২০০১ সালের আগে আমি যখন ‘ব্রিক’ (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে গঠিত শব্দসংক্ষেপ) শব্দসংক্ষেপটি তৈরি করেছিলাম, তখন যে বিষয়টি আমি গোড়াতেই মাথায় রেখেছিলাম, সেটি হলো বিশ্বের বৃহত্তম উদীয়মান অর্থনীতিগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার ক্ষেত্রে বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হবে।
উদীয়মান অর্থনীতির তালিকায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীন শুধু যে শীর্ষ অবস্থানে ছিল তা নয়, সম্মিলিতভাবে এই দেশগুলোর ওপর বিশ্বের প্রায় অর্ধেক মানুষের শাসনভার ছিল। সে কারণে এই সংগঠনটিকে যথাযথভাবে এই অর্ধেক বিশ্ববাসীর প্রতিনিধিত্ব করা উচিত।
দুই দশক ধরে কেউ কেউ আমার প্রাথমিক গবেষণাপত্রকে ভুলভাবে একধরনের বিনিয়োগ তত্ত্ব বলে ঠাওরেছেন; কেউ কেউ আবার এটিকে রাজনৈতিক গোষ্ঠী হিসেবে ব্রিকসের (শুরুতে সংগঠনটির নাম ‘ব্রিক’ ছিল; ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা যুক্ত হওয়ার পর সাউথ আফ্রিকার ‘এস’ আদ্যক্ষরটি যুক্ত হয় এবং তার নাম হয় ‘ব্রিকস’) অনুমোদন হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
কিন্তু এ ধরনের কোনো কিছুই আমার মাথায় ছিল না। বরং আমার ভূমিকা ছিল উল্টো। ২০০৯ সালে যখন ব্রাজিল ও রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা ব্রিক নামের একটি আনুষ্ঠানিক রাজনৈতিক গোষ্ঠীর ধারণা প্রস্তাব করছিলেন, তখন আমি এই সংগঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলাম।
এখন যেহেতু ব্রিকস ঘোষণা করেছে তারা আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত—এই ছয় দেশকে যুক্ত করবে, সেহেতু আমি আবারও প্রশ্নটি তুলছি। সদস্য বাড়ানোর সিদ্ধান্তটি যে কী উদ্দেশে্য নেওয়া হয়েছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়, তবে তাদের উদ্দেশ্য যে অনেক কম অর্থনৈতিক, তাতে সন্দেহ নেই।
একইভাবে যদি ব্রিকসভুক্ত কোনো দেশ, বিশেষ করে চীন ও ভারত সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক সংস্কার করে, তাহলে তাদের মুদ্রাও প্রায় নিশ্চিতভাবে আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারা যদি ডলারের বিষয়ে অভিযোগ করার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে এবং ব্রিকসের মধ্যে অভিন্ন একটি মুদ্রা চালু করার বিষয়ে স্পষ্ট চিন্তার বদলে এলোমেলোভাবে চিন্তা করে, তাহলে তাদের খুব বেশি কিছু অর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
প্রশ্ন হচ্ছে কেন ইন্দোনেশিয়াকে নেওয়া হলো না? কেন আর্জেন্টিনাকে নেওয়া হলো কিন্তু মেক্সিকোকে ডাকা হলো না? কেন ইথিওপিয়াকে ডাকা হলো কিন্তু নাইজেরিয়াকে নয়?
এটি স্পষ্ট যে এই সদস্যসংখ্যা বাড়ায় ব্রিকসের প্রতীকী ক্ষমতা বাড়বে। গ্রুপটি বৃহত্তর বৈশ্বিক দক্ষিণের (গ্লোবাল সাউথ) মনে এই সন্দেহের টোকা দিতে পেরেছে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ–পরবর্তী বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থা একচেটিয়াভাবে পশ্চিমা। ব্রিকস মাঝেমধ্যে নিজেকে উদীয়মান এবং উন্নয়নশীল বিশ্বের এমন একটি কণ্ঠস্বর হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরেছে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য উন্নত অর্থনীতির খবরদারির জায়গা নেই।
ব্রিকস ইতিমধ্যে সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছে, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর কাঠামো গত ৩০ বছরে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন ঘটাতে পারেনি, কিন্তু তারা সেই পরিবর্তনের সূচনা ঘটাতে পেরেছে। এটি সত্য যে ক্রয়ক্ষমতার মর্যাদার দিক থেকে জি-৭ এর চেয়ে ব্রিকস সামান্য একটু এগিয়ে আছে। কিন্তু মার্কিন ডলারের তুলনায় যেহেতু ওই দেশগুলোর মুদ্রার মান অনেক কম, সেহেতু ব্রিকস বৃহৎ অর্থনীতির প্রতিপক্ষের (জি–৭) তুলনায় উল্লেখযোগ্যভাবে ছোট হয়ে আছে।
এটিও সত্য যে চীন নিজেকে বেশ দৃঢ়ভাবে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি হিসেবে দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। সাধারণভাবে চীনের জিডিপি জাপান ও জার্মানির চেয়ে তিন গুণ বেশি এবং দেশটির অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির প্রায় ৭৫ শতাংশের সমান। অন্যদিকে, ভারতও বেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাচ্ছে এবং এই দশকের শেষ নাগাদ তারা বিশ্বের তৃতীয় বৃহৎ অর্থনীতি হতে চাইছে। কিন্তু প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিক থেকে ব্রিকসের বাকি সদস্যদের কেউই চীন ও ভারতের ধারেকাছে নেই। ২০০১ সালে বৈশ্বিক জিডিপিতে ব্রাজিল ও রাশিয়ার যতটুকু অবদান ছিল, সেখানেই তারা পড়ে আছে। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকাও আফ্রিকা মহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনীতি নয় (নাইজেরিয়া তাকে ছাড়িয়ে গেছে)।
অবশ্যই জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর অনেকেই সেই একই নৌকার যাত্রী হয়ে আছে। ইতালি ও জাপান অনেক বছর ধরেই প্রবৃদ্ধি অর্জনে একই তালে চলছে। এমনকি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার ক্ষেত্রে খোদ যুক্তরাজ্যকে রীতিমতো সংগ্রাম করতে হচ্ছে।
চীন যেমন ব্রিকসের বাকি সদস্যদের সম্মিলিত অর্থনীতির দ্বিগুণ অর্থনীতি নিয়ে গ্রুপটিতে খবরদারি করছে; ঠিক একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রও জি-৭ গ্রুপের বাকি সদস্যদের সবার সম্মিলিত অর্থনীতির চেয়ে বড় অর্থনীতি নিয়ে সেখানে আধিপত্য ধরে রেখেছে। আমেরিকা ও চীন তাদের নিজ নিজ গোষ্ঠীর ওপর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এখন বেশি আধিপত্য বিস্তার করেছে।
এই সামগ্রিক গতিবিধি ও অর্থনৈতিক সক্রিয়তা যা নির্দেশ করে, তা হলো না জি-৭, না ব্রিকস—এদের কেউই এককভাবে আজকের বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খুব একটা অর্থবহন করে না। এদের কেউই অপরের প্রত্যক্ষ ও সমান সম্পৃক্ততা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারবে না। সে কারণে বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য আসলে যেটি দরকার, তা হলো জি-২০-এর (এই সংগঠনে জি-৭ এবং ব্রিকসের প্রধান সব দেশই আছে) সত্যিকারের পুনরুত্থান। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন, মহামারি প্রতিরোধ—ইত্যাদির মতো সত্যিকারের বৈশ্বিক সমস্যা মোকাবিলার জন্য এটিই সবচেয়ে বেশি কার্যকর ফোরাম।
যদিও জি-২০ বর্তমানে বেশ কিছু বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, তথাপি এটি এখনো চাইলে ২০০৮-২০১০ চেতনায় ফিরতে পারে, যে চেতনায় ভর করে তারা বৈশ্বিক আর্থিক সংকট মোকাবিলায় সবাই এক হয়েছিল। সেই চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হতে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে কিছু ছাড় দিয়ে নিজেদের মতপার্থক্য দূর করতে হবে এবং জি-২০ সংগঠনটিকে তার কেন্দ্রীয় অবস্থানে ফিরতে দিতে হবে। তবে ব্রিকসও অধিকতর কার্যকর হতে পারবে যদি এর প্রধান সদস্যরা অভিন্ন লক্ষ্য অর্জনে সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হয়। কিন্তু কথা হলো, খুব কম বিষয়ই আছে যাতে চীন ও ভারত একমত হতে পারবে। তাদের বর্তমান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, তাদের কেউই একে অন্যের প্রভাব অর্জনের ব্যাপারে উৎসাহী হবে, এমন সম্ভাবনা নেই।
বলা হচ্ছে, যদি চীন ও ভারত তাদের সীমান্ত বিরোধ সমাধান করতে পারে এবং নিজেদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারে, তাহলে উভয় দেশই বিশ্ববাণিজ্য, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মতো খাতে লাভবান হবে। চীন ও ভারত অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক গড়তে পারে, যা ব্রিকস এবং বৈশ্বিক দক্ষিণজুড়ে অন্যান্য অনেক দেশকে প্রভাবিত করবে।
এ মুহূর্তে একটি বড় সমস্যা হলো মার্কিন ডলারের আধিপত্য। মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের মুদ্রানীতি ধরে ডলারের ওপর বিশ্বব্যাপী মাত্রাতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়াটা ‘স্বাস্থ্যকর’ নয়। ইউরোজোনের সদস্যরাষ্ট্রগুলো যদি তাদের আর্থিক খাতগুলোকে বাকি বিশ্বের জন্য সহজগম্য করে তুলতে পারত, তাহলে ইউরোর প্রবর্তন ডলারের আধিপত্যের রাশ টেনে ধরতে পারত।
একইভাবে যদি ব্রিকসভুক্ত কোনো দেশ, বিশেষ করে চীন ও ভারত সেই লক্ষ্য অর্জনের জন্য উল্লেখযোগ্য আর্থিক সংস্কার করে, তাহলে তাদের মুদ্রাও প্রায় নিশ্চিতভাবে আরও ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু তারা যদি ডলারের বিষয়ে অভিযোগ করার মধ্যেই নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখে এবং ব্রিকসের মধ্যে অভিন্ন একটি মুদ্রা চালু করার বিষয়ে স্পষ্ট চিন্তার বদলে এলোমেলোভাবে চিন্তা করে, তাহলে তাদের খুব বেশি কিছু অর্জনের কোনো সম্ভাবনা নেই।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্য সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী