ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পর থেকে অনেক পর্যবেক্ষক ভবিষ্যদ্বাণী করছেন, তাঁর প্রশাসন ফিলিস্তিন ও মধ্যপ্রাচ্যের জন্য আরও খারাপ পরিস্থিতি ডেকে আনবে। তাঁরা বলছেন, ইসরায়েলপন্থী বক্তৃতা ও ইরানের ওপর বোমা হামলার হুমকি দিয়ে ট্রাম্প তাঁর আক্রমণাত্মক পররাষ্ট্রনীতির ইঙ্গিত দিয়েছেন।
তবে গত আট বছরের মার্কিন পররাষ্ট্রনীতিকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করলে মনে হবে, ট্রাম্পের এই মেয়াদে ফিলিস্তিনের জনগণ এবং পুরো অঞ্চলের জন্য মৌলিক কোনো পরিবর্তন আসবে না। এর কারণ হলো প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন কার্যত ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের নীতিগুলোতে বড় কোনো পরিবর্তন আনেনি। বরং বাইডেন ট্রাম্পের পথেই হেঁটেছেন। বাইডেন ও ট্রাম্পের এই অভিন্ন পররাষ্ট্রনীতির তিনটি প্রধান উপাদান রয়েছে।
প্রথমটি হলো যুক্তরাষ্ট্র এত দিন ‘টু স্টেট সলিউশন’ বা ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’-এর সমর্থন দেওয়ার যে ভান করে এসেছিল, সেই ভান করা ছেড়ে দিয়ে ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’ তত্ত্বকে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করা।
যুক্তরাষ্ট্র নিজেই একসময় এই সমাধান–পথের প্রস্তাব করেছিল। সে প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিন ১৯৬৭ সালের নির্ধারিত সীমান্তের মধ্যে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন এবং সার্বভৌমত্ব ভোগ করবে এবং ফিলিস্তিনের রাজধানী হবে পূর্ব জেরুজালেম। কিন্তু ট্রাম্পের প্রথম প্রশাসন এ সমাধানের পথ প্রত্যাখ্যান করে। মার্কিন দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে সরিয়ে নিয়ে, ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলি দখলদারিকে স্বীকৃতি দিয়ে, ফিলিস্তিনে অবৈধ বসতি সম্প্রসারণকে উৎসাহিত করে এবং সার্বভৌমত্ব পাবে না, এমন একটি ‘ফিলিস্তিনি সত্তা’ গঠনের পক্ষে সমর্থন দিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন এ বিষয়টিকে স্পষ্ট করেছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের প্রস্তাব দিয়েছিল, ফিলিস্তিনিদের কিছু আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে এবং এর বিনিময়ে ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার ও স্বশাসনের আকাঙ্ক্ষা থেকে সরে আসতে হবে। ট্রাম্পের পর বাইডেন প্রশাসন এসে শুধু মুখেই ‘দ্বিরাষ্ট্র সমাধান’-এর প্রতি সমর্থন দিয়েছে; কিন্তু তা বাস্তবায়নে তারা কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। আদতে বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের নীতিই অনুসরণ করে এসেছে, যা এই সমাধান বাস্তবায়নের পথে বাধা সৃষ্টি করে। বাইডেন জেরুজালেমে মার্কিন দূতাবাস বন্ধ করেননি এবং বসতি সম্প্রসারণ থামানোর বা অধিকৃত পশ্চিম তীরের বড় অংশ ইসরায়েলি দখলে নেওয়ার চেষ্টা রোধ করার জন্য কিছুই করেননি। এ ছাড়া বাইডেন প্রশাসন এই ধারণা মেনে নিয়েছিল যে ভবিষ্যতে কোনো ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন বা সার্বভৌমত্ব ভোগ করবে না।
ট্রাম্প-বাইডেন পররাষ্ট্রনীতির দ্বিতীয় অভিন্ন উপাদান হলো আব্রাহাম চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলের সঙ্গে আরব দেশগুলোর সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ। ইসরায়েলের সঙ্গে মরক্কো, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ চুক্তি সইয়ের মাধ্যমে প্রথম ট্রাম্প প্রশাসন প্রক্রিয়াটি শুরু করেছিল। বাইডেন প্রশাসন সেই পথ অনুসরণ করে এসেছে এবং তা বাস্তবায়নে দৃঢ়ভাবে কাজ করেছে। এর অংশ হিসেবে তারা ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিককরণের চেষ্টা চালিয়েছে। গাজায় গত বছর থেকে চলমান গণহত্যা সংঘটিত না হলে এত দিনে হয়তো এই সম্পর্ক স্বাভাবিককরণ চুক্তি সম্পন্ন হয়ে যেত।
ট্রাম্প-বাইডেন নীতির তৃতীয় উপাদান হলো ইরানকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। ট্রাম্প প্রশাসন সর্বজনবিদিত ইরান চুক্তি বাতিল করেছিল। ইরান চুক্তিতে পারমাণবিক কর্মসূচি সীমাবদ্ধ পরিসরে রাখার বিনিময়ে ইরানকে কিছু নিষেধাজ্ঞা থেকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল।
ট্রাম্প প্রশাসন এই চুক্তি বাতিল করে ইরানের ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল এবং দেশটিকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেছিল। বাইডেন প্রশাসন এসে ইরান চুক্তিতে ফিরে যায়নি এবং ইরানের বিরুদ্ধে ট্রাম্পের আরোপ করা নিষেধাজ্ঞা বহাল রেখেছে। শুধু তা–ই নয়, বাইডেন প্রশাসন ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করে একটি নতুন অর্থনৈতিক ও নিরাপত্তাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়েছে, যা কিনা ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে তৈরি হবে; যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষা করবে এবং ইরানকে বিচ্ছিন্ন রাখবে।
আদতে ট্রাম্প ও বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাসংগ্রাম এবং সার্বভৌমত্বের সমাপ্তি ঘটানোর জন্য কাজ করেছে। তারা উভয়েই এমন একটি নতুন মধ্যপ্রাচ্য তৈরি করতে চায়, যেখানে ইসরায়েল আরও শক্তিশালী অর্থনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করবে, যা যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থ রক্ষা করবে।
মুহান্নাদ আয়াশ দ্য প্যালেস্টিনিয়ান পলিসি নেটওয়ার্কের নীতি বিশ্লেষক
আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনূদিত