ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনে সেনা পাঠাতে চাইছে এবং ন্যাটোর কয়েকটি দেশ রাশিয়ার ভেতরে হামলা চালানোর দাবি জানিয়েছে। এই ফাঁকে যুক্তরাষ্ট্র গোপনে ইউক্রেন নিয়ে তাদের নীতি বদলে ফেলছে। নতুন এই নীতিতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি যা চাইছেন তার সবটা পূরণ হবে না; কিন্তু রাশিয়ার অনেক ভেতরে হামলা চালানোর সুযোগ খুলে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন অবশ্য বলছেন, রাশিয়ার অনেক ভেতরে হামলা চালানোর অনুমতি যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে, এমন খবর অপতথ্য ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের ইউক্রেন নীতির বদলে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেনি। ব্লিঙ্কেন বলছেন রাশিয়ানদের দিক থেকে এই অপতথ্য ছড়ানো হয়েছে। কিন্তু এই প্রতিবেদন ওয়াশিংটনের দিক থেকে আসেনি, এসেছে রাশিয়ার দিক থেকে।
কী হচ্ছে তাহলে? ইউক্রেন একেবারে ধ্বংসের কিনারে। ইউক্রেন এমনিতেই সেনা–ঘাটতিতে রয়েছে। তারপর দিন যত গড়াচ্ছে, যুদ্ধে হতাহত মানুষের সংখ্যা ততই বাড়ছে। রাশিয়ানদের একটি সূত্র বলছে, মে মাসে ৩৫ হাজারের মতো ইউক্রেনীয় সেনা হতাহত হয়েছেন। সেনাবাহিনীর এই শূন্যতা ইউক্রেন পূরণ করতে পারছে না। বাধ্যতামূলকভাবে সেনাবাহিনীতে নিয়োগের যে কর্মসূচি ইউক্রেন নিয়েছে, তার প্রক্রিয়াটা এখন চলমান। প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
একটা উড়ো খবর ছড়িয়ে পড়েছে যে রাশিয়ানরা যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন করে বড়সংখ্যক সেনা পাঠিয়ে নিজেদের শক্তি বাড়াতে চলেছে। অনেকে মনে করছেন, খারকোভ অঞ্চলে শক্তি বাড়াতেই যুদ্ধক্ষেত্রে নতুন করে সেনা বাড়াচ্ছে রাশিয়া। অন্যরা মনে করছেন, সামি অঞ্চলে নতুন যুদ্ধফ্রন্ট খুলতে চাইছে রাশিয়া। আবার কেউ কেউ রাশিয়া খুব শিগগির নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে হামলা জোরদার করবে, যাতে আরও বেশি ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ তারা নিয়ে নিতে পারে।
ন্যাটোর নেতারা ভয় পাচ্ছেন যে রাশিয়ানদের আক্রমণের চাপে ইউক্রেনের পতন ঘটতে পারে। রাশিয়া এরপর কী করতে চলেছে, তা তারা ভালো করেই অনুমান করতে পারছেন; কিন্তু ইউক্রেনকে রক্ষা করার মতো বিকল্প তাদের হাতে খুব কমই রয়েছে। তাঁরা ভালো করেই জানেন যে ইউক্রেনে ছোট সংখ্যক সেনা পাঠানো কোনো সমাধান নয়। তাতে ইউরোপ ‘বডিব্যাগ’–এ ভরে উঠবে।
ন্যাটো রাশিয়ার সঙ্গে কোনো সমঝোতায় যেতে চায় না। বিশেষ করে নির্বাচনের আগে জো বাইডেনের জন্য সেটি হবে বড় ধরনের বিপর্যয়কর ঘটনা। রাশিয়ার সঙ্গে এখন চুক্তিতে আসা মানে বড় ধরনের ছাড় দেওয়া। সেটি শুধু ইউক্রেনের ভূখণ্ড নয়, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎও।
ইউক্রেন থেকে ন্যাটোকে চলে যেতে হবে—রাশিয়া তার অবস্থান থেকে পিছু হটবে না। কেবলমাত্র ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চয়তার ব্যাপারে কিছুটা সম্মতি দিতে পারে রাশিয়া; কিন্তু এই নিশ্চয়তার মূল্যটাই–বা কতটুকু। ইউক্রেনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র কি যুদ্ধ করতে যাবে?
ন্যাটো পরীক্ষিত ও খাঁটি সামরিক শক্তি কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্র; কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের সেনাদল অভিযাত্রিক ও আকারে ছোট। রাশিয়ার স্থলবাহিনীর সঙ্গে তাদের তুলনা চলে না।
যুক্তরাষ্ট্রের ‘নতুন নীতি’তে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলার অনুমোদন দেওয়া হলেও এর প্রভাব খুবই সামান্য। কেননা, ইউক্রেন তাদের অস্ত্র ও ড্রোন দিয়ে এরই মধ্যে রাশিয়ার ভেতরে হামলা করেছে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সীমাবদ্ধতা হলো, যুক্তরাষ্ট্র তাদের স্ট্র্যাটেজিক (কৌশলগত) এটিএসিএমএস মিসাইল দিয়ে রাশিয়ার অভ্যন্তরে (একমাত্র ক্রিমিয়া ছাড়া। ইউক্রেনের এই ভূখণ্ডকে ২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া নিজেদের বলে দাবি করে আসছে) হামলা চালাতে দেবে না।
রাশিয়ানরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন নীতি অনেকাংশে অর্থহীন। তার কারণ হলো, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর অস্ত্র দিয়ে এরই মধ্যে রাশিয়ার ভূখণ্ডে হামলা করেছে ইউক্রেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো বলতে চাইছে তারা দূরপাল্লার অস্ত্র ও নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুর গোয়েন্দা তথ্য ইউক্রেনকে দেওয়ার কথা বলছে। এটা আদৌ নতুন নীতি নয়।
রাশিয়ার অনেক ভেতরে হামলা হবে—এটা শুনতে খুব আকর্ষণীয়। কিন্তু এ ধরনের হামলা ইউক্রেন যুদ্ধের গতিধারাকেই বদলে দিতে পারে। ইউক্রেন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতিবদলকে দু-একটি ছাড়া বেশির ভাগ ন্যাটোর সদস্যরাষ্ট্র স্বাগত জানিয়েছে। হাঙ্গেরি শুরু থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সম্পৃক্ততার বিরোধী। এবারও দেশটি রাশিয়ার ভেতরে হামলার বিরোধিতা করেছে।
ইতালিও ন্যাটোর এমন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। জার্মানি তাদের দিক থেকে রাশিয়ার ভেতরে হামলার সমর্থন জানালেও ইউক্রেনকে তাদের তাওলাস মিসাইল দিচ্ছে না।
ন্যাটোর এই নতুন নীতির প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া কী করবে সেটি এখনই বলা যাচ্ছে না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে নতুন এই নীতি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ন্যাটোর যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।
এর মানে হচ্ছে, রাশিয়া প্রতিশোধ নিতে চাইবে। সে ধরনের কোনো প্রতিশোধের ঘটনা ইউরাপে বড় পরিসরে যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে।
সামগ্রিক ফলাফল হলো, ইউক্রেন যুদ্ধ অব্যাহত থাকবে। ন্যাটো আরও ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়বে, তাদের সেনারাও হতাহত হতে পারেন। এই দৃশ্যপটের বাইরে ন্যাটো যদি রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালায় কিংবা ইউক্রেনে স্থলসেনা পাঠায়, তাহলে ইউরোপের পরিস্থিতি শোচনীয় হবে। ন্যাটো যদি বড় কোনো যুদ্ধে জড়ায়, তাহলে সেটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হবে, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে গভীরভাবে যাঁরা চিন্তা করেন, তাঁরা এই উপলব্ধিতে এসেছেন।
এরপরও ন্যাটোর কয়েকটি দেশ বোধহয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টা অন্যখানে রয়েছে। ন্যাটো কি তাহলে নিজের মৃত্যু ডেকে আনছে?
স্টিফেন ব্রায়েন, যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বৈদেশিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির সাবেক প্রধান পরিচালক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত