ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের সর্বকালের অসম্ভাব্যতম প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ২০১৬ সালে তিনি যখন নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছিলেন, তখন নির্বাহী ক্ষমতা বলতে তাঁর তেমন কিছুই ছিল না। ওই সময়টাতে তাঁর সর্বোচ্চ নির্বাহী ক্ষমতা ছিল, একটি টেলিভিশনে প্রচারিত রিয়েলিটি শোর সঞ্চালক হিসেবে প্রতিযোগীদের ‘ইউ আর ফায়ারড’ বলে অনুষ্ঠান থেকে বের করে দেওয়া।
বিরাট একটা বোর্ডরুম টেবিলের সামনে বসে মিথ্যামিথ্যি ‘ইউ আর ফায়ারড’ বলে প্রতিযোগীদের বহিষ্কার করার সেই সিনেমাটিক দৃশ্য লাখো আমেরিকান ভোটারকে আশ্বস্ত করেছিল, তিনিই আমেরিকার প্রেসিডেন্টের গদিতে বসার যোগ্য। সেসব ভোটারের মধ্যে এমন কিছু ভোটার ছিলেন, যাঁরা জীবনে প্রথমবারের মতো ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের মনে হয়েছিল একমাত্র ডোনাল্ড ট্রাম্পই আমেরিকাকে আবার আগের মর্যাদায় ফিরিয়ে আনার সক্ষমতা রাখেন।
সময়টা ট্রাম্পের জন্য লাগসই ছিল। ভাগ্য তাঁর প্রতি প্রসন্ন ছিল। এর সঙ্গে জনগণের সেই ধারণা মিলিত হয়ে ট্রাম্পকে হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করতে সক্ষম করে তুলেছিল। তবে ট্রাম্প যে পরিমাণ ভোটে বিজয়ী হয়েছেন বলে দাবি করেছিলেন, প্রকৃতপক্ষে তিনি তত ভোট পাননি। অতি সামান্য ভোটের ব্যবধানে তিনি হিলারিকে পরাজিত করেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে হিলারির চেয়ে তিনি পপুলার ভোট ২৮ লাখ কম পেয়েছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে পপুলার ভোটের এত ব্যবধান এর আগে কখনো দেখা যায়নি।
তখন থেকেই ব্যালট বাক্সে ট্রাম্প বিষাক্ত প্রমাণিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে ট্রাম্পের ডেমোক্রেটিক পার্টি রিপাবলিকান পার্টিকে পরাজিত করে। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প ইলেকটোরাল কলেজ ভোটে সামান্য ব্যবধানে এবং পপুলার ভোটে বিপুল ব্যবধানে পরাজিত হন। ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে দেশজুড়ে ট্রাম্পের পছন্দের প্রার্থীরা হেরেছিলেন এবং ডেমোক্রেটিক প্রার্থীরা অ্যারিজোনা, মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনসহ গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যগুলোতে হয় নিজেদের আসন ধরে রেখেছেন, নয়তো রিপাবলিকান আসন জিতেছেন।
এই ব্যর্থতা ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ফিরে না আসার গুঞ্জনকে কিছুটা জোরালো করলেও ট্রাম্প দলের চালিকাশক্তির ওপর দ্রুত নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছেন এবং সবচেয়ে চরমপন্থী সদস্যদের অনুসারী বানাতে সক্ষম হয়েছেন।
দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের এটি এমন একটি পদ্ধতি, যার কারণে এ বছরের শেষেই ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান পার্টি উভয়কেই একটি বিধ্বংসী নির্বাচনী পরাজয়ের মুখোমুখি হয়ে অনুশোচনা করতে হবে।
ট্রাম্পের অভব্য আচরণ, গণতন্ত্রবিরোধী কথাবার্তা এবং প্রতিপক্ষকে উপর্যুপরি হুমকি দিয়ে যাওয়া নভেম্বরের নির্বাচনে তাঁর পরাজয় ডেকে আনবে। তবে যে বিষয়টি ট্রাম্পকে নিশ্চিতভাবে স্থায়ী অবসরে পাঠিয়ে দেবে, সেটি হলো আমেরিকার জনসংখ্যাগত অবস্থা। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফরাসি দার্শনিক অগাস্তে কমতের ‘জনসংখ্যাই নিয়তি’ বলে যে তত্ত্ব চালু আছে, সেটি আগের যেকোনো প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফলের তুলনায় আসন্ন নির্বাচনের ক্ষেত্রে অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হতে পারে।
এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের প্রার্থিতা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে নিকি হ্যালি ট্রাম্পকে প্রার্থী হিসেবে অনুমোদন দিয়ে যাননি। তিনি ভোটারদের বলেছেন, তাঁরা চাইলে ট্রাম্পকে ভোট দিতেও পারেন, না–ও পারেন। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে সন্দেহ করার এটাও একটি বড় যৌক্তিক কারণ। নিকি হ্যালির সমর্থকদের একটি অংশ হয় ভোটদানে বিরত থাকবেন, নয়তো জো বাইডেনকে ভোট দেবেন।
২০১৬ ও ২০২৪ সালের মধ্যবর্তী সময়ে প্রায় দুই কোটি বয়স্ক মার্কিন ভোটার মারা গেছেন এবং ৩ কোটি ২০ লাখ তরুণ ভোটার হওয়ার বয়সে পৌঁছেছেন। অনেক তরুণ ভোটার উভয় দলকেই ঘৃণা করেন। এবং রিপাবলিকানরা কলেজ ক্যাম্পাসে সক্রিয়ভাবে (বেশির ভাগই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ) তাদের কর্মী সংগ্রহ করছে। তবে শূন্য প্রজন্মের এই নতুন ভোটাররা মানবাধিকার, গণতন্ত্র এবং পরিবেশ ইস্যুতে অনেক উদারপন্থী। এই প্রবণতা তাঁদের ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ভোট দিতে উৎসাহিত করতে পারে।
বাস্তবতা হলো, ২০১৬ সালে ট্রাম্প মার্কিন রাজনীতিতে পদচারণের পরই রিপাবলিকান পার্টি অনেক বেশি শ্বেতাঙ্গবান্ধব, অনেক বেশি প্রাচীনপন্থী, অনেক বেশি পুরুষতান্ত্রিক এবং অনেক বেশি চরমপন্থী হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্পের গোঁয়ার্তুমির কারণে দলটি উদারপন্থী এবং স্বাধীনতায় বিশ্বাসী মানুষের কাছে তার আবেদন হারিয়ে ফেলেছে।
ট্রাম্পের হাতে এখন যে পরিমাণ ভোটার আছেন, তার চেয়ে অনেক বেশি ভোটার আছে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হাতে। তার মানে এই নয় যে জো বাইডেনের নির্বাচনে জয়ী হওয়া খুব সহজ হবে। তবে অধিকসংখ্যক ভোটার তাঁর হাতে থাকার কারণে ভোটারদের অনুপস্থিতিজনিত সংকটে তিনি ট্রাম্পের চেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় থাকতে পারবেন।
ট্রাম্পকে এ নির্বাচনে জিততে হলে অবশ্যই তাঁর অনুসারীদের প্রায় সবাইকেই ভোট দিতে নির্বাচনকেন্দ্রে আনতে হবে। এ ছাড়া এমন অনেক রিপাবলিকান ভোটার আছেন, যাঁরা গত নির্বাচনে ট্রাম্পকে ভোট দিলেও এত দিনে তাঁর ব্যক্তিগত আচরণ ও নীতির কারণে তাঁর ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়েছেন।
আমেরিকার জনগণ এখন যতগুলো ইস্যু মোকাবিলা করছে, রিপাবলিকান পার্টি ঠিক তার উল্টো অবস্থানে রয়েছে। প্রজনন অধিকারের কথাই ধরা যাক। রিপাবলিকান দলের ‘ছিনতাই করে নেওয়া’ সুপ্রিম কোর্ট ২০২২ সালে রো ভার্সেস ওয়েড আইনটি বাতিল করে দেয়। এই আইনের বলে অর্ধশতাব্দীর বেশি সময় ধরে নারীরা গর্ভপাতের স্বাধীনতা ভোগ করে আসছিলেন। কিন্তু চরম রক্ষণশীল রাজ্য আইনসভাগুলোতে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এমনকি ধর্ষণ অথবা পিতা কিংবা ভাইয়ের মতো নিকট স্বজনের সঙ্গে শারীরিক সংসর্গজনিত কারণে গর্ভবতী হয়ে পড়ার পরও সেসব রাজ্যে নারীদের গর্ভপাতের অনুমতি দেওয়া হয় না। ট্রাম্পের এই নীতির কারণে অনেক নারী এবং উদারপন্থী ভোটার ডেমোক্র্যাট শিবিরের সঙ্গে শক্তভাবে যুক্ত হয়েছেন, অনেকে এই নীতিও গ্রহণ করেছেন, ট্রাম্প ছাড়া যে কেউ প্রেসিডেন্ট হতে পারেন।
জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে ট্রাম্প প্রায়ই নিজেকে আমেরিকার ঐতিহ্যগত শত্রুপক্ষের সঙ্গে সংযুক্ত করেছেন; যার ফলে তাঁর নিজের দলের নেতারা রাগান্বিত হয়েছেন।
অনেক বয়স্ক রিপাবলিকান এখনো তাঁদের হৃদয়ে রোনাল্ড রিগ্যানের চেতনা ধারণ করেন। তাঁরা আমেরিকাকে ‘পাহাড়ের ওপর অবস্থিত একটি উজ্জ্বল শহর’ হিসেবে দেখেন। অর্থাৎ তাঁরা বিশ্বের মানুষের কাছে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের আলোকবর্তিকা হিসেবে আমেরিকাকে দেখাতে চান।
শীতল যুদ্ধের কথা মনে আছে—এমন বয়সী ভোটারদের কাছে রাশিয়া আমেরিকার প্রধান শত্রু। রিপাবলিকানরা গণতান্ত্রিক দেশ ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলাকে অগ্রহণযোগ্য মনে করে। সাম্প্রতিক একটি জরিপে দেখা গেছে, আমেরিকার ৪৩ শতাংশ ভোটার মনে করছেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করতে ইউক্রেনকে আমেরিকা পর্যাপ্ত সহায়তা করছে না। তাঁরা ট্রাম্পের ন্যাটো ত্যাগের হুমকিকে অনুমোদন করেন না। রাশিয়া, হাঙ্গেরি, সৌদি আরবের মতো কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রের সঙ্গে ট্রাম্পের সখ্য তাঁদের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত।
এই সপ্তাহ পর্যন্ত রিপাবলিকানদের কাছে ট্রাম্পের বিকল্প প্রার্থী ছিল। তিনি হলেন জাতিসংঘের সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হ্যালি। ট্রাম্পের বিকল্প নেতা হিসেবে ভালোভাবেই উঠে আসছিলেন। নিউ হ্যাম্পশায়ার, নেভাডা ও সাউথ ক্যারোলাইনায় রিপাবলিকান দলের প্রাইমারিতে তিনি প্রায় ৩০% ভোট পেয়েছেন। তবে ১৪টি রাজ্যের সুপার টুয়েসডে প্রাইমারিতে তিনি হেরে গেছেন। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্পের প্রার্থিতা প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেছে। তবে নিকি হ্যালি ট্রাম্পকে প্রার্থী হিসেবে অনুমোদন দিয়ে যাননি। তিনি ভোটারদের বলেছেন, তাঁরা চাইলে ট্রাম্পকে ভোট দিতেও পারেন, না–ও পারেন। ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচনের ক্ষেত্রে সন্দেহ করার এটাও একটি বড় যৌক্তিক কারণ। নিকি হ্যালির সমর্থকদের একটি অংশ হয় ভোটদানে বিরত থাকবে, নয়তো জো বাইডেনকে ভোট দেবে।
এসব কারণে ট্রাম্পের পুনর্নির্বাচিত হওয়ার আশা খুবই কম।
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট থেকে নেওয়া অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
রিড গ্যালেন দ্য লিংকন প্রজেক্টের (ডোনাল্ড ট্রাম্পকে পরাজিত করার লক্ষ্যে সাবেক রিপাবলিকান কৌশলবিদদের প্রতিষ্ঠিত একটি গণতন্ত্রপন্থী সংস্থা) সহপ্রতিষ্ঠাতা এবং লিংকন প্রজেক্ট পডকাস্টের সঞ্চালক।