২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

যুক্তরাষ্ট্র না চীন, এবারে কোন দিকে যাবে পাকিস্তান?

শাহবাজ শরিফ দ্বিতীয়বারের মতো পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেনছবি: রয়টার্স

৩ মার্চ পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ (পিএমএল-এন) শাহবাজ শরিফকে দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করে। পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচেয়ে বিতর্কিত এই নির্বাচনের পর তাঁকে একটি জোট সরকার গঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

বড় ধরনের কারচুপি, সেনা হস্তক্ষেপ ও বিলম্বিত ফল ঘোষণা—এসব অভিযোগে ৮ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন কালিমালিপ্ত হয়েছে। পাকিস্তানের ছককাটা যে গণতান্ত্রিক ইতিহাস, সেখানে জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে এ ধরনের অনিয়ম ও অভিযোগ নতুন নয়। কিন্তু এ নির্বাচনের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রায় সব কটি দলই পুরো নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

যা-ই হোক, নতুন সরকার দেশের ভেতরেই বিশাল রাজনৈতিক চাপে পড়তে চলেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নির্বাচনী প্রতীক কেড়ে নেওয়ার পর দলটির প্রার্থীরা স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন করতে বাধ্য হয়। জাতীয় সংসদে ৯৩টি আসন পেয়ে তাঁরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। সামনের দিনগুলোতে পার্লামেন্টের ভেতরে ও রাস্তায়—দুই জায়গাতেই পিটিআই গরম করে রাখবে।

ক্ষমতাসীন পিএমএল-এনের জোটসঙ্গী পাকিস্তান পিপলস পার্টি (পিপিপি) খুব হিসাবি সিদ্ধান্তে সরকারের কোনো পদ নেওয়া থেকে বিরত থেকেছে। সামনে যে কঠিন চ্যালেঞ্জ, তার দায় যাতে না নিতে হয়, সেই চিন্তা থেকে তাদের এ সিদ্ধান্ত।
নড়বড়ে অর্থনীতি, অভূতপূর্ব মুদ্রাস্ফীতি, নাজুক নিরাপত্তা—এ রকম অসংখ্য সমস্যায় জর্জরিত নতুন সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্রনীতিতে বাড়তি মনোযোগ সময় ব্যয় করা কঠিন।

পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে নতুন সরকারের সামনে অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি চ্যালেঞ্জ আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ চ্যালেঞ্জটি হলো পাকিস্তানের কৌশল ও নীতিগত সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা এবং যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বেড়ে যাওয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখা।

পার্লামেন্টে অভিষেক ভাষণে শাহবাজ শরিফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, পাকিস্তান কোনো পরাশক্তির খেলার ঘুঁটি হবে না। শরিফ বোঝাতে চেয়েছেন, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের চলমান ঠোকাঠুকিতে পাকিস্তান কোনো পক্ষের দিকেই যাবে না। কিন্তু বলা যত সহজ, করা ততটাই কঠিন। কেননা, বৈশ্বিক দুই পরাশক্তির বৈরিতার মধ্যে ভারসাম্যমূলক সম্পর্ক বজায় রাখার কৌশলী জায়গা দ্রুত সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে।

অর্থনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল যে চাহিদা, তা পূরণে চীনা সামরিক সহায়তা প্রয়োজন। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারত্ব আরও বিস্তৃত হওয়ায় পাকিস্তান তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য চীনকে দরকার পাকিস্তানের।

বিপদের বিষয়টি বেশ কয়েকবারই দৃশ্যপটে হাজির হয়েছে। বিশেষ করে পাকিস্তানে চীনের বিনিয়োগ প্রকল্প নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর (সিপিইসি) প্রকল্পটিকে চীনের পতাকাবাহী প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ বলে সমালোচনা করে আসছে যুক্তরাষ্ট্র।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে গিয়ে গত বছর উত্তেজনা চরমে উঠেছিল। সে সময়ে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ফোরাম অন ডেমোক্রেসি সম্মেলনে অংশগ্রহণের এক সপ্তাহের মধ্যে পাকিস্তান ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত মার্কিন প্রেসিডেন্টের ডেমোক্রেসি সম্মেলনে ভার্চ্যুয়াল মাধ্যমে অংশ নিয়েছিল।

পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ক্রমান্বয়ে নিম্নগামী। বিশেষ করে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তানকে দেওয়া অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দ্রুত নিম্নগামী হয়েছে। অগভীর ও লেনদেনমূলক দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বিষয়টি উপেক্ষা করলেও পাকিস্তানের পণ্য রপ্তানির সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।

এ কারণেই ওয়াশিংটনের সঙ্গে ইসলামাবাদের সম্পর্কের বৈষয়িক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের পরবর্তী ঋণের কিস্তি সময়মতো ছাড় করার ক্ষেত্রে এই সম্পর্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটে পাকিস্তানের নতুন সরকার ওয়াশিংটনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে উদ্‌গ্রীব।

পাকিস্তানে নির্বাচনের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ তুলতে বাইডেন প্রশাসনের আপাত যে অনীহা, সেটাকে পাকিস্তানে দেখা হচ্ছে, নতুন সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সহযোগিতার আগ্রহ প্রকাশের কৌশল হিসেবে। তবে পাকিস্তান-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও কিছুদিন আগের অবস্থানে থেকে যাবে।

কেননা, আগামী নভেম্বর মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। এ কারণে আগামী কয়েক মাস ওয়াশিংটনের নীতির বড় ধরনের বদল হবে বলে মনে করা যায় না। এই স্থিতাবস্থার সময়টা শরিফ সরকারের জন্য ভবিষ্যতের প্রস্তুতি নেওয়ার একটা সুযোগ।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মানে এই নয় যে চীনের সঙ্গে পাকিস্তান তাদের গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উপেক্ষা করতে পারবে।

আইএমএফের সঙ্গে পরবর্তী চুক্তি নিশ্চিত করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা পাকিস্তানের জন্য জরুরি। কিন্তু পাকিস্তানের ভঙ্গুর অর্থনীতি স্থিতিশীল অবস্থায় আনতে গেলে খুব শিগগির চীনের অর্থনৈতিক সহায়তা লাগবে। ]

পর্বতসমান উঁচু মূল্যস্ফীতি, তলানিতে ঠেকা বৈদেশিক মুদ্রার তহবিল এবং ২০২৬-এর শেষ নাগাদ মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ বাড়ানোর যে লক্ষ্যমাত্রা শরিফ সরকার নিয়েছে, তাতে চীনের আরও আর্থিক সহযোগিতা ও বিনিয়োগ পাকিস্তানের জন্য জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।

এ কারণেই অনেকে মনে করছেন, এবারের মেয়াদে শাহবাজ শরিফের প্রথম বিদেশ সফর হবে চীনে। যদিও বিরোধী দলে যখন তিনি ছিলেন, সে সময় পিটিআই সরকারের প্রতি তার তীব্র সমালোচনা ছিল, পাকিস্তানকে ধীরে ধীরে চীনের প্রকল্পের সঙ্গে বেঁধে ফেলা হচ্ছে। নতুন সরকার চীনের সেই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলেই মনে হয়। উপরি হিসাবে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনা বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে চাইবে পাকিস্তান।

অর্থনৈতিক সমর্থনের পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা খাতে বিপুল যে চাহিদা, তা পূরণে চীনা সামরিক সহায়তা প্রয়োজন। ভারত-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারত্ব আরও বিস্তৃত হওয়ায় পাকিস্তান তার নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার জন্য চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়াতে বাধ্য হচ্ছে। পশ্চিম দিকের প্রতিবেশী আফগানিস্তান ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখার জন্য চীনকে দরকার পাকিস্তানের।

পাকিস্তানের অনেকে এখনো এই তর্ক তোলেন যে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে পাকিস্তান এখনো সেতুবন্ধ হিসেবে ভূমিকা পালন করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের বৈরিতা যেভাবে গভীর হচ্ছে, তাতে ১৯৭১ সালে হেনরি কিসিঞ্জারের বেইজিং সফরের মধ্যস্থতা করতে পাকিস্তান যেভাবে সফল হয়েছিল, বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা করা অনেক বেশি কঠিন হয়ে পড়েছে।

সে সময়ে পাকিস্তান মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জারকে বেইজিংয়ে নিতে পেরেছিলেন, তার কারণ হলো সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের শীতল যুদ্ধ চলছিল। চীন যাতে সোভিয়েতের ঘনিষ্ঠ না হয়, সেটা ঠেকাতেই যুক্তরাষ্ট্র বেইজিংয়ের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করার পথ খুঁজছিল।

এ মুহূর্তে ইসলামাবাদের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত কোনো একটি পক্ষকে ক্ষুব্ধ না করে বিশ্বের দুই পরাশক্তির মধ্যে সম্পর্ক গভীর করে তোলা।

  • সিতারা নূর, হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বেলফের সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের সহযোগী

  • আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত