একটি সংবাদপত্রে খবরটি পড়ছিলাম। এক ভদ্রমহিলা একটি সুপারশপে নিয়মিত কেনাকাটা করেন। তিনি ওই সুপারশপের ‘লয়ালটি মেম্বার’। তো সেদিনও গেছেন কেনাকাটা করতে। সব জিনিসপত্র, তাঁর যা যা প্রয়োজন, কেনাকাটা করেছেন। সাকল্যে তাঁর বিল হয়েছে ৯ হাজার টাকা। এখন এসব মালপত্র ব্যাগে ঢোকাতে হবে। যখন তাঁকে জুট বা পাটের ব্যাগের জন্য আরও ১৪ টাকা দিতে বলা হলো, তিনি উত্তেজিত হয়ে ওঠেন । কোনোভাবেই এই ১৪ টাকা দিতে সম্মত নন তিনি। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এটা ক্রেতাদের পকেট কাটার আরেকটি নতুন ব্যবস্থা।’
ছুটে এলেন আউটলেটের ম্যানেজার সাহেব। ভদ্রমহিলাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তাঁর ওই এক কথা, ‘এত দিন তো প্লাস্টিকের ব্যাগে সদাইপাতি দেওয়া হয়েছে। বাড়তি টাকা চাওয়া হয়নি। এখন তবে কেন পাটের ব্যাগের নাম করে বাড়তি ১৪ টাকা চাওয়া হচ্ছে?’ শেষমেষ তিনি মালপত্র রেখেই চলে গেলেন।
বিষয়টি দাঁড়াল, ভদ্রমহিলা একবারে ৯ হাজার টাকার গ্রোসারি আইটেম কেনাকাটা করতে পারলেন, কিন্তু তিনি পরিবেশসম্মত পাটের ব্যাগের জন্য ১৪টি টাকা খরচা করলেন না।
গত ১ অক্টোবর থেকে অন্তবর্তী সরকার সারা দেশের সব সুপারশপে পলিথিন ও পলিপ্রোপিলিনের শপিং ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। পরিবর্তে সুপারশপগুলো পাটের ব্যাগ বা কাপড়ের ব্যাগ ব্যবহারে ক্রেতাদের উৎসাহিত করতে অনুরোধ করা হয়েছে। এরপর ১ নভেম্বর থেকে সারা দেশে কাঁচাবাজারেও পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। পলিথিনবিরোধী অভিযানও শুরু হয়েছে।
সম্প্রতি পুরান ঢাকায় পলিথিন কারখানায় অভিযানে গিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের দল।
পলিথিন পরিবেশ দূষণের বড় কারণ। তা ছাড়া আমাদের শহরে একটু বৃষ্টিতেই যে জলাবদ্ধতা হয়, এর অন্যতম কারণ পলিথিন। পলিথিনের কারণে পানির প্রবাহ ও নিষ্কাশনব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়। তাই পলিথিন নিষিদ্ধ করে সরকার উত্তম কাজ করেছে, এটা প্রাথমিকভাবে বলাই যায়।
এটা ঠিক, অনেক দেশেই পলিথিনের ব্যবহার আছে, এমনকি অনেক উন্নত দেশেও আছে। কিন্তু সেই তথ্য হাজির করে আমাদের দেশে পলিথিন ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দেওয়া যায় না। কারণ, আমরা নিজেদের এতটাই ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলেছি যে, কিছুটা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে চলছে না।
বাংলাদেশে আজ থেকে ২২ বছর আগে, ২০০২ সালে ১ মার্চ আইন করে বিষাক্ত পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। তবে দেশে পলিথিনের ব্যবহার কমেনি; বরং গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বাড়তে দেখা গেছে।
এরপর সরকার ২০১০ সালে আরেকটি আইন করে। কিন্তু এই আইনও বাস্তবে কোনো কাজ দেয়নি। প্রকৃতপক্ষে আমরা এতটা শিক্ষিত বা সচেতন নই যে সরকার একটি আইন করে দেবে, আর আমরা নাগরিকেরা সুড়সুড় করে তা মেনে নেব।
২.
লেখাটি কেবল বাজারের ব্যাগ হিসেবে পলিথিন ব্যবহারে আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস, আর অন্তবর্তী সরকারের নীতির প্রতি আমাদের চিন্তা ও ধারণার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চাচ্ছি।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশবিরোধী পলিথিনের ব্যাগের ব্যবহার আগে থেকেই নিষিদ্ধ ছিল। বলা যেতে পারে, অন্তবর্তী সরকার সে নিষেধাজ্ঞাটা নতুন করে জানান দিয়েছে।
বিশেষ করে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এ বিষয়ে খুবই আন্তরিক ও উদ্যোগী। তিনি প্রতিনিয়ত কথা বলে চলেছেন, মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছেন। যদিও মানুষ কতটা সচেতন হচ্ছে, তা একটা প্রশ্ন বটে।
সরকারের নীতিমালার পর সুপারশপে পরিবেশসম্মত ব্যাগের ব্যবহার নিয়ে কী চলছে, আর এ ব্যাপারে সাধারণ ভোক্তাদের ভাবনাটা কী ও কেমন, গত দুই সপ্তাহে তা জানার চেষ্টা করলাম। সেই জায়গা থেকেই এই লেখার অবতারণা।
কোনো কোনো সুপারশপে জুট ব্যাগ ও পেপার ব্যাগের আকার অনুযায়ী দাম ৬ থেকে ১৪ টাকা নেওয়া হচ্ছে। অনেকেই সরকারের নতুন এই নীতি সম্পর্কে অবগত নন। তাঁরা কেউ ব্যাগের টাকা দিতে রাজি হচ্ছেন, আবার কেউ হচ্ছেন না। অনেক ক্ষেত্রে আউটলেট ম্যানেজারকে দুটো বাড়তি কথা খরচ করতে হচ্ছে তাঁদের বোঝাতে।
আবার কোনো কোনো ক্রেতা আছেন, যাঁরা কোনোভাবেই জুটের ব্যাগ নেবেন না। মানে, তাঁরা ব্যাগের জন্য কোনো বাড়তি টাকা দেবেন না। সুপারশপ কর্তৃপক্ষ তখন তাদের আউটলেটে জমে থাকা কাটুন কিংবা নেটের ব্যাগ অফার করছে।
এতে কোনো পয়সা দিতে হচ্ছে না বটে, তবে গ্রোসারি আইটেম নেওয়ার জন্য এসব কাটুন উপযুক্ত বিকল্প নয়।
কোনো কোনো সুপারশপ ফ্রোজেন আইটেম নেওয়ার জন্য বাদামি রঙের কাগজের ব্যাগ দিচ্ছে। একজন ক্রেতা যদি বাজার করার পর সুপারশপ থেকে সরাসরি বাসায় যান এবং বাসা যদি নিকটবর্তী হয়, তাহলে এসব ব্যাগ চলতে পারে। কিন্তু ক্রেতা যদি কোথাও বিরতি নেন, অর্থাৎ ফ্রোজেন আইটেম সুপারশপ থেকে আনার পর বাসায় রেফ্রিজারেটরে রাখতে বিলম্ব হয়, তবে ওইসব ব্যাগ নাও টিকতে পারে।
আমাদের সাধারণ মুদিদোকান থেকে সুপারশপে পণ্যের দাম একটু বেশি। কারণ, তাঁদের অতিরিক্ত ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করতে হয়। তারপরও মধ্যবিত্তরা, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্তদের অনেকেই সুপারশপে কেনাকাটা করতে পছন্দ করেন। কারণ, এখানে ঝুটঝামেলা, হইচই কম।
সে ক্ষেত্রে আমাদের সুপারশপগুলো একটা কাজ করতে পারে। ধরা যাক, একজন ক্রেতা একবারে পাঁচ হাজার বা এর বেশি টাকার কেনাকাটা করলেন। সে ক্ষেত্রে তাঁকে একটা জুটের ব্যাগ ফ্রি দিতে পারেন। তবে কেউ যদি ১০০ টাকা দিয়ে একটা জুস কিনে ফ্রি ব্যাগ চান, সেটা অবশ্য সুপারশপ দিতে পারবে না।
অনেক সুপারশপে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ পলিপ্রোপিলিনের ব্যাগ মজুত আছে। কোনো ক্রেতা পাটের ব্যাগ নিতে রাজি না হলে তাদের এসব ব্যাগ দেওয়া হচ্ছে। আবার কোনো কোনো সুপারশপ সরকারের নীতি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত নয়, অথবা অবগত হতে চায় না, কিংবা জেনেবুঝে উদাসীন। তারা এখনো পলিথিনের ব্যাগ ব্যবহার করে চলেছে।
তবে আশার কথা হলো, কিছু সুপারশপ সরকারের পরিবেশবান্ধব এই নীতি কঠোরভাবে মেনে চলছে। তারা একেবারেই প্লাস্টিক ব্যবহার করছে না। এদের কেউ কেউ গ্রাহকদের বেশ টেকসই জুটের ব্যাগ দিচ্ছে, যেগুলোর দাম একটু বেশি।
আমার ব্যক্তিগত মত হলো, বাসা থেকে ব্যাগ নিয়ে সুপারশপে যাওয়া। সেটা অবশ্যই দুই ফিতার জুটের ব্যাগ হওয়া ভালো। এর বাইরে আজকাল বাঁশ, বেত, হোগলাপাতা দিয়ে তৈরি নানা ধরনের ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। দোকানে কিনতে পাওয়া যায়, আবার অনলাইনে অর্ডার করেও সংগ্রহ করা যেতে পারে।
পাটের বহুমুখী ব্যবহারের কথা আমরা শুনে আসছি বহু বছর ধরে। এখন সময় এসেছে সত্যিকারের এর ব্যবহার দেখার। পাট ছাড়া অন্যান্য যেসব পণ্য দিয়ে পরিবেশবান্ধব ব্যাগ তৈরি করা যেতে পারে, সে ব্যাপারে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণাও প্রয়োজন। আশা করি, সরকার বিকল্পের বিষয়টিতেও মনোযোগ দেবেন।
কাজী আলিম-উজ-জামান উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো
ই–মেইল: [email protected]