স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত জবাবদিহিমূলক গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল সরকারকেই এ দেশ পরিচালনার দায়িত্বে থাকতে হবে। তাই অন্তর্বর্তী এই সরকারকে বাংলাদেশে স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা বা প্রক্রিয়া সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য সঠিকভাবে প্রয়োজনীয় সব সংস্কার করতে হবে। নাগরিক সমাজের কাছে যেকোনো নির্বাচিত সরকারকে তাদের কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহির ব্যবস্থা আনয়ন করতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এটিই নাগরিক সমাজের প্রধান প্রত্যাশা। এ ছাড়া গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয় নিচে উপস্থাপন করা হলো:
১. বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামে পরিচিত হবে। প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হবে। সাংবিধানিক এই বিবৃতি থেকে এটা স্পষ্ট যে প্রজাতন্ত্রের ক্ষমতার মালিকানা প্রশ্নে জনগণ সবাই সমান, জনগণের মধ্যে এখানে কোনো অসমতা করা হয়নি। এ বিষয়ে সবাই সমান ক্ষমতার ও মর্যাদার।
সংসদের নির্বাচনের জন্য প্রতিটি আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকার একটি করে ভোটার তালিকা থাকবে এবং ধর্ম, জাত, বর্ণ ও নারী-পুরুষভেদের ভিত্তিতে ভোটারদের বিন্যস্ত করে কোনো বিশেষ ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা যাবে না। সাংবিধানিক এই ধারা নিশ্চিত করে যে দেশের সবার ভোটাধিকার সমান এবং সবার ভোটের মূল্যও সমান। অর্থাৎ ভোট প্রদানের অধিকার ও ভোটের মূল্য বিবেচনায় নাগরিক সবাই সমান।
আবার সংবিধানের ২৭ নম্বর ধারায় সরাসরি বলা আছে, সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সব নাগরিকের প্রথম মৌলিক পরিচয় এ দেশের নাগরিক। এই মৌলিক পরিচয়ে, একজন নাগরিক এবং একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি উভয়ে সমান। দুর্ভাগ্য আমাদের, স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও এটা বিরল যে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দেশের নাগরিকদের যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করতে দেখা যায়। নাগরিকদের প্রতি ন্যূনতম সম্মান প্রদর্শন করাও অনেকের জন্য কঠিন হয়ে যায়। নাগরিকের সাংবিধানিক মর্যাদা ও অধিকার, এটা তো কোনো জনপ্রতিনিধির অজ্ঞতা হতে পারে না। তাহলে কি বলব যোগ্যতার অভাব; নাকি আমাদের সংস্কৃতিই এমন?
এ দেশের নাগরিকেরা যদি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্মানিত ও মাননীয় বলে সম্বোধন করতে পারেন, জনপ্রতিনিধিদেরও উচিত নাগরিকদের যথাযথভাবে সম্মান দেওয়া। তাদের এসব অজ্ঞতা ও অযোগ্যতা দূরীভূত করতে হবে। সংস্কৃতি পরিবর্তনেরও উপযুক্ত সময় এখন। সেবা প্রদানে নিয়োজিত ব্যক্তিদেরও শিক্ষা নিয়ে নিজেদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। সরকারি নিয়মিত বা আনুষ্ঠানিক কাজে, কখনো ‘নাগরিক’ শব্দটি প্রয়োজন হলে, ‘সম্মানিত নাগরিক’ এ শব্দবন্ধ ব্যবহার করার প্রচলন করতে হবে। এ দেশের মানুষের প্রথম নাগরিক পরিচয়কে মর্যাদাপূর্ণ করতে হবে, যার সুফল সবাই পাবেন। কাজেই রাষ্ট্রে নাগরিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
২. ব্যক্তিগত, শিক্ষা ও পেশাগত কারণে ভিন্ন মহাদেশের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছি। সঙ্গে বাংলাদেশের সাধারণ সবুজ পাসপোর্ট ছিল। ভিসা পাওয়া থেকে শুরু করে বিদেশে ইমিগ্রেশন-সিকিউরিটি চেক, কোথাও কোনো বৈষম্যের শিকার হতে হয়নি। এটি একটি যোগ্যতার বিষয়। আর বিদেশ ভ্রমণে গুরুত্বপূর্ণ শর্ত বৈধ ভিসা থাকা। যোগ্যতার ঘাটতি থাকলে, লাল-নীল পাসপোর্ট নিয়েও সমস্যার সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
এ দেশে তিন ধরনের পাসপোর্টের প্রচলন রয়েছে: (ক) ডিপ্লোমেটিক পাসপোর্ট, যার কভার লাল; (খ) অফিশিয়াল পাসপোর্ট, যার কভার নীল এবং (গ) অর্ডিনারি পাসপোর্ট, যার কভার সবুজ। এই অর্ডিনারি সবুজ পাসপোর্ট সাধারণ নাগরিকদের জন্য নির্ধারিত। সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নীল অফিশিয়াল পাসপোর্ট। আর এমপি, মন্ত্রী ইত্যাদি কূটনৈতিক ব্যক্তিদের জন্য লাল পাসপোর্ট।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন রঙের পাসপোর্ট—এ বিষয়টি অস্বাভাবিক এবং বৈষম্যমূলক বটে। সাধারণ নাগরিক, সরকারি চাকরিজীবী, এমপি-মন্ত্রী সবাই এ দেশের নাগরিক। তাই পাসপোর্টের কভার সবার জন্য একই রকম হওয়া উচিত। পাসপোর্ট কভার এক রকম হওয়াটাই নৈতিক ও সাংবিধানিক। প্রয়োজনে পাসপোর্টের ভেতরে সরকারি চাকরিজীবী এবং এমপি-মন্ত্রী–কূটনীতিকদের জন্য ঐচ্ছিকভাবে শনাক্তকরণ ভিন্ন ভিন্ন লোগো ব্যবহার করা যেতে পারে। পাসপোর্টের ভেতরে আলাদা বা অতিরিক্ত পরিচিত যুক্ত করা সহজেই সম্ভব। এটাই সবার জন্য সুবিধাজনক। পাসপোর্ট নিয়ে লাল-নীল রঙের খেলা একটি অপ্রয়োজনীয় অহমিকার খেলা এবং এটি অবিলম্বে বন্ধ করা উচিত।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বিষয় রয়েছে। এয়ারপোর্টে ভিভিআইপি, ভিআইপি ইত্যাদি নামে ভিন্ন ভিন্ন প্রবেশ-বাহির পথ এবং লাউঞ্জের নামকরণ ও ব্যবস্থাপনা করা। মন্ত্রী, এমপি বা সরকারি কর্মকর্তা হলেই ভিভিআইপি ও ভিআইপি, আর বাকিরা সাধারণ? কী এক অসুস্থ চিন্তা ও সংস্কৃতি! প্রযোজ্য ভ্যাট–ট্যাক্স সবাই তো প্রদান করেন। কাজের সুবিধার্থে প্রবেশ-বাহির পথ, লাউঞ্জ ও সেবা কাউন্টারগুলো অতি জরুরি, জরুরি ও সাধারণ—এসব নামে বিভাজন করা যেতে পারে।
৩. যাতায়াত বিধি ও চর্চার সংস্কার প্রয়োজন। সরকারের একজন সচিবকে সময়মতো কর্মস্থলে পৌঁছে তার বিশেষ বা দৈনন্দিন কাজ শুরু করতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপককে সময়মতো ক্লাস নিতে এবং গবেষণা তদারকি করতে হয়। চিকিৎসককে রোগীদের সেবা দিতে হয়। অনুরূপভাবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাকে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ কাজ সঠিক সময়ে করতে হয়। নাগরিকেরাও নিজ নিজ উদ্দেশ্য নিয়ে রাস্তায় বের হয়ে থাকেন। সবার কাজ বা উদ্দেশ্য গুরুত্বপূর্ণ। সবারই সময়মতো কর্মস্থলে বা গন্তব্যে পৌঁছানো প্রয়োজন।
তা সত্ত্বেও একজন সরকারি প্রভাব খাটিয়ে যাতায়াত বিধি ভেঙে অন্যদের টপকে চলে যাচ্ছেন। যা বাকিদের জন্য ক্ষতিকরই নয়, অসম্মানজনক বটে। এ ধরনের কর্মকাণ্ড নাগরিক-পেশাজীবীদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে। তাই নাগরিক এবং সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা পেশাজীবী—সবার জন্য যাতায়াত বিধি সম্পূর্ণভাবে অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা নিশ্চিত করতে হবে।
এটা ঠিক যে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের চলাচলে নিরাপত্তা জরুরি। তাই তাঁদের ক্ষেত্রে যাতায়াত বিধির ব্যতিক্রম হতে পারে। তবে বাস্তবতা হলো রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্সকেও ক্ষেত্রবিশেষে আটকে দেওয়া হয়, কর্তাব্যক্তিদের জন্য। ভোগান্তি কমাতে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়ে এ বিষয়ে সংস্কার আনা প্রয়োজন।
৪. ভ্যাট-ট্যাক্স রাষ্ট্রের নিজস্ব অর্থ তহবিলের মূল উৎস। অনেক বড় অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয় এখানে।
এই খাতকে আরও স্বচ্ছ, গতিশীল ও কার্যকর করার প্রয়োজনীয়তা ও সুযোগ রয়েছে। নাগরিকদের আয়কর প্রযোজ্য হলে, তা পরিশোধ না করাই একটি বড় দুর্নীতি। যাঁদের ক্ষেত্রে আয়কর প্রযোজ্য, তাঁদের প্রত্যেককে এই প্রক্রিয়ার মধ্যে নিয়ে আসা উচিত। শুধু আয়কর দেওয়া নয়, সবাইকে সঠিক পরিমাণে আয়কর দিতে উদ্বুদ্ধ ও বাধ্য করতে হবে। সঠিক পরিমাণে আয়কর পরিশোধ করা রাষ্ট্রের প্রত্যেকের জন্য অন্যতম প্রধান বাধ্যবাধকতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
আয়কর রিটার্নের মাধ্যমে বছর বছর নিয়মিতভাবে আয়-ব্যয় ও সম্পদের সঠিক বিবরণ ও ঘোষণার বাধ্যবাধকতা রয়েছে পেশাজীবীদের জন্য। এই নিয়মের প্রয়োগ নিশ্চিত হতে হবে। সরকারি বিশেষ বিশেষ খাতের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদেরও ক্ষেত্রে এই নিয়মের প্রয়োগ নিশ্চিত হওয়া বিশেষভাবে প্রয়োজন।
সরকারের অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক ব্যক্তি এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের জন্য সঠিকভাবে আয়কর রিটার্ন জমা ও ছাড়পত্র নেওয়ার বিধান করে প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। সরকারের কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে এই নিয়ম ভঙ্গের প্রাথমিক প্রমাণ পাওয়া গেলেই সরকারি সুযোগ-সুবিধা স্থগিত হওয়ার বিধান প্রতিষ্ঠিত হতে হবে।
পরিশেষে, দীর্ঘকালের অনিয়ম–বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে এ দেশের সরকার রাজায় আর নাগরিক প্রজায় পরিণত হয়েছে। নাগরিকদের মৌলিক অধিকার ও মর্যাদা লুণ্ঠিত হয়েছে। ছাত্র-জনতার প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত আজকের এই সুযোগ; অন্তর্বর্তী সরকারকে তা বিশ্বস্ততা ও দক্ষতার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করতে হবে। নাগরিক মর্যাদা, অধিকার ও দায়িত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত হবে—এটাই সবার চাওয়া।
ড. মো. ইকবাল হোসেন অধ্যাপক, কেমিকৌশল বিভাগ, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)।
Email: [email protected]