মাহা আপার ছাতা

সংসদ ভবন প্রাঙ্গণে ছাত্র–জনতার জমায়েতফাইল ছবি

ছাতাটা এখনো জানালার শিকের সঙ্গে ঝুলে আছে। দেখলে চোখ আটকাবেই। বেশ পুরোনো দিনের আবেশ আছে ছাতাটায়। বাঁকানো নকশাদার হাতল, কালো কুচকুচে কাপড় আর ভেতরে লোহার শিক, সুচালো ডগা। আমাদের বাসায় ছাতাটার আগমন জুলাই অভ্যুত্থানের দিনগুলোতে। অনেক গবেষণার পর জানা গেল, ছাতাটা মাহা মির্জার।

জুলাইয়ের আগে হলে এই ছাতা কিংবা মাহা মির্জার সঙ্গে আমাদের বাসার সঙ্গে যোগাযোগের কোনো সম্ভাবনাই ছিল না। কারণ, মাহা আপার সঙ্গে আমার পরিচয় কেবল তাঁর লেখার সূত্র ধরে। দেশের অর্থনীতির হালচাল নিয়ে পত্রিকার পাতায় তাঁর আগুন ঝরানো লেখা বরাবরই মুগ্ধ করত। এত সহজে অর্থনীতির কঠিন বিষয় কীভাবে তিনি বুঝিয়ে বলেন, সেটা নিয়ে একটা আলাদা গবেষণা হতে পারে।

মাহা মির্জা প্রচারবিমুখ। হাজার অনুরোধেও তাঁকে টক শোতে ধরে আনা যায়নি। ইউটিউবে তাঁর গানের সুবাদে চেহারাটা অবশ্য চিনতাম। দেখা হয়নি কখনো।

গত ১৬ জুলাই আমাদের জীবনের অনেক কিছু বদলে গেল। ঠিক করে বললে বলতে হয়, শহীদ আবু সাঈদ অনেকটা জোর করেই বদলে দিলেন। তখন টেলিভিশনে টক শোতে কিছু বলে ওঠার সুযোগ নেই। আমাদের চ্যানেল টোয়েন্টিফোরের সাংবাদিক জুম্মাতুল বিদা নিজে লাইভ করার সময় তাঁর গায়েই গুলি বিঁধেছে। অসীম সাহসে বুক বেঁধে সেটাই সে বলছিল সরাসরি সম্প্রচারে। এই অপরাধেই চ্যানেল বন্ধ ছিল বেশ কিছুক্ষণ। সকালবেলা অবশ্য খানিকটা আশা জাগায় পত্রিকায় প্রকাশিত খবরগুলো। প্রথম আলো, নিউএজ, সমকাল ও ডেইলি স্টার তাদের মতো করে লড়াইটা চালিয়ে যাচ্ছিল।

পত্রিকা পড়া শেষ হয়ে গেলে বাসায় বসে থাকতে অস্থির লাগত। আমি আর আমার স্ত্রী সাবন্তী ভাবতাম, কী করা যায়, কোথায় যাওয়া যায়। এদিকে শহীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। সে তালিকায় ছোট্ট রিয়া যেমন আছে, তেমনই আছে মুগ্ধ-ফারহানরা। মনে হলো, অন্তত একটা বিবৃতি তো দেওয়া চলে। তখন ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ। খুদে বার্তাও ঠিকমতো যাচ্ছে না। একটা বিবৃতি তৈরি করে অন্যদের পাঠাতে হয় ছোট ছোট ভাগ করে।

তেমনই একটা বিবৃতি মোটামুটি দাঁড় করানো হয়েছে আগের রাতে। অগ্রজ বন্ধু অনুপ কুমার বসাক, মেহেরুন্নেসা বেলী, ডা. তাজনুভা জাবীন, ডা. মহিউদ্দিন আহমেদ, ধ্রুবজ্যোতি হোড়, নাসিমা সিরাজি সবার সঙ্গে মিলে, কখনো একসঙ্গে বসে, কখনো টেলিফোনে পড়ে শুনিয়ে বিবৃতি তৈরি করা ছিল পুরোপুরি নতুন অভিজ্ঞতা। গুগলে শেয়ার করা ফাইলে সবাই মিলে এডিট করা তখন অনেক দূরের স্বপ্ন।

আমাদের টক শোতে প্রায়ই অতিথি হয়ে আসতেন সাংবাদিক আশরাফ কায়সার। ফোন করে জানতে পারলাম, কাছেই এক বন্ধুর বাসায় আছেন তিনি। পরের দিন সকালে কারফিউর মধ্যে আমি আর সাবন্তী হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম সে বাসায়। বলতেই বিবৃতি দিতে রাজি হয়ে গেলেন। তখন ফোন করলাম প্রিয় শিক্ষক অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন খানকে। তিনি ফোনেই আরও খানিকটা যোগ করলেন, সাবন্তী লিখে নিল।

এই দারুণ অনিশ্চিত কিন্তু সুন্দর সময়ে যে মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বা পুরোনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে গভীর আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়েছি। তখন গুটিকয় মানুষ ছাড়া সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পিছপা হননি, সমূহ বিপদের আশঙ্কা জেনেও। সেটাই বোধ করি এই অভ্যুত্থানকে সফল করেছে।

ভাবছিলাম, আর কাকে বললে তিনি বিবৃতিতে নিজের নাম দিতে রাজি হবেন। স্বভাবতই অকুতোভয় আলোকচিত্রী শহিদুল আলমের নাম উঠে এল। তাঁর সঙ্গেও পূর্বপরিচয় নেই। সূত্র হলেন আশরাফ ভাই। হাঁটা দূরত্বেই তাঁর বাসা। সেখানে তাঁকে বিবৃতিটা দেখাতেই রাজি হয়ে গেলেন। আমার ক্যামেরায় তাঁর আগের কয় দিনের সহিংসতার ছবিও বৈশ্বিক গণমাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে সাহায্য করলেন।

সেদিন সন্ধ্যাবেলা টেলিফোনে কথা হলো স্বনামধন্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক সলিমুল্লাহ খানের সঙ্গে। তখন খুদে বার্তাতেও বিবৃতিটা পাঠানো দুষ্কর হয়ে উঠেছে। জানতে চাইলাম পড়ে শোনাব কি না? বললেন, পড়া লাগবে না। তিনি আছেন।

পরদিন পত্রিকায় বিবৃতিটা ছাপা হলো। সাহায্য করলেন প্রথম আলোর সোহরাব হাসান, ডেইলি স্টারের গোলাম মোর্তজা আর সমকালের ফারুক ওয়াসিফ। বিপুল শক্তিধর রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর চেপে বসা মদমত্ত স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে কয়েকজন নাগরিকের ক্ষুদ্র, কিন্তু সাহসী প্রতিবাদ। এ লড়াইয়ে অভিন্নহৃদয় বন্ধু স্নেহাদ্রি রিন্টু, ইভা মজুমদার, তাপস বন্ধু দাস, মতিউর রহমান কিংবা শিক্ষানবিশ আইনজীবী নাফিউল আলম সুপ্তর মতো অনেকেই যুক্ত হয়েছিলেন। আমরা অন্তত এতটুকু বলতে চেয়েছিলাম, ‘আমরা দমে যাইনি, বুলেটের সামনে দাঁড়িয়েও আমরা একতাবদ্ধ হতে জানি।’

সেদিনই প্রথম সলিমুল্লাহ খান স্যারের বাড়িতে গেলাম আমি আর সাবন্তী। আশার কথা শোনালেন তিনি। বললেন, স্বৈরশাসকের পতন অনিবার্য। প্রশ্নটা সময় আর আত্মদানের। ইন্টারনেট বন্ধ থাকার সেই সময়ে আমরা সবার বাড়ি বাড়ি গিয়েছি। কিংবা রাস্তায় বেরিয়ে দেখা হয়েছে নাম না–জানা অসংখ্য মানুষের সঙ্গে। সবার মধ্যে একটা স্বাভাবিক আর স্বতঃস্ফূর্ত ঐক্য দেখেছি সে সময়। এখনো যখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসে সে সময়ের কোনো ছবি বা ভিডিও। ভেবে অবাক হই, এত মানুষ আমরা এক হতে পেরেছিলাম!

ভয় যে ছিল না, তা নয়। কিন্তু ঘোর অবিশ্বাসের যুগেও কেন যেন মানুষের মধ্যে খুব সহজেই বিশ্বাস খুঁজে পেয়েছি সেই দিনগুলোয়। যেদিন মাহা মির্জাকে প্রথম ফোন করে জানতে চাইলাম, তিনি কোথায় আছেন? তিনি একবারেই তাঁর অবস্থান জানিয়ে দিলেন। ফোন রাখার পর তাঁর খটকা লাগল। গোয়েন্দা সংস্থার কেউ নয়তো আবার?
একটু বাদেই আবার ফোন দিয়ে জানতে চাইলেন, ‘আমি তাঁর কাছে ঠিক কী চাই।’

উত্তরটা কেমন হয়েছিল বলা কঠিন, কিন্তু মাহা আপা রাজি হলেন দেখা করতে। আমি আর সাবন্তী যথারীতি হাজির হলাম। খানিকটা যাচাই–বাছাই করে আপা নিশ্চিত হলেন আমরা গোয়েন্দা সংস্থার কেউ নই। তারপর আর আমাদের মনে হয়নি পরিচয়টা এক দিন কিংবা দুই দিন আগের।

আরও পড়ুন

এই দারুণ অনিশ্চিত কিন্তু সুন্দর সময়ে যে মানুষগুলোর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে বা পুরোনো সম্পর্ক নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়ার সুযোগ হয়েছে, সেখানে গভীর আন্তরিকতার ছোঁয়া পেয়েছি। তখন গুটিকয় মানুষ ছাড়া সবাই অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পিছপা হননি, সমূহ বিপদের আশঙ্কা জেনেও। সেটাই বোধ করি এই অভ্যুত্থানকে সফল করেছে।

মাহা আপা ছাতাটা কি ভুল করে রেখে গেছেন, নাকি ইচ্ছা করেই, সেটা ঠিক জানি না। কিন্তু ছাতাটা এখনো মনে করিয়ে দেয় সেই দিনগুলোকে। মনে করিয়ে দেয় আমাদের একতা, আন্তরিকতাকে। এই লেখায় যাঁদের নাম উল্লেখ করলাম, তাঁরা এখনো নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে লড়ে চলেছেন। কেউ প্রকাশ্যে, কেউ নীরবে। সব খবর হয়তো আমদের চোখেও পড়ে না।

খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় হামলার ঘটনা যত মানুষের চোখে পড়েছে, সেখানে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের ছুটে যাওয়ার খবর হয়তো তত মানুষের চোখে পড়েনি। ঢাকার আশুলিয়ায় আন্দোলনকারীদের লাশ পুড়িয়ে দেওয়ার ছবি যত লোকের চোখে পড়েছে, এ ঘটনায় জড়িত পুলিশ ইন্সপেক্টর আরাফাতকে গ্রেপ্তারের ঘটনা ততটা প্রচার পায়নি। জুলাই অভ্যুত্থানের দুই মাস পেরোনোর আগেই ৭০৮ শহীদের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার।

এই গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা শরিক হয়েছিলেন, তাঁরা লড়াই থামিয়ে দেননি। ঢাকা ও এর বাইরে গড়ে উঠছে নাগরিক উদ্যোগ। সবার মধ্যে স্বপ্ন আছে, আছে বিশ্বাস। সে লড়াই নতুন এক দেশ গড়ার। হয়তো নতুন বাংলাদেশ কেমন হবে, কোনো কাজটা আগে করা প্রয়োজন, সে ব্যাপারে আমাদের মধ্যে মতপার্থক্যও আছে।

কিন্তু একটা বিষয় নিশ্চিত, আমরা আগের অন্ধকার সময়ে, নির্বিচার হত্যার সময়ে আর ফিরে যেতে চাই না। এটাও নিশ্চিত, যদি আবারও কোনো অত্যাচারী শক্তি আমাদের কণ্ঠ রোধ করতে চায়, আমরা সবাই মিলেই রুখে দাঁড়াবই। কারণ, দেশের প্রশ্নে, মানুষের বেঁচে থাকার অধিকারের প্রশ্নে আমরা সবাই এক আছি, থাকব।

  • মানজুর আল মতিন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী