ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়ার খড়মপুর গ্রামের কৃতী ছাত্র খাদিমকে কি মনে রেখেছে এলাকার মানুষ? অসাধারণ বিজ্ঞানী আতাউর রহমান খান খাদিম ১৯৪৮ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জর্জ এইচ ই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন, ১৯৫০-এ ঢাকা কলেজ থেকে আবার প্রথম শ্রেণিতে আইএসসি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণি পেয়ে অনার্স, তারপর মাস্টার্সে সেকেন্ড ক্লাস ফার্স্ট—এ রকম শিক্ষার্থীর কৃতিত্বের সুনাম সবখানেই ছড়িয়ে পড়ে। এমন দুর্দান্ত মেধাবী মানুষটি নিশ্চিন্ত জীবনও পেয়েছিলেন, ফিলিপস কোম্পানিতে এক্স-রে বিজ্ঞানীর পদ, উচ্চশিক্ষার জন্য জার্মানি গিয়ে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যা ইনস্টিটিউটে অধ্যয়ন।
এই মানুষটিকে কে বলেছিল দেশে ফিরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা ফেলো হতে, পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে (১৯৬৫)। একই সঙ্গে ইলেকট্রনিকস বিদ্যায় দক্ষ, তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় নিমগ্ন, থাকেন ঢাকা হলের (এখন শহীদুল্লাহ হল) সিঙ্গেল রুমে, ঘড়ি ধরে ক্লাসে আসেন! কী অপরাধ ছিল তাঁর যে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তানি সৈন্যরা তাঁর ঘরে ঢুকে হত্যা করল তাঁকে? একই সময়ে ওই হলের সহকারী আবাসিক শিক্ষক শরাফত আলীকেও হত্যা করল পাকিস্তানিরা!
একাত্তরের শহীদ বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন মেধাশ্রেষ্ঠ। আবুল কালাম আজাদের (১৯৩৩-৭১) কথা স্মরণ করতে পারি। কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় জন্ম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। ম্যানচেস্টার ইউনিভার্সিটি থেকে বলবিজ্ঞানে ডিপ্লোমা, ফলিত গণিতে এমএসসি, গণিতে পিএইচডি! জগন্নাথ কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান, ১৯৭০-এ যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে। ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ ধরে নিয়ে গেল তাঁকে, তিনি আর ফিরলেন না।
প্রথমা প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বুদ্ধিজীবী বইয়ে প্রকাশিত ৩৫৪ জন শহীদ বুদ্ধিজীবীর কাহিনি পড়তে থাকলে দেখা যাবে, সারা দেশেই শহীদ হয়েছেন নানা পেশার বুদ্ধিজীবীরা। যেমন ধরুন ফাদার লুকাশ মারান্ডি (১৯২২-৭১)। তিনি ছিলেন ঠাকুরগাঁওয়ের রুহিয়া ক্যাথলিক মিশনের ফাদার। সাঁওতাল ভাষায় উপাসনা-সংগীতের বই লিখে রেখে গেছেন তিনি। সাঁওতাল এই ফাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মিশনে তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেন। ২১ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তানি সৈন্যরা মিশনে এসে তাঁকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে।
প্রথমার বইটি ওলটাতে গিয়ে যেখানেই চোখ পড়ে, সেখানেই শহীদ বুদ্ধিজীবীদের মেধা, উদারতা, সমাজব্রত, দেশপ্রেমের উজ্জ্বল উদাহরণ পাওয়া যায়। এ কে শামসুদ্দিন (১৯৪৩-৭১) টাঙ্গাইলের সন্তান, প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ তাঁর মাতামহ, একাত্তরে ছিলেন সিরাজগঞ্জের মহকুমা প্রশাসক। ম্যাট্রিকে স্ট্যান্ড করেছেন, লাহোর সরকারি কলেজে রসায়নে অনার্স পড়তে গিয়ে পান সায়গল বৃত্তি, যা শুধু পশ্চিম পাকিস্তানিদের জন্য বরাদ্দ থাকলেও এত ক্ষুরধার মেধাবীকে বৃত্তি না দিয়ে পারেনি ওরা। এখানেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম, আবার ১৯৬৮ সালে সিএসপি পরীক্ষায় সারা পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম। মুক্তিযুদ্ধে যোদ্ধার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে দেখতে এসে ঢাকায় ধরা পড়েন মে মাসে, ১৯ মে শহীদ হন।
স্মরণ করা যায় ধীরেন্দ্রনাথ দত্তর (১৮৮৬-১৯৭১) কথা। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার রামরাইল গ্রামে জন্ম, রিপন কলেজ থেকে ১৯০৮ সালে বিএ, ১৯১০ সালে বিএল। ১৯৩৭ ও ১৯৪২ সালে বঙ্গীয় প্রাদেশিক সভার নির্বাচিত সদস্য। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য নির্বাচিত হন গণপরিষদ সদস্য হিসেবে। কংগ্রেসি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত কলকাতা চলে যেতে পারতেন; যাননি। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে তুললেন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি। ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লা শহরের বাসা থেকে তাঁকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি মিলিটারি, ভীষণ অত্যাচার করা হয়। প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে তিনি হামাগুড়ি দিয়ে চলতেন। তারপর তাঁকে হত্যাই করা হয়।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে কাদালেপা মাইক্রোবাস যায় তালিকা করা বুদ্ধিজীবীদের বাসায় বাসায়। শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, ডা. ফজলে রাব্বী, সিরাজুদ্দীন হোসেন, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো গুচ্ছ গুচ্ছ নাম। আমাদের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের হত্যা করা হলো। ১৯৭২ সালের বিজয় দিবসে সৈয়দ আলী আহসানের সম্পাদনায় বাংলাদেশ নামে গ্রন্থে শহীদ বুদ্ধিজীবীর সংখ্যা ১ হাজার ১১৮ বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এই শ্রেষ্ঠ মেধাবী মানুষগুলোকে হত্যা করার ফলে বাংলাদেশ সেই যে মেধাশূন্যতায় পড়ল, তা আর পূরণ হয়নি। তার কুফল আমরা এখনো ভোগ করে চলেছি। তবে তাঁদের সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণা এই প্রজন্মের যোদ্ধাদের যে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে, তা ২০২৪-এর ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে দেখা গেছে।
১৯৬৯-এর শহীদ বুদ্ধিজীবী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা ২০২৪-এ কীভাবে সাহস জোগালেন রংপুরের পীরগঞ্জের সন্তান বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে। ফেসবুকে আবু সাঈদ শামসুজ্জোহার সমাধিফলকের ছবি দিয়েছিলেন, ‘আজ আমি ছাত্রদের রক্তে রঞ্জিত, এরপর কোনো গুলি তা ছাত্রকে না লেগে যেন আমার গায়ে লাগে—শহীদ শামসুজ্জোহা, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯, শহীদ হওয়ার আগের দিন।’ আবু সাঈদ লিখেছিলেন, ‘স্যার! এই মুহূর্তে আপনাকে ভীষণ দরকার, স্যার! আপনার সমসাময়িক সময়ে যারা ছিল, সবাই তো মরে গেছে, কিন্তু আপনি মরেও অমর। আপনার সমাধি, আমাদের প্রেরণা। আপনার চেতনায় আমরা উদ্ভাসিত।’
১৬ জুলাই ২০২৪ কোটা সংস্কার আন্দোলনের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমন্বয়ক আবু সাঈদ পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দেন এবং শহীদ হন। আমরা দেখেছি, জহির রায়হানের লেখা আরেক ফাল্গুন উপন্যাসের সংলাপ, ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা কিন্তু দ্বিগুণ হব’ কীভাবে জেন-জির কিশোরেরা হৃদয়ে ধারণ করেছিল, গ্রাফিতিতে এঁকে রেখেছিল।
১৯৭১-এর শহীদ মুনীর চৌধুরী কবর নাটক লিখেছিলেন ১৯৫৩ সালে, ভাষা আন্দোলনের শহীদদের নিয়ে, অভিনীত হয়েছিল কারাগারের ভেতরে। তার সংলাপ, ‘তুমি আমার ওপরে খুব রাগ করেছ, না মা? তুমি বারণ করলে, তবু আমি শুনলাম না। রাস্তা থেকে ওরা ডাকল। আমি ছুটে বেরিয়ে গেলাম।’ আর ২০২৪-এ ক্লাস টেনের ছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস মা-বাবাকে চিঠি লিখে যায়, ‘মা আমি মিছিলে যাচ্ছি। আমি নিজেকে আর আটকিয়ে রাখতে পারলাম না। সরি আব্বুজান। তোমার কথা অমান্য কোরে বের হোলাম। স্বার্থপরের মতো ঘরে বসে থাকতে পারলাম না...।’ ছেলে ফেরে না, অটোরিকশায় করে ফেরে তার শহীদি দেহ।
এক বছর আগে লিখেছিলাম ‘এসো ছিনিয়ে নিই আমাদের স্বাধীনতা’ (প্রকাশ ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩, প্রথম আলো)। নতুন শিক্ষাক্রম নিয়ে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক। কর্তৃপক্ষ এ আলোচনা অনুষ্ঠান হতে দেয়নি। তারই প্রতিবাদ করেছিলাম। লিখেছিলাম, ‘বিতর্কচর্চার সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান তো বিশ্ববিদ্যালয়ই। এই বিতর্কচর্চার শ্রেষ্ঠতম অঙ্গন তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই।’ এই সেই বিশ্ববিদ্যালয়, যার মাটিতে আনোয়ার পাশা, আবুল খায়ের, আবদুল মুকতাদির, এ এন এন মুনীরুজ্জামান, গিয়াসউদ্দিন আহমদ, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতাসহ অনেক শিক্ষক-শিক্ষার্থী-কর্মকর্তা-কর্মচারীর রক্ত লেগে আছে!
বুদ্ধিজীবীদের একটা কাজ বিদ্রোহ করা, চিন্তার বিদ্রোহ। তাঁরা নতুন কথা বলেন, বলে নিজেরা বিপন্ন হন। কিন্তু পৃথিবীকে এগিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের শহীদ বুদ্ধিজীবীরাও তা-ই করেছিলেন। ২০২৪-এর জুলাই গণ–অভ্যুত্থান আমাদের সাহস জোগাচ্ছে যে সেই উত্তরাধিকার ফুরিয়ে যায়নি। এখনকার শিক্ষক পেশাজীবীরাও প্রতিবাদ করতে ভুলে যাননি। তাঁরা রাস্তায় নেমেছেন, ‘এই মৃত্যু-উপত্যকা আমার দেশ না’ বলে রোরুদ্যমান চিৎকার করেছেন, ‘খবরদার রাজাকারের বাচ্চা বলবেন না’ বলে গর্জে উঠেছেন, ‘এখনই পদত্যাগ করুন’ বলে ঘোষণা দিয়েছেন, সমন্বয়কদের মুক্তির দাবিতে ডিবি অফিসের সামনে দাঁড়িয়েছেন, গান বেঁধেছেন, কবিতা লিখেছেন, নাটক করেছেন, গ্রাফিতিতে দেশ ভরে তুলেছেন! এই প্রতিবাদ যেন জারি থাকে।
মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, ক্ষমতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম হচ্ছে বিস্মৃতির বিরুদ্ধে স্মৃতির সংগ্রাম। তা-ই করে যেতে হবে, ভোলা যাবে না, ভুলতে দেওয়া যাবে না, আবার ক্ষমতার বিরুদ্ধেও লড়ে যেতে হবে। ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৯০, ২০২৪-এর বীর আর শহীদেরা সে আহ্বানই জানিয়ে যাচ্ছেন।
●আনিসুলহকপ্রথমআলোরব্যবস্থাপনাসম্পাদকওসাহিত্যিক