জীবের মতো ভাষারও ‘জীবন’ আছে। জীবের মতো ভাষারও জন্ম-বেড়ে ওঠা-মৃত্যু আছে। কোনো জীব ক্ষণজীবী, কোনো জীব দীর্ঘজীবী। ভাষাও তাই। যে ভাষার ভাষী বেশি এবং যে ভাষার সমৃদ্ধ লিপি আছে সে ভাষা দীর্ঘজীবী হয়। সে ভাষা-ভাষীরাও আপন ঐতিহ্য ও ইতিহাস নিয়ে দীর্ঘকাল টিকে থাকতে পারে।
পরিতাপের কথা, এই বিশ্বে এমন বহু ভাষা আছে যেগুলোর কোনো লিপি নেই। তা নেই বলেই (ইউনেসকোর হিসাব অনুযায়ী) প্রায় প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে একটি ভাষা হারিয়ে যায়। যখন একটি ভাষা হারিয়ে যায়, তখন ঐতিহ্য, স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার একটি অংশ থেকে পুরো বিশ্বই বঞ্চিত হয়। অথচ একেকটি ভাষা আমাদের সমাজের সাংস্কৃতিক ও প্রথাগত জ্ঞান বৈচিত্র্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস। এই অবস্থায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিলীয়মান লিপিহীন ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে, বৈশ্বিক সভ্যতার আলোকে তাদের অবদান অশেষ।
অতি আনন্দের কথা, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে ভূমিকা রাখায় যেসব ব্যক্তি ও সংগঠন ভূমিকা রাখছে তাদের কাজকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট অবদান রাখছে। ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে ২০২১ সাল থেকে এই ধরনের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক দিচ্ছে। দুই বছর পরপর দেওয়া হয় এই পদক। গতকাল ২১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের ভেতরের দুই ব্যক্তি ও দেশের বাইরের এক ব্যক্তি ও এক প্রতিষ্ঠানের হাতে এই পদক তুলে দিয়েছেন।
পদকপ্রাপ্তদের মধ্যে এমন একজন আছেন যিনি একজন পুলিশ কর্মকর্তা। যে সমাজে চোর ডাকাত আর খারাপ মানুষের পেছনে দৌড়ানোকে পুলিশের একমাত্র কাজ বলে ধরে নেওয়ার দীর্ঘকালের চল আছে, সেখানে একজন পুলিশ কর্মকর্তা কী করে মাতৃভাষা সংরক্ষণ, পুনরুজ্জীবন ও বিকাশে ভূমিকা রাখলেন এবং তার জন্য তাঁকে পদকও দেওয়া হলো, সেটি অনেকের কাছে কৌতূহলের বিষয় হতে পারে।
অতি অবাক বিষয় যে, পদক পাওয়া ওই কর্মকর্তার কারণে প্রায় নিশ্চিতভাবে হারিয়ে যেতে বসা একটি ভাষা বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। সেই ভাষাটির নাম ‘ঠার’ (অনেকে বলেন ‘ঠের’)। এই ভাষার ভাষীরা হলেন বেদে সম্প্রদায়ের মানুষ যাঁদের বেশির ভাগই লেখাপড়ার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ‘ঠার’-কে বাঁচাতে দীর্ঘ সময় গবেষণা করে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা জাতীয় পদক পাওয়া সেই কর্মকর্তা হলেন টুরিস্ট পুলিশের প্রধানের দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত আইজিপি হাবিবুর রহমান।
এই জাতীয় স্বীকৃতি বিলুপ্তির হুমকিতে থাকা ভাষাটির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই কারণে যে, ভাষাটির সঙ্গে পিছিয়ে পড়া একটি জনগোষ্ঠীর জীবনমান ও ভবিষ্যতের প্রশ্ন জড়িয়ে আছে। যেহেতু ঠার ভাষার কোনো লিপি নেই, তাই সেই লিপিতে বেদে জনগোষ্ঠীর কোনো সাহিত্য বা ইতিহাস জাতীয় কিছু নেই। কিন্তু সুখের বিষয়, হাবিবুর রহমান দীর্ঘ গবেষণা করে ‘ঠার: বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা’ শিরোনামের একটি দীর্ঘ ব্যাপ্তির বই লিখেছেন। সেখানে তিনি এই ভাষার ইতিহাস, আদল, গতি, প্রকৃতি তুলে ধরেছেন।
এ বই যে আঙ্গিকে বিন্যস্ত হয়েছে, তাতে এটিকে ঠার ভাষার ‘জীবনী’ কিংবা ‘সমাত্মজীবনী’ বলা যায়। কারণ, ঠার ভাষার উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ বর্ণনা করতে গিয়ে হাবিবুর রহমান শুধু সুনির্দিষ্টভাবে এ ভাষার প্রসঙ্গে আটকে থাকেননি; তিনি সর্বজনীন ভাষার একটি সামগ্রিক চিত্র তুলে ধরেছেন। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বেদে সম্প্রদায়ের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের আবেগসঞ্জাত সংবেদনশীল অভিজ্ঞতা। ফলে, তিনি একটি লুপ্তপ্রায় ভাষার জীবনচিত্র এঁকেছেন, কিন্তু তাতে অন্য সব ভাষার সাধারণ সমাত্মজীবন ধরা পড়ে গেছে।
বইটিতে ঠার ভাষার প্রারম্ভিক আলোচনা এসেছে। ‘বেদে জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয় ও ঠার ভাষা’ শীর্ষক অধ্যায়ে বেদে জনগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচয়, ঠার ভাষার উৎস সন্ধান, ভাষা ও সাহিত্যের বিচারে ঠার ভাষার অবস্থান ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কিংবদন্তি মার্কিন ভাষাবিজ্ঞানী নোয়াম চমস্কির আধুনিক ভাষাবিজ্ঞানতত্ত্বের আলোকে ঠার ভাষার একটি মৌলিক বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে ঠার ভাষার ব্যাকরণ ও নির্মিতি, ধ্বনিতত্ত্ব ও ধ্বনি বিশ্লেষণের আলোকে এ ভাষার প্রকৌশলগত বিন্যাস, রূপতত্ত্ব, ঠার ভাষার মৌলিক শব্দ ও এই ভাষায় দেশি-বিদেশি শব্দের মিশ্রণ, ব্যাকরণ প্রকরণ ইত্যাদি ব্যাকরণগত দিক বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে।
‘ঠার ভাষার শব্দকোষ’ শীর্ষক একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রাখা হয়েছে। এ অধ্যায়ে ঠার ভাষার অসংখ্য শব্দ ও বাংলা ভাষায় তার সমার্থক শব্দ দেওয়া হয়েছে।
বইটির ধ্বনি বিশ্লেষণ পর্বে দেখানো হয়েছে, বাংলা ভাষার বর্ণমালা ও ধ্বনির সঙ্গে ঠার ভাষার ধ্বনির মিল আছে। বাংলা ভাষার ‘শ’ বর্ণটির ক্ষেত্রে ঠার ভাষায় সব সময়ই ‘ন’-এর ব্যবহার হয়। যেমন: বাংলা ভাষার ‘শত্রু’, ‘শরীর’, ‘শ্বশুর’, ‘শালা’, ‘শালি’-এই শব্দগুলো ঠার ভাষায় হয়ে যায় যথাক্রমে, ‘নত্রু’, ‘নরীর’, ‘নালা’, ‘নালি’।
এ ধরনের হাজারো ঠার শব্দ পাওয়া যাবে, যাকে সরাসরি বাংলা ভাষার অপভ্রংশ শব্দ হিসেবে প্রতীয়মান হবে। আবার বহু শব্দ পাওয়া যাবে, যেগুলো একেবারেই মৌলিক শব্দ। যেমন: ‘বাজকোই’ (অলংকার), ‘বান’ (আইন), ‘ঝইনতো’ (ওষুধ), ‘নাচলুই’ (গাছ), ‘গোনকি’ (চোখ), ‘ভোকতু’ (চুল), ‘ছেড়ফে দিগলা’ (ছেড়ে দে), ‘খাপাইতি করপাইছে’ (ডাকাতি করেছে), ‘পাঙফাইছিলাম’ (দেখেছিলাম) ইত্যাদি।
পুরো বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দেওয়ার জন্য উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন যা বেদে জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিশ্চিত করায় কাজ করে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে এই পদকপ্রাপ্তি হাবিবুর রহমানের এককপ্রাপ্তি নয়; এটি বেদে সম্প্রদায় ও তাঁদের মাতৃভাষার এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় পদক্ষেপ
হাবিবুর রহমানের গবেষণার অনন্য একটি দিক হলো, তিনি শুধু ঠার ভাষার আদ্যোপান্ত অনুসন্ধানেই থেমে থাকেননি; তিনি এ ভাষাকে বিলুপ্তির হাত থেকে বাঁচাতে কী কী পদক্ষেপ নিতে হবে, সে বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করে চিহ্নিত করেছেন। সে পদক্ষেপগুলো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কীভাবে কার্যকর করা সম্ভব হবে, তা নিয়েও বিশেষ সম্মেলনের আয়োজন করেছেন। ঠার ভাষার বিলুপ্তি ঠেকাতে তিনি কয়েকটি সুপারিশ করেছেন। যেমন বেদেসহ সব ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জাতিসত্তা, ভাষা ও সংস্কৃতির সাংবিধানিক স্বীকৃতি প্রদান করা; ঠার ভাষা উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন ও তাদের নিজস্ব মাতৃভাষায় পাঠ্যবই প্রস্তুত করা; সরকারি উদ্যোগে ঠার ভাষার অভিধান প্রণয়ন করা ইত্যাদি। সর্বোপরি, পুরো বেদে জনগোষ্ঠীর জীবনমান পাল্টে দেওয়ার জন্য উত্তরণ ফাউন্ডেশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান করেছেন যা বেদে জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি তাদের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া নিশ্চিত করায় কাজ করে যাচ্ছে। ঠিক সেই মুহূর্তে এই পদকপ্রাপ্তি হাবিবুর রহমানের এককপ্রাপ্তি নয়; এটি বেদে সম্প্রদায় ও তাঁদের মাতৃভাষার এগিয়ে যাওয়ার একটি বড় পদক্ষেপ।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]