্‌যাপিত হবে।ফাইল ছবি

শান্তিতে নোবেলজয়ী ডেসমন্ড টুটুর কথা দিয়েই শুরু করি। তিনি বলেছিলেন, ভালোবাসা ও সহমর্মিতা সম্প্রীতির ভিত্তি। বাংলাদেশ ঐতিহাসিকভাবেই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আবহমানকাল ধরে এ দেশে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ পারস্পরিক সম্প্রীতি বজায় রেখে বসবাস করে আসছে। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনে একক ও সক্রিয়ভাবে যে উপাদান কাজ করেছে, সেটি হলো আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার শক্তি।

গত ২৭ আগস্ট বিবিসি বাংলায় ‘বাংলাদেশে ক্ষমতার পরিবর্তন ঘিরে হিন্দুদের বারবার শঙ্কায় পড়তে হয় কেন?’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ক্ষমতার পটপরিবর্তনে সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘু, বিশেষ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নিরাপত্তার বিষয়টি বেশ স্পর্শকাতর হয়ে ওঠে বলে গণমাধ্যমটির সংবাদে বলা হয়।

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত এই ভূখণ্ডে ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর যেসব বড় সংগঠিত হামলা হয়েছে, তার কারণ যেমন রাজনৈতিক, আবার সাম্প্রদায়িকও। সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে আমাদের জনগোষ্ঠীর—ক্ষুদ্র হলেও—একটা অংশের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ আছে বলেই সেটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।

গত আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পটপরিবর্তনে ৫ আগস্টের পরপর দেশের বিভিন্ন জায়গায় ধর্মীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বহু হামলার ঘটনা ঘটেছে। কোথাও বাড়িঘরে, কোথাও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে, কোথাও উপাসনালয়ে হামলা-ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। দেশের প্রথম সারির একটি গণমাধ্যম গত ৫ থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত অনুসন্ধান চালিয়ে হামলায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অন্তত ১ হাজার ৬৮টি ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তথ্য পেয়েছে। এর বাইরে হামলা হয়েছে ২২টি উপাসনালয়ে। সনাতন ধর্মাবলম্বী ছাড়াও হামলা হয়েছে খ্রিষ্টান, আহমদিয়া সম্প্রদায়, সাঁওতালসহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ওপর।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ধর্মীয় উসকানির জন্য যারা ব্যবহার করে, তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনি বিধানগত সংস্কার করতে হবে।

দেশের সর্বোচ্চ আইন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান এ বিষয়ে অর্থাৎ নাগরিকের অধিকার বিষয়ে সুস্পষ্ট। ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে আইনের দৃষ্টিতে সব নাগরিকের সমতা, ২৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী–পুরুষ বা জন্মস্থানভেদে নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রের কোনো বৈষম্য প্রদর্শনের বিরুদ্ধে স্পষ্ট উচ্চারণ রয়েছে। সুতরাং কোনো ধরনের সাম্প্রদায়িকতা অবশ্যই বৈষম্যের একটি চিত্র, যা মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী। এই প্রেক্ষাপটে এ বছর অক্টোবর মাসের প্রথমাংশে অনুষ্ঠিত হবে বাঙালি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গাপূজা। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে কোথাও প্রতিমা ভাঙচুর, কোথাও সংখ্যালঘু নির্যাতনের সংবাদও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন সব মানুষের মানবাধিকার নিশ্চিতকরণের উদ্যোগ গ্রহণে আইনি ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত। মানবাধিকার কমিশনের প্রত্যাশা হলো, ধর্মবর্ণ–নির্বিশেষে সব মানুষের মানবাধিকার সমুন্নত ও নির্বিঘ্ন থাকবে। কমিশন মনে করে, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে, ধর্মীয় ও জাতিগতভাবে জনসংখ্যায় সংখ্যালঘুর অস্তিত্ব আছে, যদিও কমিশন লঘু বা গুরুর বদলে সমনাগরিকতায় বিশ্বাস স্থাপন করে। সবাইকে সমান নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করে। এ ক্ষেত্রে কমিশনের অভিমত হলো, বাংলাদেশের নাগরিক হয়েও কেউ যদি অসহায় বোধ করেন, তাহলে দেশের মানবাধিকার সংরক্ষণ বাধাগ্রস্ত হবে।

আসন্ন দুর্গাপূজায় দেশের ৩২ হাজার ৬৬৬টি মণ্ডপে পূজা উদ্‌যাপিত হবে। মণ্ডপগুলোয় যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি বলে কমিশন মনে করে। তবে এ ক্ষেত্রে সমাজের সবার আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করা বাঞ্ছনীয়। দুর্গাপূজাকে ঘিরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য যেসব নিয়ম-নীতি ও ব্যবস্থা গ্রহণ সমীচীন, তার মধ্যে রয়েছে:

১. সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ধর্মীয় উসকানির জন্য যারা ব্যবহার করে, তাদের সার্বক্ষণিক নজরদারিতে রাখতে হবে এবং এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনে আইনি বিধানগত সংস্কার করতে হবে।

২. বৈষম্যবিরোধী ছাত্র–জনতার আন্দোলন ও রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকালে সহিংসতায় বিপুলসংখ্যক স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য আক্রান্ত ও হতাহত হন। ঘটনার আকস্মিকতায় বিহব্বল হয়ে তাঁদের মধ্যেও খানিকটা স্থবিরতা, মনোবল ভেঙে পড়া ও ক্ষেত্রবিশেষে নিষ্ক্রিয়তা পরিলক্ষিত হয়। অতএব দেশব্যাপী বিশালসংখ্যক পূজামণ্ডপে নিরাপত্তার দায়িত্ব পালনে তাঁদের সক্ষমতা যাচাই করে উপযুক্ত করে তোলা বা সহযোগী শক্তি গঠনের মাধ্যমে দায়িত্ব প্রতিপালনে যত্নবান হতে হবে।

৩. স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে শৈথিল্য থাকলে তা খতিয়ে দেখতে হবে এবং তার পুনরাবৃত্তি রোধে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে হবে।

৪. পূজামণ্ডপগুলোয় বিট পুলিশিংয়ের আদলে সুনির্দিষ্টভাবে একজন বা ততোধিক পুলিশ কর্মকর্তা নিযুক্ত করতে হবে।

৫. স্থায়ী-অস্থায়ী ও পারিবারিক উদ্যোগে আয়োজিত সব ধরনের মণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরার ব্যবস্থা করতে হবে।

৬. স্থানীয়ভাবে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দিয়ে মন্দিরের অভ্যন্তরের শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। সব ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা রোধকল্পে সব স্বেচ্ছাসেবকের বিস্তারিত পরিচিতিসহ তালিকা স্থানীয় থানায় সংরক্ষণ করতে হবে এবং স্বেচ্ছাসেবকদের ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৭. পূজামণ্ডপ ও আশপাশের এলাকায় রোভার স্কাউট ও বিএনসিসি মোতায়েন করতে হবে।

৮. প্রতিটি পূজামণ্ডপে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী পুলিশ সদস্য, নারী আনসার সদস্য ও নারী স্বেচ্ছাসেবী সদস্য নিয়োজিত রাখতে হবে।

৯. প্রতিটি জেলা ও উপজেলা প্রশাসনে পূজার নিরাপত্তা ও পূজা অনুষ্ঠান নির্বিঘ্ন করতে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করতে হবে।

১০. বিপণিবিতান ও মার্কেটগুলোয় যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা রাখতে হবে।

১১. সংশ্লিষ্ট সব এলাকায় নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।

১২. বৈদ্যুতিক তারের যথাযথ উচ্চতা ও নিরাপদে স্থাপন ও বিতরণ নিশ্চিত করতে হবে।

১৩. অগ্নিকাণ্ড ও বৈদ্যুতিক দুর্ঘটনা মোকাবিলায় যথাযথ নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

১৪. বিকল্প আলোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

১৫. ধর্মীয় আচার–অনুষ্ঠানে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের নির্বিঘ্নে মন্দির–মণ্ডপে যাতায়াতের লক্ষ্যে এলাকাভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মোতায়েন রাখতে হবে।

১৬. মণ্ডপ ও মন্দিরভিত্তিক নিরাপত্তার ছক প্রস্তুত করতে হবে। পুলিশের একাধিক টহলকারী ইউনিট মোতায়েন রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে।

১৭. প্রতিমা বিসর্জনের সময়ে মন্দির থেকে স্থানীয় জলাধার পর্যন্ত নির্বিঘ্নে চলাচলের ব্যবস্থা রাখতে হবে।

১৮. দুর্গাপূজা চলাকালে পোশাকে ও সাদাপোশাকে পুলিশের পাশাপাশি সোয়াট, ক্রাইসিস রেসপন্স টিম, কুইক রেসপন্স টিম, ক্রাইম সিন ভ্যান ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট সার্বক্ষণিক প্রস্তুত রাখতে হবে।

১৯. দুর্গাপূজা উপলক্ষে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স এবং অন্যান্য পুলিশ ইউনিটে মনিটরিং সেল চালু করতে হবে।

২০. জনসাধারণের অতিরিক্ত চাপ মোকাবিলায় ট্রাফিক ব্যবস্থা যথাযথভাবে নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে। প্রধান সড়কগুলোয় কার্যকরভাবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা রাখতে হবে।

২১. বর্তমানে দেশে সেনাবাহিনী মোতায়েন রয়েছে; যৌথ বাহিনীগুলোর কার্যক্রমেও সমন্বয় রক্ষা করতে হবে।

সর্বোপরি, আমরা বিভেদ চাই না, চাই আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ঐক্যবদ্ধ একটি মানবসমাজ।  

  • কামাল উদ্দিন আহমেদ জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান