নির্বাচন কমিশনে পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করার সময় শুধু গতানুগতিক নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব নয়, বরং অনেক আলোচিত ও সমালোচিত পরিবর্তন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় নতুন কিছু করার প্রক্রিয়ায় আমরা জড়িত ছিলাম।
এর মধ্যে অন্যতম ছিল ছবিসহ ডিজিটাল পদ্ধতিতে ভোটার তালিকা প্রণয়ন এবং একই সঙ্গে সম্ভাব্য ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে এসে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি করা ও শনাক্তকরণ কার্ড প্রদান। এ কার্ডই আজ জাতীয় পরিচয়পত্র হিসেবে পরিচিত। ডিজিটাল তথ্য সংগ্রহশালা গঠন এবং উপজেলা পর্যন্ত এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে সার্ভার স্টেশন তৈরি, আইন এবং নির্বাচন প্রচারণায় ব্যাপক সংস্কার করতে গিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে প্রচুর অভিজ্ঞতা হয়েছে।
শুধু তা–ই নয়, এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাধারণ জনগণ ও সরকারের আমলাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মেশার বিরল সুযোগ হয়েছে। এই অভিজ্ঞতা আগে আমার ছিল না। নির্বাচন কমিশন ছাড়ার পরও দুই ধাপে মোট ছয় বছর অধিকতর পড়াশোনা করে নির্বাচনের মতো কারিগরি ও জটিল বিষয়ে সম্যক জ্ঞান অর্জনের চেষ্টায় এখন রত রয়েছি।
বিচারপতি আজিজ কমিশনকে যেভাবে জনগণের অনাস্থার মধ্যে বিদায় নিতে হয়েছিল, তা সবার জানা। সেই অবস্থা থেকে কমিশনের আস্থা ফেরানোর জন্য ড. শামসুল হুদা কমিশনের একজন কমিশনার হিসেবে সমষ্টিগত এবং ব্যক্তিগতভাবে যথেষ্ট পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে একটা পর্যায়ে নিয়ে আসার পর পরপর দুটি কমিশনের ব্যর্থতা আমাকে এবং আমার মতো অনেককেই ব্যথিত করেছে। দুই কমিশনের ব্যর্থতার জায়গাগুলো বিশ্লেষণ করে অনেক প্রবন্ধ লিখেছি। এমনকি বর্তমানের হাবিবুল আউয়াল কমিশনের কিছু কর্মকাণ্ডের ওপরও বিশ্লেষণ করেছি এবং তাদের প্রতি কিছু পরামর্শ রেখেছি। এরই ধারাবাহিকতায় সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া দু–একটি বিষয়ের ওপর আমার মতামত তুলে ধরতে চাই।
অবশ্যই তদন্তটি হতে হবে নির্মোহ এবং এই নির্বাচনকে কলুষিত করার পেছনে যারাই দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মামলা করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই নির্বাচন এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে, তবে এককভাবে কমিশনকে সম্ভাব্য সব অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
২.
গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাকে রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এবং তাঁর তত্ত্বাবধানে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। যেখানে ১৪৫টি কেন্দ্রে প্রতিটি বুথে সিসিটিভি ক্যামেরা বসিয়ে নির্বাচন পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়।
ভোট গ্রহণের দিন প্রথমে দুপুর ১২টার দিকে ব্যাপক অনিয়মের কারণে কিছু কেন্দ্রের ভোট গ্রহণ স্থগিত করা হয়। কারণ, ঢাকায় নির্বাচন কমিশনের সদর দপ্তরে স্থাপিত মনিটরিং রুমে নির্বাচন কমিশনারদের উপস্থিতিতে নির্বাচন পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছিল। পরে অনিয়মের ব্যাপকতা বিবেচনায় নিয়ে কমিশন নির্বাচন শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে। এ নিয়ে এখন বাদানুবাদ চলছে। অনেক কেন্দ্রের সিসিটিভি ক্যামেরার সংযোগ বিচ্ছিন্ন বা অকেজো করা হয় বলে জানা গেছে।
তা ছাড়া চরাঞ্চলে সিসিটিভি ক্যামেরার জন্য যে রাউটার ব্যবহার করা হয়, তা অকেজো বা ভালোভাবে কাজ না করায় ওই সব জায়গায় ফুটেজ রেকর্ড করা সম্ভব হয়নি এবং কিছু কেন্দ্রের ফুটেজ স্থানীয়ভাবে পাওয়া যায়নি। জানা গেছে, কমবেশি ৫৮টি কেন্দ্রের অবস্থা স্বচক্ষে অবলোকনের পর নির্বাচন কমিশন আরপিও-এর ধারা ৯১ (৭) এবং সংবিধানের ১১৯ ধারার আওতায় তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক সম্পূর্ণ নির্বাচন বন্ধ করেছে এবং সাত দিনের মধ্য তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে।
সরকারি দল নির্বাচন কমিশনের সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে নির্বাচন স্থগিত করার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। অন্যদিকে দেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপি এবং তাদের সমর্থিত দলগুলো বলছে, এটা পাতানো খেলা। অন্যদিকে ৯১ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন ভাষায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে দাবি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে চিঠি পাঠিয়েছেন। তাঁদের অনেকে অবশ্য পরে সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁদের কাছ থেকে এসব বক্তব্য আদায় করা হয়েছে।
এটা অত্যন্ত গর্হিত এবং আইনবহির্ভূত কাজ। এখানে বলে রাখা ভালো, এই উপনির্বাচনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে কোনো দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কাজেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে কেন প্রতিবেদন পাঠানো হলো, তা বোধগম্য নয়। তা ছাড়া এসব প্রতিবেদনের প্রতিলিপি রিটার্নিং কর্মকর্তা ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে কেন দেওয়া হলো না এবং কার নির্দেশে এ ধরনের প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে, তা জানা যায়নি। তদন্তের আগেই সংবাদমাধ্যমে বক্তব্য দিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে, যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। যা–ই হোক, তদন্ত চলমান। আশা করা যায়, এসবের উত্তর পাওয়া যাবে।
৩.
ওপরের আলোচনা, পরিস্থিতির বিশ্লেষণ এবং সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়া ফুটেজ বিবেচনায় নিলে প্রাথমিকভাবে সন্দেহাতীতভাবেই বলা যায় যে নির্বাচনে দুর্নীতি হয়েছে। নির্বাচন কমিশন বা এ ক্ষেত্রে যাঁরা বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিবেচিত, তাঁদের এ নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। আন্তর্জাতিক গবেষকেরা নির্বাচনে কারচুপির ধরন, কারচুপি শনাক্ত করা এবং কারচুপির কারণ নিয়ে নানামুখী ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করেছেন।
একটি নির্বাচনে, যে ধরনের বা যে পরিসরেই হোক, বিভিন্ন প্রার্থী কারচুপি করতে মনস্থ করলে ভোটকেন্দ্র এবং বুথকেই টার্গেট করে থাকেন। এই উপনির্বাচনেও তা–ই হয়েছে। এখানে দুই মূল প্রার্থী যে জিততে মরিয়া ছিলেন, তা স্পষ্ট।
যেকোনো উপায়ে জিতে আসার প্রবণতা থেকেই অন্যায় পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই পরিস্থিতিতে সব কেন্দ্র দখল করে অবৈধভাবে ভোট প্রদানের চেষ্টা সাধারণ দেখা যায় না। যা হয় তা হলো, পূর্বনির্ধারিত কিছু ভোটকেন্দ্র দখল এবং সেখানে প্রতিপক্ষ থেকে বহুগুণ ভোট দেখানো অথবা নিরঙ্কুশ বিজয় দেখানো।
ইতিমধ্যে নির্বাচন কমিশন একটি পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে, তাই এ মুহূর্তে নির্বাচনের সম্ভাব্য, অনিয়মের আঙ্গিক নিয়ে বেশি মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।
অবশ্যই তদন্তটি হতে হবে নির্মোহ এবং এই নির্বাচনকে কলুষিত করার পেছনে যারাই দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা এবং ক্ষেত্রবিশেষে মামলা করার উদ্যোগ নিতে হবে। এই নির্বাচন এবং নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নির্বাচন কমিশনের নিশ্চয়ই এই অভিজ্ঞতা হয়েছে যে প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ আচরণ না করে, তবে এককভাবে কমিশনকে সম্ভাব্য সব অস্ত্র ব্যবহার করতে হবে।
শেষ করার আগে একটি বিষয়ে বলতে চাই, বুথ দখল হলে ইভিএম কেন, কোনো যন্ত্রই কাজ করবে না। কাজেই ইভিএমের পেছনে অর্থ ও শ্রম খরচ না করে সিসিটিভি ক্যামেরার মতো প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা উচিত।
নির্বাচন কমিশন যে শক্ত পদক্ষেপ নিতে পেরেছে, সে জন্য তাদের ধন্যবাদ এবং অভিনন্দন জানাই। আশা করব, এ ধরনের শক্ত অবস্থান থেকে সরে আসবে না। এটাই বাংলাদেশের নির্বাচনের ইতিহাসে প্রথম নজির।
অতীতে এমনটি দেখা যায়নি। এ ধরনের শক্ত পদক্ষেপ যদি ১৯৯৪ সালের মাগুরা উপনির্বাচনে নেওয়া যেত, তাহলে হয়তো বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস অন্য রকম হতো।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন নির্বাচন বিশ্লেষক, সাবেক সামরিক কর্মকর্তা এবং এসআইপিজির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো (এনএসইউ)