শুল্ক–সুবিধা পেয়েও চীনে কেন আমাদের রপ্তানি বাড়ছে না

‘চীন বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য–ঘাটতি রয়েছে।’

বাংলাদেশ-গণচীনের মধ্যে যখন ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কছাড়ের ব্যবস্থা রেখে নতুন বাণিজ্য চুক্তির খসড়া চূড়ান্ত হয়, তখন চীনে নিযুক্ত তৎকালীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আমার সহপাঠী মাহবুব উজ জামান, চুক্তির প্রধান কারিগর ও বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক শরিফা খান ও তৎকালীন বাণিজ্যসচিব তপন কান্তি ঘোষসহ প্রায় পুরো টিমকে আমি ও আমরা অনেক অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। এর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রায় সবাই খুব ভালো কাজ করেছিলেন। তবে দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, আমরা এখনো এই চুক্তির আওতায় সেই দেশে রপ্তানি বাড়াতে পারিনি।

চীন বাংলাদেশের বড় বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও দুই দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য–ঘাটতি রয়েছে। এই বাণিজ্য–ঘাটতি কমিয়ে আনতে চীনা বিনিয়োগকারীদের ইতিমধ্যে বাংলাদেশে উন্নত প্রযুক্তি ও তৈরি পোশাক খাতের সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছেন আমাদের দেশের ব্যবসায়ী নেতারা। তাঁদের আশা, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন চীন সফরে এসব বিষয় গুরুত্ব পাবে।

আমরা সবাই জানি, চীন বিশ্বের বড় রপ্তানিকারক ও দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। একই সঙ্গে দ্বিতীয় আমদানিকারক দেশও। এই বাজারে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও উন্নত প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতা–সক্ষমতার অভাবে আমরা তা কাজে লাগাতে পারছি না।

পত্রিকান্তরে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরকালে চীনের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হতে পারে। দুই দেশের বাণিজ্য বাড়াতে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) নিয়েও সম্ভাব্যতা যাচাই শেষ হয়েছে। সফরকালে এ বিষয়ে যৌথ ঘোষণা আসতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশ ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার সমান চীনা মুদ্রা আরএনবি ঋণসহায়তা চাইবে বলে কথাবার্তা চলছে।

এমওইউ বিষয়ে গত ২৬ জুন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় হয়েছে। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপও পাঠানো হয়েছে। গেলো বুধবার এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। এ ছাড়া চীনও এ বিষয়ে সম্মতি প্রকাশ করেছে।

আমাদের দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, চীনের উৎপাদন ও সরবরাহ লাইন বহুমুখী করার বেশ আগ্রহ রয়েছে। কম মজুরি ও উন্নত সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশ চীনের উৎপাদন খাতের আঞ্চলিক হাবও হতে পারে।

২০২২ সালে চীন তার বাজারে বাংলাদেশকে ৯৯ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিলেও বাংলাদেশ সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারছে না; বরং দেশটিতে রপ্তানি আরও কমেছে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুসারে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশটিতে রপ্তানি হয়েছে ৬৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য। আগের অর্থবছরে তা ছিল ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।

একই সঙ্গে কমেছে দেশটির বিনিয়োগও। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) তথ্যানুসারে, সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ এসেছে ৯ কোটি ৩২ লাখ ডলার। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা ছিল ১১৫ কোটি ৯৫ লাখ ডলার। ২০০০ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত দেশটির মোট বিনিয়োগ ১২৫ কোটি ৬২ লাখ ডলার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুসারে, বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ২৪ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৪০০ কোটি ডলার। বাংলাদেশ ৬৭ কোটি ৭০ লাখ ডলারের পণ্য রপ্তানি করে। বিপরীতে চীন ২ হাজার ২৯০ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি করে।
বাংলাদেশ প্রধানত তৈরি পোশাক, পাট, পাটজাত পণ্য, মাছ ও চামড়া রপ্তানি করে থাকে। এটি চীনের মোট আমদানির শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ মাত্র।

আরও পড়ুন

অন্যদিকে বাংলাদেশ আমদানি করে মূলত মূলধনি যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, ভোগ্যপণ্য ও অন্যান্য যন্ত্রাংশ ও কাঁচামাল। বৈশ্বিক বাণিজ্য সংস্থা ডব্লিউটিওর তথ্যমতে, ২০২২ সালে দেশটি ২ দশমিক ৭২ টিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করে। সেই দেশটিতে আমরা যদি মাত্র ১ শতাংশ পণ্য রপ্তানি করতে পারি, তাহলে দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় ২৭ বিলিয়ন বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।

ইতিমধ্যেই বলা হয়েছে, বিশ্বের জোগানদার খ্যাত চীনের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য–ঘাটতি বিশাল। সফরকালে এই ব্যবধান কমিয়ে আনতে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা চাইবেন বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়ানো। একই সঙ্গে বিনিয়োগ করা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থেকে আবার রপ্তানি করা গেলে এই বাণিজ্য–ঘাটতি একসময় কমে আসবে। বাংলাদেশে চীনের প্রায় ৩০০ প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ রয়েছে। এটা ১০ গুণ বৃদ্ধি হতে পারে।

আমাদের দেশের শীর্ষ রপ্তানি আয়ের খাত তৈরি পোশাক। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলেন, চীনের উৎপাদন ও সরবরাহ লাইন বহুমুখী করার বেশ আগ্রহ রয়েছে। কম মজুরি ও উন্নত সংযোগ শিল্পে বিনিয়োগের সুযোগ থাকায় বাংলাদেশ চীনের উৎপাদন খাতের আঞ্চলিক হাবও হতে পারে।

ভারত যেমন ‘মেক ইন ইন্ডিয়া টেক টু অ্যানিহোয়ার’ নীতির আওতায় অনেক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পেরেছে, তেমনি বিনিয়োগের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে কানাডা, ইউরোপ, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশে আবার রপ্তানির মাধ্যমে চীন শুল্কমুক্ত সুবিধা পেতে পারে। চীনের আমদানিকৃত পোশাকের বাজার ১০ বিলিয়ন ডলার। এ ছাড়া দেশটির অভ্যন্তরীণ পোশাকের বাজার ৩৩০ বিলিয়ন ডলার।

ভারতে যেমন সম্প্রতি মার্কস অ্যান্ড স্পেন্সার ও ডেকাথালন স্টোরে ‘মেড ইন বাংলাদেশ’ পণ্যের বিক্রি অনেক বেড়েছে, তেমনি চীনের তৈরি পোশাক ও বস্ত্র খাতের বিশাল বাজারেও আমাদের অনেক সুযোগ আছে, বিশেষ করে সেই দেশের চেইন স্টোর বা ব্র্যান্ড শপগুলোয়। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই চীনে এইচঅ্যান্ডএম, জারা, গ্যাপ, ইউনিক্লোর স্টোরের সংখ্যা বাড়ছে। এই ব্র্যান্ড শপগুলোর প্রতিটিতেই বাংলাদেশ অন্যান্য দেশের মতো একই চুক্তির আওতায় ট্রান্সশিপমেন্ট করতে পারে।

সেই সঙ্গে নতুন চুক্তির আওতায় আমরা সহজেই হিমায়িত মৎস্য এবং বিশেষ কিছু কৃষিপণ্যও রপ্তানি করতে পারি। তার জন্য অবশ্য প্রয়োজন সরকার ও ব্যক্তি খাতের উদ্যোক্তাদের সমন্বিত উদ্যোগ। চীনে আমাদের রপ্তানি শিগগির এক শ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাওয়া উচিত।

  • মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক।