গত ১৪ আগস্ট সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চতুর্থবারের মতো অপরাধমূলক কাজের অভিযোগে অভিযুক্ত হন। ওই দিন এমএসএনবিসি নেটওয়ার্ক বিখ্যাত সাংবাদিক র্যাচেল ম্যাডোর সঞ্চালনায় সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনকে নিয়ে ট্রাম্পের ঘটনাবলি সম্পর্কিত আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
জর্জিয়ার মামলায় ২০২০ সালের নির্বাচন নস্যাৎ করার চেষ্টার অভিযোগে ট্রাম্প আরও ১৮ জনের সঙ্গে অভিযুক্ত হয়েছেন—এই খবর–সংক্রান্ত ম্যাডোর রাত নয়টার শোটি নজিরবিহীনভাবে ৩৯ লাখ ৩০ হাজার দর্শক দেখেছে।
এমএসএনবিসির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নেটওয়ার্কে পোস্ট করা হিলারির বক্তব্যের একটি অংশ ক্লিপ আকারে জুড়ে দিয়ে সেটির শিরোনাম দেওয়া হয়েছে, ‘হিলারি ক্লিনটন সেই রাজনৈতিক ব্যবস্থা নিয়ে বিলাপ করেছেন, যা বাস্তব ফলাফলকে নয়, বরং রাজনৈতিক থিয়েটারকে পুরস্কৃত করে থাকে।’
এই কথাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে হিলারি বলেন, ট্রাম্পের উত্তরসূরি জো বাইডেন কোনো ‘রাজনৈতিক নাটকের অভিনয়শিল্পী নন।’ হিলারি বলেছেন, এক ধরনের নাটকধর্মী বোধ এখন মার্কিন জনমানসে প্রাধান্য বিস্তার করছে, যা ‘বিভক্ত তথ্যের বাস্তুতন্ত্র’ তৈরি
করেছে।
এটি প্রেসিডেন্ট হিসেবে বাইডেনের কৃতিত্বের খবর প্রচার করা অধিকতর কঠিন করে তুলেছে। কারণ, বেশির ভাগ আমেরিকান এখন আর ‘তাদের খবর এমএসবিসি থেকে পান না’, বরং তাঁরা তা পান ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে’।
হিলারি বলছিলেন, যেহেতু জাতীয় অবকাঠামো এবং অন্যান্য জটিল বিষয় নিয়ে কথা শোনা এখন জনগণের কাছে ‘ক্লিশে’ হয়ে গেছে, তাই মিডিয়া ভেন্যুগুলো, ‘ডোনাল্ড ট্রাম্প বা এই ধরনের ব্যক্তিদের মধ্যে যাঁরা আমাদের নেতিবাচক বার্তা দেওয়া ছাড়া কিছুই করেন না, তাঁদের সম্পর্কে কথা বলার বিষয়কেই বেছে নেয়। কারণ এসব আলাপ অনেক বেশি চটকদার ও উত্তেজনাপূর্ণ।’
মজার বিষয় হলো, হিলারি যেটি বলছিলেন, ঠিক সেই কাজটিই তখন ম্যাডো ও হিলারি করছিলেন।
ট্রাম্পের অভিযোগের বিষয়ে এমএসএনবিসির শ্বাসরুদ্ধকর কভারেজ চ্যানেলটির রেটিংকে যথেষ্ট বাড়িয়েছে। অর্থাৎ এখানেও সেই ‘থিয়েটার’ই বিক্রি হয়েছে।
প্রাইম টাইম রেটিংয়ের ক্ষেত্রে নেটওয়ার্কটি মাঝেমধ্যে ফক্স নিউজকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। সস্তা চাঞ্চল্যকর তথ্যের ওপর ভর করে রাজত্ব করা ট্যাবলয়েড মার্কা ‘নাটকের’ দিকে তারাও ঝুঁকছে।
ভ্যানিটি ফেয়ার পত্রিকা বলেছে: ট্রাম্পের অভিযুক্ত হওয়ার সর্বশেষ ঘটনা এমএসএনবিসির হাতে সুপার বোল এনে দিয়েছে। ওই দিন, অর্থাৎ ১৪ তারিখ রাত নয়টা থেকে পরদিন ভোর তিনটা পর্যন্ত ফক্স নিউজ ও সিএনএনের সম্মিলিতভাবে যত দর্শক ছিল, ওই সময়টুকুতে তার চেয়ে অনেক বেশি দর্শক ছিল এমএসএনবিসি নেটওয়ার্কের।
গত ২৪ আগস্ট ট্রাম্পকে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রেপ্তার দেখানোর আগমুহূর্তে এমএসএনবিসি ম্যাডো, ক্রিস হেইস ও অন্যান্য নামজাদা ভাষ্যকারদের ঘটনার ধারাবাহিক ধারাভাষ্য দেওয়ার জন্য প্রস্তুত রেখেছিল। এই নেটওয়ার্ক ট্রাম্পের বিমানটি আটলান্টায় অবতরণ করার পর থেকে তাঁর ফুলটন কাউন্টি কারাগারে যাওয়া পর্যন্ত পুরো পথ অনুসরণ করেছিল।
এটি নিশ্চিত, এমএসএনবিসি-ই একমাত্র উদারপন্থী মার্কিন সংবাদমাধ্যম নয়, যারা সাবেক প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ‘অনন্তকালব্যাপী সোপ অপেরা’ নিয়ে চমক তৈরি করে থাকে। তবে এটি এমন একটি নেটওয়ার্ক, যে কিনা এই মুহূর্তের সবচেয়ে সন্দেহজনক আর্টফর্মকে সবচেয়ে নিখুঁত করে তুলতে পারে। ট্রাম্পের একসময়কার প্রতিদ্বন্দ্বী সিএনএনের প্রবাদতুল্য প্রাইম-টাইম এই নেটওয়ার্কের সামনে ধুলায় মিশে গেছে।
গত এপ্রিলে ট্রাম্পকে যখন ম্যানহাটানের একটি আদালতে অর্থ কেলেঙ্কারি–সংক্রান্ত ৩৪টি অপরাধমূলক কাজের জন্য অভিযুক্ত করা হয়েছিল, তখন দ্য নিউ রিপাবলিক-এর অ্যালেক্স শেফার্ড বলেছিলেন, ‘কেব্ল নিউজের সম্প্রচার সময়ের শূন্যতা ট্রাম্পের মতো আর কেউ পূরণ করতে পারে না।’
ট্রাম্পের আদালতের দরজার বর্ণনা দিতে গিয়ে সিএনএন যেভাবে অযৌক্তিক সময় ব্যয় করেছিল, সে বিষয়ে বিস্ময় প্রকাশ করে শেফার্ড মন্তব্য করেছিলেন, ট্রাম্প ‘হয়তো এখন আর শীর্ষ ফর্মে নেই, কিন্তু যখন কোনো গরম ইস্যুর মরিয়া প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন সেই শূন্যতা তিনিই পূরণ করতে পারেন।’
এটি অবশ্যই নয় যে ট্রাম্প–সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলির খবর-মূল্য নেই; কিংবা এমনও নয় যে সাবেক অথবা বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্টের অপরাধমূলক তৎপরতা নিয়ে সংবাদমাধ্যমের তৎপর হওয়া ঠিক হবে না। বিশেষ করে সেই ব্যক্তি যদি আসন্ন নির্বাচনের প্রার্থী হন, তাহলে তাঁর বিষয়ে সংবাদমাধ্যমের আগ্রহ থাকারই কথা।
কিন্তু ট্রাম্পের খবর প্রচার করতে গিয়ে খবরবহির্ভূত বিষয় নিয়ে সংবাদমাধ্যমের অহেতুক, অতিরঞ্জিত ও অপ্রয়োজনীয় আলোচনা মূল খবরকে ‘রিয়েলিটি শো’ ধরনের বিষয় বানিয়ে ফেলে। এতে ট্রাম্পের খবর ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্রে যে প্রচুর খারাপ খবর থাকে, তা দৃষ্টির আড়ালে চলে যায়।
অথচ দর্শক টানতে গিয়ে উদারপন্থী মার্কিন মিডিয়াগুলো ট্রাম্পের এই অপ্রয়োজনীয় খবর প্রচার করে যাচ্ছে।
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিতভাবে অনূদিত
বেলেন ফার্নান্দেজ আল–জাজিরার কলাম লেখক