দিল্লিতে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে জি-২০ সম্মেলন করার পর ভারত সরকার প্রশংসায় ভাসছিল। তার সপ্তাহ কয়েক আগে সফল চন্দ্রাভিযান নিয়ে দেশটির লোকজন বেশ গৌরব প্রকাশ করছিল।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, প্রযুক্তিগত উৎকর্ষ ও কূটনৈতিক সক্ষমতা দেখানোর মধ্য দিয়ে ভারত পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলোর যথার্থ অংশীদার হয়ে উঠেছে। কিন্তু কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত সপ্তাহে কানাডীয় শিখ নেতা হত্যার পেছনে ভারতীয় এজেন্টদের হাত থাকতে পারে বলে অভিযোগ করার পর ভারতসংক্রান্ত সেই ধারণাটি ভেঙে গেছে বলে মনে হচ্ছে।
ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী খালিস্তানি আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হরদ্বীপ সিং নিজ্জরকে গত জুনে গুলি করে হত্যা করা হয়। পশ্চিমের অনেকে বলছেন, ট্রুডোর অভিযোগ সত্য হলে ভারতের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। কিন্তু এ নিয়ে ভারতকে মোটেও চিন্তিত মনে হচ্ছে না। ভারত ইতিমধ্যেই কানাডার কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে। তারা কানাডায় বসবাসকারী নাগরিকদের জন্য ভ্রমণ পরামর্শ জারি করেছে।
অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার নিজের মর্যাদা অনুযায়ী মূল্যায়ন আশা করছে। ভারত মনে করছে, যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তার যে ধরনের গুরুত্ব আছে, তাতে নিজ্জর হত্যা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে খুব বড় ধরনের কোনো প্রতিক্রিয়া আসবে না। যেহেতু আমেরিকার এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলবিষয়ক নীতিতে ভারত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ; যেহেতু দিল্লির সহযোগিতা ছাড়া এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সুবিধা করে ওঠা সম্ভব হবে না, সেহেতু ভারত ধরে নিয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় অন্যান্য দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যে আচরণ করে থাকে, ভারতের সঙ্গে তারা তা করতে পারবে না।
এই আত্মবিশ্বাস ভারতকে ইসরায়েলের নীতির পথে নিয়ে যেতে পারে। ইসরায়েল যেমন কৌশলগত কারণে বিদেশের মাটিতে থাকা ইসরায়েলবিরোধী লোকজনকে গোপনে হত্যা করা কিংবা নিজ ভূখণ্ডের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করাকে অন্যায্য বলে ভাবে না, ভারতও তেমন নীতি নিয়ে থাকতে পারে।
কানাডার সঙ্গে ভারতের বিবাদ লেগেছে মূলত খালিস্তান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। এই আন্দোলনকারীরা শিখদের জন্য পাঞ্জাবে আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করতে চান। ভারত খালিস্তান আন্দোলনকে নিজের আঞ্চলিক অখণ্ডতার জন্য হুমকি মনে করে।
ভারতের অভিযোগ, কানাডা তার ভূখণ্ডে খালিস্তানি উগ্রপন্থীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। একটি স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্র গঠনে গণভোট আয়োজনের জন্য নিজ্জর কাজ করছিলেন বলে জানা যাচ্ছে। ভারতের কাছে তিনি নেহাতই একজন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতা ছিলেন না, একজন অভিযুক্ত সন্ত্রাসীও ছিলেন। ২০০৭ সালে পাঞ্জাবের সিনেমা হলে বোমা হামলাসহ একাধিক হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে ভারত সরকার তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করেছিল।
নয়াদিল্লি অনেক দিন ধরেই অটোয়ার বিরুদ্ধে তার নিরাপত্তা উদ্বেগকে উপেক্ষা করার অভিযোগ করে আসছে। ১৯৮৫ সালে কানাডা থেকে ছেড়ে আসা একটি এয়ার ইন্ডিয়া ফ্লাইটে শিখ উগ্রপন্থীরা বোমা হামলা চালিয়েছিল। ওই হামলায় বিমানে থাকা ৩২৩ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। ওই যাত্রীদের অধিকাংশই ছিলেন ভারতীয় বংশোদ্ভূত কানাডীয় নাগরিক। সেই মামলায় বেশ কয়েকজন গ্রেপ্তার হলেও মাত্র একজন দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন। তিনিও পরে মুক্ত হন।
নরেন্দ্র মোদির সরকার দৃশ্যত বিশ্বকে এই বার্তা দিতে চাইছে, ভারত তার নিরাপত্তা ইস্যুতে যেকোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পিছপা হবে না।
রাজনৈতিক কারণে কানাডায় বসবাসরত শিখদের সমর্থন ট্রুডোর দরকার। সে কারণে তিনি নিজ্জর ইস্যুতে শিখদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। আবার একই সঙ্গে তাঁর পদক্ষেপ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সামনে এনেছে। সেটি হলো পশ্চিমারা তাদের মিত্রদেশগুলোকে তাদের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ উদ্ধারে কতটুকু সহিংস হতে দেবে? শুধু যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র ভারতকে সন্তুষ্ট করতে গিয়ে কানাডার আইন ও শাসন কি বলির পাঁঠা হবে?
এই পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ওপর, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ওপর প্রচণ্ড চাপ তৈরি করেছে। সদ্যসমাপ্ত জি-২০ সম্মেলনে বাইডেন মোদির প্রশংসা করেছেন। সে কারণে নিজ্জর ইস্যুতে তিনি ভারতের বিরুদ্ধে কড়া বার্তা দিতে পারছেন না। অন্যদিকে কানাডা যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র। ভারত ইতিপূর্বে পাকিস্তান থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলায় পশ্চিমের সহানুভূতি পেয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা সমাজে মিশে যাওয়া শিখ সম্প্রদায়ের প্রতি ভারতের আক্রমণকে তারা অতটা সহজভাবে নেবে বলে মনে হয় না।
২০০৬ সালে ব্রিটেনের মাটিতে আলোকসান্দর লিতভিনেনকোকে গুপ্তহত্যা করার পর রাশিয়ার ওপর এবং ২০১৮ সালে তুরস্কের মাটিতে জামাল খাসোগিকে হত্যার পর সৌদি আরবের ওপর পশ্চিমারা যতটা চাপ দিয়েছিল, নিজ্জর হত্যাকাণ্ডে ভারত হয়তো ততটা চাপের মুখে পড়বে না। এটিই দেশটিকে ইসরায়েলের অনুসৃত কুটিল পথে ঠেলে দিতে পারে।
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
● আয়েশা সিদ্দিকা লেখক ও লন্ডনের কিংস কলেজের ডিপার্টমেন্ট অব ওয়ার স্টাডিজের একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো