কে ফেরাবে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা

দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ফলপ্রসূ করার জন্য বিএনপিসহ সরকারের বিরোধী ও নিরপেক্ষ কিছু মহল থেকে মূলত একটি দাবিই জোরদার হয়ে উঠেছে। সেটি হলো সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন।

এ দাবির অনুগামী হয় আরও দুটি দাবি—১. নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার এবং ২. স্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন। এ দাবি জোরালো হওয়ার কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের অভিজ্ঞতা। বিএনপি একবার নির্বাচনে অংশ নিয়ে এবং আরেকবার নির্বাচন বর্জন করে দেখেছে, ফলাফল একই থেকেছে। বলা যায়, এখন বড় দুই দলের অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে।

১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি তুলে তা আদায় করে নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল। তবে পরে তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিল।

কিন্তু সেবার বিজয়ী বিএনপি সাম্প্রদায়িক নির্যাতন, গ্রেনেড হামলাসহ অনেক অপকর্মের পর মেয়াদ শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারটি নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী করার জন্য প্রধান বিচারপতির মেয়াদ দুই বছর বাড়ানোসহ নানা অপকৌশলের আশ্রয় নিয়েছিল। এর ফল হয়েছে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আবির্ভাব এবং তাদের দুই বছরের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপির ভরাডুবি ও মিত্রদেরসহ আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়। এরপর তারা সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান বাতিল করে দেয়।

এ ঘটনাবলির একটি সরল সমীকরণ হলো যে বড় দুই দল যেকোনোভাবে ক্ষমতা অর্জন করতে এবং তা ধরে রাখতে বদ্ধপরিকর। এরও সরল ব্যাখ্যা হলো, বড় দুই দল একে অপরকে আস্থায় নিতে পারে না। আমাদের গণতন্ত্রের সংকট ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পেছনে মূল কারণ এ অবিশ্বাস। এ অবিশ্বাসের শিকড় ইতিহাসের গর্ভে নিহিত, তার ভিত্তিতে হয়তো আদর্শের কথাও বলা যাবে।

১৯৭৫-এর হত্যাকাণ্ডে জিয়ার ভূমিকা কী ছিল, তা নিয়ে নানা কথা চালু আছে, তবে তাঁর রাজনৈতিক জীবনে এই খুনিদের প্রতি আনুকূল্য দেখাতে কার্পণ্য করেননি তিনি। তদুপরি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে রাজনীতি দাঁড় করাতে গিয়ে তিনি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী দল ও ব্যক্তিদের প্রতি আনুকূল্য দেখাতেও দ্বিধা করেনি। তা ছাড়া বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের যে চেতনা, স্লোগান এবং স্বাধীনতার পর যে সাংস্কৃতিক ধারায় দেশ পুনর্গঠনের কাজ চলার কথা ছিল, তাকেও পুনরায় পাকিস্তানের ধারায় ফেরানোর চেষ্টা হয়েছে।

ঘটনা কেবল এখানে থেমে থাকেনি, জিয়া-পরবর্তীকালে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ শেখ হাসিনার প্রাণনাশের একাধিক চেষ্টাসহ জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ও লালন হয়েছে। এসবের আইনি বিচার হওয়ার দরকার, তবে সেই সঙ্গে স্বাধীনতার পর থেকে ২০০৯ সালের নির্বাচন অবধি সেনাসমর্থিত সরকার পর্যন্ত কালের বিভিন্ন ঘটনার যুগপৎ ঐতিহাসিক গবেষণা ও বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া উচিত। তবে কথা হলো, তাতে যে তথ্য ও সত্য উদ্‌ঘাটিত হবে, সেগুলো কি বড় দুই দল মানবে? মানার সম্ভাবনা কম। দুই বড় দলের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার প্রেক্ষাপট ও অর্জন সম্পর্কে ন্যূনতম সমঝোতা ছাড়া স্বাধীন নির্বাচন কমিশনের স্বপ্ন সম্ভবত অধরাই থাকবে।

মানুষ ও সমাজকে রূপান্তরের অ্যাজেন্ডা বাদ দিয়ে যে রাজনীতি, তার হাতে গণতন্ত্র বা ন্যায়সংগত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। বর্তমান সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের প্রত্যাশা ছিল উন্নয়নের কাজের মতোই গুরুত্বসহকারে তারা শিক্ষার যথার্থ রূপান্তর এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার স্থান হিসেবে গড়ে তোলায় মনোযোগ দেবে।

যে উদার মানবতা ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন নিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে একটি রাজনীতির ধারা এ দেশে বরাবর চলমান। বাংলাদেশে একাত্তরের বিজয়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরাভূত হয়েছিল, কিন্তু পাকিস্তানি ভাবধারার পরাজয় ঘটেনি। কারণ, যুদ্ধ কারও মানস পরিবর্তনের কাজের চেয়ে ক্ষমতার উত্থান-পতনে বেশি ভূমিকা রাখে। তুলনামূলকভাবে আধুনিক অনেক মুসলিম রাষ্ট্রেও দেখা গেছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামি রক্ষণশীলেরাই ক্ষমতায় আসে। মিসর, আলজেরিয়ায় এমনকি কামাল পাশার বৈপ্লবিক সামাজিক পরিবর্তনের দেশ তুরস্কেও এমনটি ঘটেছে।

আমার ধারণা, বাংলাদেশে গত ৩০ বছরে ধর্মীয় রক্ষণশীল বিভিন্ন গোষ্ঠী সমাজে যেভাবে কাজ করেছে, তাতে পঞ্চাশ-ষাটের দশকে সূচিত আলোকায়নের ধারা স্তিমিত হয়ে গেছে। এ অবস্থায় রক্ষণশীলদের জন্য রাষ্ট্রক্ষমতা দখল আর খুব জরুরি বিষয় নয়। কারণ, তারা বিএনপিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে এবং আওয়ামী লীগে অত্যন্ত সার্থকভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। ফলে রাষ্ট্রক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে থাকলেও বিএনপি-আওয়ামী লীগসহ সমাজ চলে গেছে তাদের প্রভাবে। এটি একটি অভূতপূর্ব বাস্তবতা!

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এতটাই মজেছে যে তারা সাংস্কৃতিক চেতনায় প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমেছে এবং দলের রাজনৈতিক বিবেচনাও ইতিহাস ও আদর্শের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ থাকছে না। দৃশ্যমান পরিকাঠামো এবং বিভিন্ন আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য সাধুবাদ দিয়েও বলতে হবে, বর্তমানে এই দলের (সেই সঙ্গে দেশেরও) সাংস্কৃতিক ও মানবিক অবক্ষয় ভয়ানক পর্যায়ে নেমেছে। বিপর্যস্ত জাতি যেকোনো চরমপন্থার খপ্পরে পড়তে পারে।

আরও পড়ুন

মুশকিল হলো, ক্ষমতার রাজনীতির চাপান-উতোরের ফলে সমাজমানসের সুষ্ঠু বিকাশ ও রূপান্তর ঘটছে না। এ বাস্তবতায় সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনার সহিষ্ণু মানবিক সমাজ কি পাব? সেটা কি নির্বাচনবৃক্ষে ফলবে? অতি আশাবাদীর পক্ষেও তেমন আশায় বুক বাঁধা কঠিন।

গণতন্ত্রের স্বপ্ন দেখেছে মানুষ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকজুড়ে বাঙালির এই স্বপ্ন বিকশিত হয়েছে। তখন রাজনীতি ও সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে এগিয়েছিল। ফলে গণতান্ত্রিক রাজনীতি সেদিন বিরোধী পক্ষ হলেও তার ছিল জনভিত্তি এবং বর্ধিষ্ণু অবস্থা। এরই ফসল মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা। তাই স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে গণতন্ত্র অন্যতম মূলনীতি। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও সমাজ বিনির্মাণ ব্যাহত হয়েছে। এর মধ্যে পঁচাত্তরের ক্ষমতার পটপরিবর্তনের ফলে রাষ্ট্র ও সমাজের পশ্চাৎপদতা আরও জোরদার হয়েছে।

এরপর পুনর্গঠিত হওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগের প্রয়াস ছিল ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন। আওয়ামী লীগ কার্যকর শক্তিশালী অবস্থান নিয়ে ক্ষমতায় ফিরেছে ২০০৯ সালে। তত দিনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক নানা কারণে ধর্মীয় রক্ষণশীল ভাবধারার প্রসার ও প্রভাব রাজনীতিসহ সমাজ ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সর্বত্রই পড়েছে। ক্ষমতায় ফেরা ও টিকে থাকা এবং প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে দূরে রাখার জন্য আওয়ামী লীগ তার স্বাভাবিক মিত্রদের চেয়েও রাজনীতিতে এই বলীয়ান ধর্মীয় কট্টরপন্থী অংশকে গুরুত্বের সঙ্গে পাশে রেখেছে। সেভাবে তাদের বিরুদ্ধতা নিষ্ক্রিয় করেছে। অর্থাৎ ক্ষমতা থেকে এই শক্তির তোষণ অব্যাহত থাকল।

আওয়ামী লীগ সরকার অত্যন্ত ইতিবাচকভাবেই নানা উন্নয়নমূলক কাজ করেছে। কিন্তু শিক্ষা, ধর্মসহ সংস্কৃতি ও রাজনীতি—যে তিনের সমন্বয়ে মানুষের মানসজগতের উন্নতি ঘটে, তার দিকে নজর দেয়নি। এই তিন ক্ষেত্রেই বিভ্রান্তি, ভ্রান্তি ও ব্যক্তিগত লাভের লোভ বেড়ে গেছে। ফলে সমাজে এসবের চর্চা বাড়লেও অবক্ষয় ঠেকানো যাচ্ছে না। এসব ক্ষেত্রে খাঁটি কথা ও কাজের পরিবর্তে এখন মেকির জয়জয়কার।

আরও পড়ুন

আপস ও তোষণের যে রাজনীতি চলছে, তাতে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমার যেমন কারণ নেই; তেমনি শিক্ষায়, সংস্কৃতিতে ও উচ্চতর জ্ঞান, ভাবনা, সৃজনশীলতা ও মূল্যবোধচর্চারও প্রাসঙ্গিকতা তৈরি হবে না। উপার্জন বা আয়ু বা বাহ্য জৌলুশ যতই বাড়ুক সমাজে, প্রকৃত মানুষের আকাল ঠেকানো যাবে না।

মানুষ ও সমাজকে রূপান্তরের অ্যাজেন্ডা বাদ দিয়ে যে রাজনীতি, তার হাতে গণতন্ত্র বা ন্যায়সংগত মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। বর্তমান সরকারের কাছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষদের প্রত্যাশা ছিল উন্নয়নের কাজের মতোই গুরুত্বসহকারে তারা শিক্ষার যথার্থ রূপান্তর এবং উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার স্থান হিসেবে গড়ে তোলায় মনোযোগ দেবে। ধর্ম ও সংস্কৃতিচর্চায় উদার মানবতার পরিসর শক্তিশালী করা এবং সমাজে মুক্তচিন্তা ও সৃজনশীল কর্মের বাতাবরণ নিশ্চিত করাও ছিল তাদের কাছে প্রত্যাশা। এসব ক্ষেত্রে সঠিকভাবে কাজ হলে পরিস্থিতি এত জটিলভাবে কঠিন হতো না।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, যত মানুষ নির্বাচনব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়েছেন, তার চেয়ে বেশি মানুষ আস্থা হারিয়েছেন রাজনীতির ওপর। তাহলে কে ফেরাবে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা?

  • আবুল মোমেন কবি, প্রাবন্ধিক ও সাংবাদিক