পেনশনের ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের দাবিতে সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে গেছেন। নতুন পেনশন-ব্যবস্থার অধীনে প্রত্যয় স্কিমে অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা কী কী সুবিধা হারাচ্ছেন, তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির পাঁচ সদস্যের কমিটি যে বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে, তা যথার্থ।
এ নতুন কর্মসূচি চালুর পর জুলাই ২০২৪ থেকে নতুন যোগ দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরাই শুধু বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, তা নয়; দেশের স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর চার শতাধিক প্রতিষ্ঠানের সবাই একই পরিস্থিতির শিকার হবেন।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমে পড়লেও অন্যরা এত দ্রুত আন্দোলনের ঘোষণা দেয়নি। তবে ক্রমে অন্যান্য সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানেও এ অসন্তোষ ছড়াবে না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে। পাঁচটি আলাদা কর্মসূচি যথা প্রত্যয়, প্রগতি, সুরক্ষা, প্রবাস ও সমতা নিয়ে ‘সর্বজনীন’ পেনশন কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু হলো।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এখন ‘প্রত্যয়’ নিয়ে যে বিশ্লেষণ দাঁড় করিয়েছে, সেখানে শুধু তাদের নিজেদের প্রত্যয় স্কিমের সুযোগ-সুবিধাকেন্দ্রিক কথা বলা হয়েছে। সামগ্রিক পেনশন-ব্যবস্থার বিরাজিত বৈষম্য ও ন্যায্যতার প্রশ্ন এখানে উচ্চারিত হয়নি।
দেশের একাডেমিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বের অংশ হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-গবেষকদের কাছ থেকে জাতির প্রত্যাশা আরও অনেক বেশি। শুধু শিক্ষক সমাজের ট্রেড ইউনিয়ন ধরনের নিজেদের চাকরিগত সুযোগ-সুবিধার মধ্যে সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতার বিশ্লেষণকে সীমিত করলে বিষয়টির সর্বজনীনতা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সর্বজনীন পেনশন-ব্যবস্থার আওতায় নতুন স্কিমগুলো চালুর আগে সবাই যখন সরকারি চাকুরেদের সমমানের পেনশনের আওতায় আসেন, তখন তাঁরা খুব আনন্দিত ছিলেন।
এখন সরকার যখন নির্ভেজাল সরকারি চাকরিজীবী (ক্যাডার ও নন-ক্যাডার) এবং ভেজালযুক্ত (?) (যথা স্বায়ত্তশাসিত ও রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজস্ব খাতের অন্তর্ভুক্ত) চাকরিজীবীদের জন্য ভিন্ন ধরনের পেনশন পদ্ধতি চালু করতে যাচ্ছে, তখন দেখা যাচ্ছে ভবিষ্যতে যাঁরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্য সব সরকারি সংস্থাগুলোর চাকরিতে যোগদান করবেন, তাঁরা বৈষম্যের শিকার হবেন।
এখন পেটে হাত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। অন্যরা এখনো মাঠে না নামলেও অসন্তোষের প্রকাশ আছে। বেসরকারি চাকরিজীবী, নানা স্বাধীন পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ও নানা অনানুষ্ঠানিক খাতের স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই ‘সর্বজনীন পেনশন’ কতটুকু অর্থবহ, তা স্পষ্ট নয়।
একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের সর্বজনীন নাগরিক পেনশন চালুর সিদ্ধান্তটি সর্বস্তরে অভিনন্দিত হয়েছিল। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তাঁর এক বাজেট বক্তৃতায় বিষয়টির অবতারণা করেন। কিন্তু বিষয়টির ওপর দেশের একাডেমিক-গবেষক ও নীতি চিন্তকদের বিশেষ কোনো সাড়া ছিল না। রাজনীতির লোকেরা বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না, এমন একটি নীতি বাংলাদেশে সফলভাবে গ্রহণ করা যেতে পারে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত সর্বজনীন পেনশন নীতি বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করলে তা একান্তভাবে এবং এককভাবে আমলাতন্ত্রের করতলগত হয়। কোনো নাগরিক আলোচনা বা একাডেমিক মতবিনিময়ে গত দুই বছরে এ নিয়ে আলোচনা হতে শুনিনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে এ বিষয়ে খুবই আগ্রহী ছিলাম। ২০১৫ থেকে কিছু প্রবন্ধ-নিবন্ধ পরপর লিখেছি, কিন্তু নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে এর কোনো প্রতিফলন দেখা যায়নি।
এখন পেটে হাত পড়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছি। অন্যরা এখনো মাঠে না নামলেও অসন্তোষের প্রকাশ আছে। বেসরকারি চাকরিজীবী, নানা স্বাধীন পেশার মানুষ, ব্যবসায়ী, কৃষক, শ্রমিক ও নানা অনানুষ্ঠানিক খাতের স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য এই ‘সর্বজনীন পেনশন’ কতটুকু অর্থবহ, তা স্পষ্ট নয়।
এ পেনশন-ব্যবস্থার প্রধান সীমাবদ্ধতা হচ্ছে এটির কোনো সর্বজনীন রূপ-কাঠামো নেই। এটি অ্যাডহক সঞ্চয়ী স্কিমের কাঠামোতে সৃষ্ট সেফটি নেট কার্যক্রমের প্রকৃতিতে সাজানো একটি কর্মসূচি। এর সঙ্গে পেনশন দাবির সর্বজনীন নাগরিক অধিকারেরও কোনো সম্পর্ক নেই।
এখন সরকারি চাকরিজীবী ও অন্য যাঁরা এ পেনশন-সুবিধা ভোগ করছেন বা করবেন, তাঁরা সে সুবিধা পাওয়ার জন্য কোনো রকমের কোনো কিস্তি-প্রিমিয়াম কিছুই সরকারকে দেবেন না। তাঁরা বেতন থেকে কোনো অর্থ না দিয়ে আজীবন পেনশন, মৃত্যুর পর নমিনির আজীবন পেনশন, এককালীন আনুতোষিক, বছরে পেনশনের ৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি, অবসর প্রস্তুতিমূলক ছুটি, মাসিক চিকিৎসা ভাতা, দুটি উৎসব ভাতা ও বৈশাখী ভাতা পাবেন। আর বাকিরা অনেকে এসব সুবিধা একবার পেয়েও এখন হারাতে যাচ্ছেন। তাই এ ব্যবস্থাটি সরকারের নানা স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ক্ষেত্রেও চরমভাবে বৈষম্যমূলক।
এ রকমভাবে কোনো কনট্রিবিউশন ছাড়া রাজস্ব বাজেটের অর্থ থেকে পেনশন-ব্যবস্থা চালু রাখা অযৌক্তিক শুধু নয়, টেকসইও হওয়ার নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও যদি এ অন্যায্য ব্যবস্থার সুবিধাভোগী হয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের মতো হতে চান, সেটি কতটুকু নৈতিক, সে প্রশ্ন করতে হবে। আশা করব, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা শুধু নিজেদের সুবিধার জন্য নয়, একটি ন্যায্য ব্যবস্থার জন্য সংগ্রাম করবেন।
বিশ্বব্যাপী পেনশনের অর্থায়নের ও ব্যবস্থাপনার যে মডেলগুলো, তার সঙ্গে আমাদের এ ব্যবস্থা সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পেনশন প্রাপ্তি ও পেনশন তহবিলের মৌলিক বিবেচ্য বিষয় হবে দেশের করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন-ব্যবস্থার কার্যকর সংযোগ। যেখানে সব ব্যক্তি করদাতা পেনশন পাওয়ার অধিকারী হবেন। ট্যাক্স ও পেনশন হবে একটি অপরটির পরিপূরক। দেশের প্রাপ্ত করব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে সরকার একটি ‘পেনশন তহবিল’ গঠন করবে।
সে তহবিল ব্যবস্থাপনার জন্য পেনশন আইন ও পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। এখন দেশে পেনশন কর্তৃপক্ষ আছে, কিন্তু জাতীয় পেনশন তহবিল নেই। ‘প্রত্যয়’, ‘প্রগতি’, ‘সুরক্ষা’, ‘প্রবাস’, ‘সেবক’ ও ‘সমতা’ স্কিম থেকে এ ধরনের তহবিল সৃষ্টি হবে। আবার সরকারি চাকরিজীবীর পেনশন হবে জনগণের দেওয়া কর-রাজস্ব বাজেট থেকে। নগ্নভাবে এখানে ন্যায্যতার নীতি লঙ্ঘিত হয়েছে।
একটি একীভূত সাধারণ আইন ও নীতির আলোকে পেনশন-ব্যবস্থা সংগঠিত হবে। পেনশন-ব্যবস্থা সুদূরপ্রসারী কঠিন একটি আর্থিক শৃঙ্খলাভিত্তিক কার্যক্রম। এখানে সস্তা জনতুষ্টির অবকাশ সীমিত। পাঁচ থেকে দশ বছরের একটি পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে ধাপে ধাপে এটি চালু করা উচিত ছিল। প্রথমে দরকার ছিল একটি আইন। সঙ্গে করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশনকে কীভাবে সম্পর্কিত করা যায়, তার বিশ্লেষণ ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা।
আমাদের প্রস্তাব ছিল তিন থেকে পাঁচ বছর ধরে বাজেট থেকে আয়কর ও ভ্যাট রাজস্বের ন্যূনতম ৫-১০ শতাংশ সংরক্ষণ করে একটি তহবিল গঠন। জাতীয় পরিচয়পত্র ও টিআইএন নম্বরের সঙ্গে একটি ‘সামাজিক নিরাপত্তা নম্বর’ প্রদান। এবার ধাপে ধাপে প্রণীত পেনশন আইনের অধীনে পেনশন দেওয়া শুরু করা।
প্রথম ধাপে পেনশন পাবেন যাঁদের বয়স ৬০ অতিক্রম করেছে এবং যাঁরা গত ১০ বছর আয়কর দিয়েছেন। পরের বছর থেকে অন্তর্ভুক্তি বিস্তৃত হবে। সরকারি চাকরিজীবী এবং অন্যদের পেনশন ও আনুতোষিক যা ছিল, তা আপাতত বহাল থাকবে এবং ধীরে ধীরে আয়কর ভিত্তি ও আয়করব্যবস্থার সঙ্গে সরকারি পেনশন ফেজ আউট হবে। অন্তর্বর্তী সময়ের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীন দরিদ্রভিত্তিক নগদ স্থানান্তরও অব্যাহত থাকবে।
বর্তমানে ৩৫-৪০ লাখ কর প্রদানকারী নাগরিকের কর ন্যায্যতাভিত্তিক কোনো প্রণোদনা নেই। করব্যবস্থার সঙ্গে পেনশন-ব্যবস্থাকে যুক্ত করলে ট্যাক্স নেটে অন্তর্ভুক্ত মানুষের সংখ্যা আশাতীতভাবে বৃদ্ধি পাবে। কর ও পেনশনের একটি যৌক্তিক অনুপাত রাখা হলে অধিক কর প্রদানকারী অধিক হারে পেনশন পাবেন। তাতে কর ফাঁকি কমবে। নিয়োগকর্তারা চাকরিজীবীর নিজের তহবিল ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের তহবিল যুক্ত করে আকর্ষণীয় আনুতোষিক দেবেন।
পেনশন সম্পূর্ণভাবে আয়করব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাবে। যিনি যে হারে আয়কর দেবেন, তিনি সে আনুপাতিক হারে জাতীয় পেনশন পাওয়ার অধিকারী হবেন। এভাবে ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে দেশের কম হলেও ৫০-৬০ শতাংশ মানুষ করজালের অন্তর্ভুক্ত হবে এবং কর-রাজস্ব থেকে একটি শক্তিশালী পেনশন তহবিল গড়ে উঠবে। চালু হবে বৈষম্যহীন একটি একীভূত জাতীয় পেনশন-ব্যবস্থা।
● ড. তোফায়েল আহমেদ শিক্ষক ও শাসনবিষয়ক গবেষক