দুটো ছাগল কালো, বাকিসব সাদা?

আমরা টাকার কুমিরদের খবর পড়ছি। তাঁরা কেবল টাকার কুমির নন, তাঁরা মাটিখেকো, বিঘার পর বিঘা জমি কিনেছেন, তাঁরা বাড়ি-গাড়ি-রিসোর্ট-শেয়ার এত করেছেন যে তার তালিকা ছেপে শেষ করা যাচ্ছে না। খবরের কাগজের পাতা শেষ হয়ে যাচ্ছে, ছাপাখানার কালিতে টান পড়ছে, তবু সম্পদের বিবরণ আর শেষ হয় না।

এখন প্রশ্ন হলো, এই টাকার কুমিরেরা কি নিজ নিজ পেশার ক্ষেত্রে বিরল ব্যতিক্রম, নাকি সাধারণ নিয়ম। নিশ্চয়ই সৎ মানুষ সব পেশাতেই আছেন, অসৎ মানুষ নেই, এমন কোনো পেশাও থাকতে পারে না। কিন্তু নিয়ম কোনটা?

ওই ভদ্রলোক কি আসলেই একটা বিরল নজির, নাকি ওই এলাকায় এই রকম আরও অনেকেই আছেন, কম আর বেশি! ‘রাজ’ আর ‘স্ব’ দুটো একখানে করলে যে ক্ষেত্রটা আমরা পাই, সেখানে এই রকম শুভ্রকান্তি হিরে-মোতি কি আরও আছে? নাকি তিনিই একমাত্র! আমগাছে হঠাৎই একটা তেঁতুল ধরেছে, নাকি অনেক আমই সেই রকম টক!

আকবর আলি খান পরার্থপরতার অর্থনীতি বইয়ের লেখা স্মরণ করতে পারি—

ষোড়শ শতকের কবি মুকুন্দরাম লিখেছেন:

‘সরকার হইলা কাল খিল ভূমি লিখে লাল

বিনা উপকারে খায় ধুতি’

সরল ভাষায় এর অর্থ নিম্নরূপ, রাজস্ব কর্মকর্তা (সরকার) অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনাবাদি জমিকে কর্ষিত জমি গণ্য করছে (যার ফলে অতিরিক্ত খাজনা দিতে হবে) এবং ধুতি ঘুষ নিয়েও সঠিকভাবে কাজ করছে না। মুকুন্দরামের লেখা পড়ে মনে হয় ঘুষ দেওয়াতে তাঁর দুঃখ নেই। তাঁর দুঃখ হলো ধুতি উৎকোচ দিয়েও কাজ হচ্ছে না। বাংলা লোকসাহিত্যেও এ ধরনের দুর্নীতির উল্লেখ রয়েছে। ‘মলুয়া’ লোকগীতিতে স্থানীয় কাজী সম্পর্কে নিম্নরূপ বর্ণনা দেখা যায়:

‘বড়ই দুরন্ত কাজী ক্ষেমতা অপার

চোরে আশ্রা দিয়া মিয়া সাউদেরে দেয় কার

ভাল মন্দ নাহি জানে বিচার আচার

কূলের বধূ বাহির করে অতি দুরাচার।’

(বড় দুরন্ত কাজীর অপার ক্ষমতা রয়েছে। সে চোরকে আশ্রয় দেয়, সাধুকে দেয় কারাবাস, ভালো মন্দ বা আচার বিচার জানে না। সে এতই খারাপ যে কুলের বধূদের ঘর থেকে বের করে নিয়ে আসে)।

আমাদের স্যারেরা সবই খাচ্ছেন, মাটি খাচ্ছেন, বন খাচ্ছেন, নদী খাচ্ছেন, গদি খাচ্ছেন, ডক্টরেট ডিগ্রি খাচ্ছেন, শুদ্ধাচার পুরস্কার খাচ্ছেন, ইহজগতে এমন কিছু নাই যা তাঁদের উদরস্থ হচ্ছে না। কিন্তু এমপি পদে তিনবার মনোনয়ন পাচ্ছেন যিনি, তিনি নিজেই সোনা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এই খবরও আমাদের পড়তে হলো!

আকবর আলি খানের ‘শুয়োরের বাচ্চাদের অর্থনীতি’ প্রবন্ধের নামকরণের পেছনে ছিল:

ব্রিটিশ আমলের আসানসোলের মহকুমা প্রশাসক মাইকেল ক্যারিটকে এক পাঞ্জাবি ঠিকাদার বলেছিল, ‘হুজুর এ দেশে তিন ধরনের মানুষ আছে। যারা ঘুষ খায় না। যারা ঘুষ খায় এবং কাজ করে। আর তিন নম্বর দলে আছে কিছু শুয়োরের বাচ্চা, যারা ঘুষও খায় কিন্তু কাজ করে দেয় না।’

হুতোম প্যাঁচার নক্‌শায় আছে: ‘পুলিশের সার্জন-দারোগা-জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’

বঙ্কিমচন্দ্র লিখেছিলেন, ‌‘আমাকে তলব হইল। আমি তখন দেবাদিদেবের কাছে আসিয়া যুক্তকরে দাঁড়াইলাম। কিছু গালি খাইলাম। আসামীর শ্রেণিতে চালান হইবার গতিক দেখিলাম। বলিব কী? ঘুষাঘুষির উদ্যোগ দেখিয়া অলঙ্কারগুলি সকল দারোগা মহাশয়ের পাদপদ্মে ঢালিয়া দিলাম। তাহার উপর পঞ্চাশ টাকা নগদ দিয়া নিষ্কৃতি পাইলাম।’

তো সেই ‘মঙ্গলকাব্য’–এর আমল থেকে হুতোম প্যাঁচার নক্‌শা হয়ে বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ পর্যন্ত ভয়াবহ অবস্থা দেখি। পার্থক্য হলো, আগে সিকি-আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক পরিপূর্ণ ছিল, ঘুষ হিসেবে ধুতি নিলেও চলত, স্বর্ণালংকারের ওপরে নগদ দিতে হতো পঞ্চাশ টাকা। আর এখন?

আমাদের স্যারেরা সবই খাচ্ছেন, মাটি খাচ্ছেন, বন খাচ্ছেন, নদী খাচ্ছেন, গদি খাচ্ছেন, ডক্টরেট ডিগ্রি খাচ্ছেন, শুদ্ধাচার পুরস্কার খাচ্ছেন, ইহজগতে এমন কিছু নাই যা তাঁদের উদরস্থ হচ্ছে না। কিন্তু এমপি পদে তিনবার মনোনয়ন পাচ্ছেন যিনি, তিনি নিজেই সোনা চোরাচালানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, এই খবরও আমাদের পড়তে হলো!

আরও পড়ুন

রাজস্ব কর্তা মতিউর রহমানের বাড়ি বরিশালের মুলাদীতে প্রথম আলোর প্রতিবেদক যান সরেজমিন অনুসন্ধানে। গ্রামবাসী এগিয়ে এসে বলেছেন, ‘মতিউর সাহেব অনেক ভালো মানুষ। শুধু শুধু তাঁর নামে বদনাম করা হচ্ছে।’ আরেকজন বলেন, ‘সবার মাথার চুলই তো কালো।’

এঁরা লুৎফর রহমান রিটনের আবদুল হাই:

আবদুল হাই

করে খাই খাই

এক্ষুনি খেয়ে বলে

কিছু খাই নাই।

...

গরু খায় খাসি খায়

টাটকা ও বাসি খায়

আম খায়

জাম খায়

টিভি প্রোগ্রাম খায়।

খায় তো বটে, তবে কি কেবল এই দুজনই খায়।

সবার মাথার চুল কি কালো? নাকি সাদা চুলের মানুষও আছেন এই বদ্বীপে?

সাদা-কালো প্রসঙ্গ এলে এই কৌতুকটা না বলে পারা যায় না।

উপস্থাপক টেলিভিশনের ক্যামেরায় একজন ছাগলচাষির সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন।

উপস্থাপক: আপনি আপনার ছাগলকে কী খাওয়ান?

ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?

উপস্থাপক: কালোটারে...

ছাগলচাষি: ঘাস।

উপস্থাপক: আর সাদাটারে?

ছাগলচাষি: ওইটারেও ঘাস খাওয়াই।

উপস্থাপক: ও আচ্ছা। আপনে ওইগুলানরে রাতে কই রাখেন?

ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?

উপস্থাপক: কালোটারে?

ছাগলচাষি: ওইটারে বাইরের ঘরে বাইন্দা রাখি।

উপস্থাপক: আর সাদাটারে?

ছাগলচাষি: ওইটারেও বাইরের ঘরে বাইন্দা রাখি।

উপস্থাপক: আপনি ওগুলানরে কী দিয়া গোসল করান?

ছাগলচাষি: কোনটারে? কালোটা না সাদাটা?

উপস্থাপক: কালোটারে?

ছাগলচাষি: পানি দিয়া গোসল করাই।

উপস্থাপক: আর সাদাটারে?

ছাগলচাষি: ওইটারেও পানি দিয়া গোসল করাই।

উপস্থাপক: সবকিছু দুইটার বেলায় একই রকম করলে তুই বারবার কালোটারে সাদাটারে জিগাস কেন?

ছাগলচাষি: কারণ, কালো ছাগলটা আমার।

উপস্থাপক: আর সাদা ছাগলটা?

ছাগলচাষি: ওইটাও আমার।

আমাদের খামারে যে সাদা ছাগল আছে, তাও আমাদের, আর যে কালো ছাগল আছে, সেও আমাদেরই। আমাদের খামারে কি শুধু দুটো ছাগল কালো, বাকি সব সাদা? ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। রোম বাছতে গেলে কম্বল হবে শেষ।

কিন্তু আমরা কি দিন দিন অধঃপতিত হতেই থাকব। তলানিতে কি আমরা পৌঁছে যাইনি। আমাদের কি ঘুরে দাঁড়ানোর সময় পার হয়ে যায়নি?

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক