দেশে জ্বালানি তেলের দাম এক রাতের মধ্যেই ৪০ থেকে ৫০ ভাগ বেড়ে গিয়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির যুক্তি হিসেবে সরকারপক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, পুরো পৃথিবীতেই দাম বেড়েছে। আবার অনেকে দেখছি আমেরিকা, কানাডা, জার্মানি, ইংল্যান্ড কিংবা ইউরোপের দেশগুলোর দামের সঙ্গে বাংলাদেশের জ্বালানি তেলের দামের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করছেন।
এটি বলার অপেক্ষা রাখে না, পুরো পৃথিবীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতি খুব একটা ভালো অবস্থায় নেই। এই তো দিন দুয়েক আগে ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের গভর্নর দেশটির মানুষকে সাবধান হতে বলেছেন এই বলে—‘আগামী দুই বছর ইংল্যান্ডের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’ তিনি সেই অর্থে কোনো আশার কথা শোনাতে পারেননি। তাঁকে যখন জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, ‘কেন এমন হচ্ছে?’ তিনি করোনা পরিস্থিতি এবং এরপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে এই অবস্থার জন্য দায়ী করেছেন। তিনি এও বলেন, ‘সমস্যাটি শুধু ইংল্যান্ডের নয়; এটি বৈশ্বিক সমস্যা।’ তিনি দেশটির মধ্যবিত্ত এবং নিম্নবিত্ত শ্রেণিকে সাবধান করে বলেন, ‘সামনে বিপদ। তাই সতর্ক হয়ে চলতে হবে।’
পুরো পৃথিবীই আসলে একটি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। সরকার যখন দেশজুড়ে লোডশেডিংয়ের সিদ্ধান্ত নিল; দেশের মানুষ কিন্তু কষ্ট হবে জেনেও এক রকম মেনেই নিয়েছে। কেন নিয়েছে? কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে পুরো পৃথিবীর প্রেক্ষাপটে সমস্যাটা আমাদের কাছেও চলে এসেছে। কিন্তু এক রাতের মধ্যে ৫০ ভাগ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর দেশের মানুষকে এর সমালোচনা করতে দেখা যাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কেন এই সমালোচনা?
প্রথম বিষয় হচ্ছে—একবারে কেন এই পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করতে হবে? কেন এটি ধাপে ধাপে করা গেল না? মানুষের বেতন কি বেড়েছে? তাহলে এই দাম বাড়ার পর সব রকম জিনিসপত্রের যে দাম বাড়বে; সেটি সাধারণ মানুষ কী করে সামলাবে? কেন আপনাদের মনে হলো এক রাতের মধ্যে এই পরিমাণ মূল্যবৃদ্ধি করাই যায়?
সিঙ্গাপুর-কানাডায় একজন মানুষকে কি সারা দিন কাজ করার পর পেট চালানোর চিন্তা করতে হয়? তারা তো ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করে। রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার চিন্তা করে। সপ্তাহান্তে সিনেমাও দেখতে যায়। আর আমাদের এই কলা বিক্রেতাকে চিন্তা করতে হচ্ছে পেট চালানোর কথা! এই যে আপনারা এক রাতের মধ্যেই দাম বাড়িয়ে দিলেন। এখন এই কলা বিক্রেতার মতো মানুষগুলোকে আপনারা কী জবাব দেবেন?
দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে—মূল্যবৃদ্ধির পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করতে গিয়ে অনেকেই আমেরিকা, ইংল্যান্ড কিংবা ইউরোপের দেশগুলোর উদাহরণ দিচ্ছেন। এই উদাহরণ কী আদৌ যৌক্তিক? আমি বরং একটা উদাহরণ দেওয়ার চেষ্টা করি। এবার দেশে গিয়ে আমার এক কলা বিক্রেতা ভদ্রলোকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। প্রায় ৬০ বছর ছুঁই ছুঁই এই ভদ্রলোক আমার মা বেঁচে থাকতেও আমাদের ঢাকার বাসায় কলা দিয়ে যেতেন। তিনি আমাদের নাখালপাড়ার অলি-গলিতে ‘এই কলা রাখবেন, কলা’ বলে বলে কলা ফেরি করেন। সেই ছোটবেলা থেকেই আমি তাঁকে দেখে এসেছি। আমার মা পৃথিবী ছেড়ে অন্য ভুবনের বাসিন্দা হয়েছেন অনেক বছর হতে চলেছে। তবে আমার ছোট বোন এখনো ওনার কাছ থেকেই কলা রাখেন। তো, কলা বিক্রেতার সঙ্গে এত বছর পর দেখা। তাঁকে আমি জিজ্ঞাসা করলাম—‘আপনি এখনো কলা-ই ফেরি করেন? এটা করে আপনার চলে?’ উত্তরে তিনি বলেন, ‘জীবনভর তো এটাই করেছি। আর তো কিছু পারিও না। আগে তো কোনো রকম চলে গেছে। কিন্তু এখন আর কলা বিক্রি করে পেট চলে না।’
এই কলা বিক্রেতা কিন্তু সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করেন। অনেক সময় রাতেও ফেরি করেন। এরপরও তিনি বলেন, তাঁর পেট চলে না। এই যে আপনারা জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির পর ইউরোপ-আমেরিকার উদাহরণ দিচ্ছেন। ইউরোপ-আমেরিকায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কাজ করে কাউকে কি পেট চালানোর চিন্তা করতে হয়? সেখানে কি কাউকে চিন্তা করতে হয় পরের বেলায় খেতে পারব কি না? সেখানে তো হোটেল-রেস্তোরাঁয় কিংবা সুইপারের কাজ করেও দিব্যি তিন বেলা খেয়ে পড়ে মাঝেমধ্যে সিনেমা দেখার চিন্তাও করা যায়। দেশের এই কলা বিক্রেতা কি আদৌ এই চিন্তা করতে পারবেন? তাহলে কেন আপনারা এই উদাহরণ টেনে আনছেন?
জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে এক রাতের মধ্যেই। এতে আপনারা হয়তো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের যুক্তি তুলে ধরতে পারেন। তুলে ধরতে পারেন বৈশ্বিক পরিস্থিতির কথা। আরও অনেক যুক্তিও হয়তো তুলে ধরতে পারেন। কিন্তু কলা বিক্রেতা এই মানুষটাকে গিয়ে আপনি কি বলবেন? যাঁর হয়তো এখন এক বেলা খাবার জোগাড় করতেই কষ্ট হয়ে যাবে। সে হয়তো তাঁর একজীবনে ইউক্রেনের নামই শুনেননি। শুনেননি পি কে হালদারের নামও। যে কিনা দেশের হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছেন! তাঁর পরিবারের কাউকে অবশ্য এই পরিস্থিতিতে খাবার জোগাড় করার চিন্তা করতে হচ্ছে না। জানে না কানাডার বেগম পাড়ার খবরও। সে কেবল নিজের বেগম (স্ত্রী) এবং সন্তানদের নিয়ে তিন বেলা খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকতে চান। তাঁর আয় কি এক রাতের মধ্যেই ৫০ ভাগ বেড়ে গিয়েছে? তাহলে সে চলবে কী করে?
এই কলা বিক্রেতা কিন্তু বেকার নয় যে আপনি গিয়ে বলবেন—সে তো কোনো কাজ করে না! এই কলা বিক্রেতা কোনো ভবঘুরে নয় যে তাঁকে গিয়ে বলবেন—তুমি কাজ করার চেষ্টা করো না কেন? এই কলা বিক্রেতা খুব অল্প সময় কাজ করেন, তা-ও কিন্তু নয়। সে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ফেরি করে বেড়ান। তাহলে তাঁকে কেন পরের বেলার খাবারের চিন্তা করতে হবে? কেন তাঁকে পেট চালানোর চিন্তা করতে হবে? আপনারা তো দেশকে সিঙ্গাপুর-কানাডার সঙ্গে তুলনা অতীতেও করেছেন। আর এখন করছেন তেলের দামের সঙ্গে। সিঙ্গাপুর-কানাডায় একজন মানুষকে কি সারা দিন কাজ করার পর পেট চালানোর চিন্তা করতে হয়? তারা তো ঘুরতে যাওয়ার চিন্তা করে। রেস্তোরাঁয় খেতে যাওয়ার চিন্তা করে। সপ্তাহান্তে সিনেমাও দেখতে যায়। আর আমাদের এই কলা বিক্রেতাকে চিন্তা করতে হচ্ছে পেট চালানোর কথা! এই যে আপনারা এক রাতের মধ্যেই দাম বাড়িয়ে দিলেন। এখন এই কলা বিক্রেতার মতো মানুষগুলোকে আপনারা কী জবাব দেবেন?
ড. আমিনুল ইসলাম সিনিয়র লেকচারার। এস্তনিয়ান এন্টারপ্রেনরশিপ ইউনিভার্সিটি।
[email protected]