গাজায় ইহুদি বসতি, সুদীর্ঘ দখলদারির প্রয়াস ও ধর্মীয় উন্মাদনা

মধ্য গাজাতে বিধ্বস্ত শরণার্থী শিবিরছবি: রয়টার্স

‘আমরা ঠিকই ফিরে আসব। তোমার সন্তানেরা আবার তাদের ভূমির সীমানার ভেতর ফেরত আসবে।’ হিব্রুতে এই দেয়াললিখন দেখা গিয়েছিল আজ থেকে প্রায় দুই দশক আগে, ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার নেতজারিমে বসতি স্থাপনকারী এক ইহুদি পরিবারের বাড়ির দেয়ালে। ২০০৫ সালে এ রকম ২০টি বেশি বসতি থেকে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার ইহুদিসহ সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছিল ইসরায়েল। সে সময় ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন অ্যারিয়েল শ্যারন আর তখন ফিলিস্তিনিদের দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলছিল।

১৯ বছর পর সেই দেয়াললিখন সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্যই যেন সক্রিয়ভাবে কাজ করছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী, এখন যাদের দখলে রয়েছে গাজা উপত্যকার এক-চতুর্থাংশ। আর এটি গাজার উত্তরাংশ, যা কৌশলগতভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা বেঁচে ছিল, তারা সবাই চলে গেছে গাজার দক্ষিণাঞ্চলে।

ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস ইসরায়েলের অভ্যন্তরে গত বছর ৭ অক্টোবর হামলা চালালে প্রায় ১ হাজার ২০০ ইসরায়েলি প্রাণ হারায়। হামাস ২৫০ জনকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যায়।

পরদিনই প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল প্রথমে আকাশপথে গাজায় হামলা চালানো শুরু করে। এরপর শুরু হয় স্থল অভিযান, যা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে রূপ নেয়। হামাসকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এই অভিযান চালানো হচ্ছে বলে দাবি করে আসছে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর নেতৃত্বাধীন ইসরায়েল সরকার। তবে যে বিষয়টা ক্রমে স্পষ্ট হয়ে উঠছে, তা হলো গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনের জন্যও কাজ করছে ইসরায়েলি বাহিনী।

ইসরায়েলের প্রাচীনতম দৈনিক পত্রিকা হারেৎজ সম্প্রতি এক বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে এ বিষয়ে। মানচিত্র, আলোকচিত্র, স্যাটেলাইট চিত্র, গ্রাফিকস ও ভিডিও সহযোগে (অনলাইন সংস্করণে) প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামাসের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধ গাজায় ফিলিস্তিনি বসতি স্থাপনের পাটাতন হয়ে উঠেছে।

প্রায় ১১ মাস ধরে চলা এই যুদ্ধে গাজায় বসবাসকারী নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ৪০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে, যার মধ্যে অন্তত ১৮ হাজার শিশু। ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় সেখানকার অন্তত ৮০ হাজার ঘরবাড়ি ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। ব্যবহারের অনুপযোগী ও বিধ্বস্ত হয়েছে আরও প্রায় ৩ লাখ ৭০ হাজার ঘর-বাড়ি-ভবন। গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে। ৩৬৫ বর্গকিলোমিটারের এই উপত্যকায় প্রায় ২৩ লাখ মানুষের বসবাস।

উল্লেখ্য, ২০০৭ সাল থেকে ইসরায়েল গাজার ওপর স্থল, আকাশ ও সমুদ্রপথে অবরোধ আরোপ করে রেখে গাজাকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও দুর্দশাগ্রস্ত ‘উন্মুক্ত কারাগারে’ পরিণত করেছে। ২০০৬ সালে ফিলিস্তিনের নির্বাচনে হামাস বিজয়ী হলে ইয়াসির আরাফাতের দল ফাতাহ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থনে এই নির্বাচন সম্পন্ন হলেও হামাসের বিজয় মেনে নিতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্রসহ অনেক দেশই। ২০০৭ সালে গাজার নিয়ন্ত্রণ নেয় হামাস। পশ্চিম তীর রয়ে যায় ফাতাহর অধীন। এরপরই ইসরায়েল অবরোধ আরোপ করে গাজার ওপর।

সুদীর্ঘ দখলদারির প্রয়াস

গাজা অভিযান শুরুর পরপরই ইসরায়েলি বাহিনী প্রথমে গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তজুড়ে কথিত নিরাপদ এলাকা (বাফার জোন) গড়ে তুলে সেখানকার সব অবকাঠামো গুঁড়িয়ে দেয় এবং ফিলিস্তিনিদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করে। মিসর-গাজা সীমান্তের ফিলাডেলফিয়া রুটও দখল করে নেয়, যাতে হামাস যোদ্ধারা মিসরে ঢুকতে না পারেন।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো গাজা উপত্যকাকে দুই ভাগ করে গাজা শহরকে দক্ষিণের বাকি এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ৩৮ বর্গকিলোমিটারের নেতজারিম করিডরের দখল নিয়ে নেওয়া। এখানে সাত কিলোমিটার দীর্ঘ যে পথ ইসরায়েলের নাহার ওজ সীমান্ত এলাকা থেকে ভূমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত, তার উত্তর পাশে গাজার পুরো এলাকাকেই এই করিডোরভুক্ত ধরা হয়। এখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে সামরিক ঘাঁটি, ভবন অবকাঠামো ও রাস্তা।

সাত কিলোমিটার করিডর-সড়কের শেষ প্রান্তে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র নির্মিত অস্থায়ী ঘাট, যা গাজাবাসীর সহায়তা হিসেবে আসা খাদ্য সরবরাহের কাজে ব্যবহার করার কথা। বাস্তবে এটি কোনো কাজেই আসতে পারছে না একাধিকবার ভেঙে যাওয়ায়। এদিকে এই অস্থায়ী ঘাটের দেয়ালে হিব্রুতে লিখন উঠেছে, ‘বসতি ছাড়া বিজয় নেই’।

নেতজারিম এলাকায় ছিল তুর্কি হাসপাতাল, যার ভবনটা এখন ইসরায়েলি বাহিনীর দখলে। এখানে আরও ছিল আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের গাজা ক্যাম্পাস ভবন, জহুর আল-দিক গ্রাম এবং দুটি পার্ক। এর মধ্যে তুর্কি হাসপাতাল ভবনে পাসওভার সেডর (মিসরে ফেরাউনের কবল থেকে বনি-ইসরায়েলিদের মুক্তি পাওয়ার ঘটনা বা শেমত স্মরণে উৎসব, যা প্রার্থনা ও বিশেষ খাবার দিয়ে পালিত হয়) উদ্‌যাপনের একটি ভিডিও ক্লিপ অনলাইনে ছড়িয়ে পড়ে, যা গাজা থেকে দুই দশক আগে চলে যাওয়া ইহুদিদের আবার সেখানে ফিরে আসার আহ্বান বলে দেখা হচ্ছে।

আরেকটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, একজন ইসরায়েলি সেনা হাসপাতাল ভবনের ছাদে উঠে দর্শকদের উদ্দেশে এ কথা বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করছেন যে ‘ইসরায়েলের ভূমি অনেক ভোগান্তির পর দখলে এসেছে’। ওই ভবনের ভেতরে আরেক সেনা কর্মকর্তাকে জনৈক ইহুদি র‌্যাবাই রচিত ‘তানইয়া’ বই মুদ্রণ করতে দেখা গেছে একই ভিডিও ক্লিপে। গাজায় এর আগেও ইসরায়েলি সেনারা ইহুদি ধর্মীয় পুস্তক ছাপার ব্যবস্থা করেছেন।

আবার আরেকটি ভিডিওতে সামরিক পোশাক ছাড়া অজানা একজন সেনাকে হানুকার দিন (খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে জেরুজালেমে দ্বিতীয় মন্দির নির্মাণের স্মরণে পালিত) একটি মেনোরাহ (বিশেষ মোমদানি) আনতে দেখা গেছে।

জানা গেছে, ২০০৫ সালে ইহুদি বসতি গোটানোর সময় মোমদানিটি নেতজারিম সিনাগগ (ইহুদি উপাসনালয়) থেকে নিয়ে গিয়ে জেরুজালেমের গুশ কাতিফ জাদুঘরের সংগ্রহশালায় রাখা হয়েছিল। সেটা আবার গাজায় আনা হয়েছে। সেখানে একটি হাতে লেখা তাওরাতের পাকানো ফালি (তোরাহ স্ক্রল) রাখতেও দেখা গেছে, যা ওই বিশেষ মোমদানির মতো নেতজারিম সিনাগগ থেকে জেরুজালেমে নেওয়া হয়েছিল। এখন তা আবার তার নিজভূমে ফিরে এসেছে।

হারেৎজ বলছে, ‘এভাবে গাজায় পুনর্বসতি স্থাপনের আন্দোলনটি আইডিএফের অভিযানকে সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে জোরদার হয়ে উঠেছে।’ যদিও অভিযান শুরু হওয়ার পর নেতানিয়াহু হামাসের ওপর ‘পুরোপুরি বিজয় অর্জন’ এবং ‘জীবিত ও মৃত সব জিম্মিকে ফিরিয়ে আনা’কে এই যুদ্ধের মূল লক্ষ্য হিসেবে অভিহিত করে এ–ও বলেছিলেন, লক্ষ্য অর্জিত হওয়া না পর্যন্ত যুদ্ধ থামবে না। আর গাজায় ইহুদিদের বসতি পুনরায় স্থাপনের বিষয়টি ‘একটি অবাস্তব পদক্ষেপ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। সিএনএনের সঙ্গে মে মাসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এর পুনরাবৃত্তি করে বলেন, ‘গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল আবার বসতি নির্মাণ করতে পারবে না। ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষও উপত্যকা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।’

সেনাদের ধর্মীয় উন্মাদনা

তবে গাজার দখল ধরে রাখার কৌশলগত কারণগুলো এখন সেখানে বসতি স্থাপনের জন্য আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ডানপন্থীদের লক্ষ্যের সঙ্গে বেশ মিলে গেছে। হারেৎজের প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে, ‘গাজায় আবার বসতি স্থাপনের বিষয়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে সমর্থনের গভীরতা পরিমাপ করা কঠিন হলেও এটি স্পষ্টতই দৃশ্যমান। বছরের পর বছর ধরে সেনাবাহিনীর ভেতর ধর্মীয় জিগির জোরদার করার ফলাফল যেমন অবধারিত, তেমনি রিজার্ভ বাহিনীর মধ্যে ধর্মীয় জায়নাবাদের প্রভাবও সুবিস্তৃত।’

গাজায় কয়েকজন কর্মকর্তাসহ বেশ কিছু সৈনিককে কমলা রঙের পতাকা তুলতে দেখা গেছে। ২০০৫ সালে গাজা থেকে বসতি গোটানোর প্রতিবাদে এই পতাকা ব্যবহার করা হয়েছিল। হাতে লেখা তাওরাতের ফালি নিয়ে নাচতে দেখা গেছে কাউকে কাউকে। আবার অনেকেই গাজার বিভিন্ন এলাকা ও বিধ্বস্ত ভবনে হিব্রুতে লিখিত তাওরাতের বিভিন্ন বাণীসংবলিত পশুচর্মের ফলক ঝুলিয়েছে।

ইসরায়েলি সেনাদের এসব ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড প্রতীকী হিসেবে বিবেচনা করা যায়, যা হাওয়া থেকে ঘটছে না। এ বছরের জানুয়ারিতে জেরুজালেমে এক বিশাল সমাবেশে গাজায় পুনর্বসতি স্থাপনের দাবি জানানো হয়। বসতি স্থাপনকারীদের সংগঠন গাজার অভিমুখে যাত্রার ডাক দিয়েছে। সংগঠনটির প্রধান ড্যানিয়েলা ওয়েসিস দাবি করেছেন গাজায় ইসরায়েলি সেনাঘাঁটিতেই এই বসতি শুরু করার।

বিবিসির এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, তিনি ইতিমধ্যে ৫০০ পরিবারের তালিকা তৈরি করেছেন, যারা এখনই গাজায় ফিরে যেতে প্রস্তুত। নেতানিয়াহু সরকারের অন্তত ১২ জন মন্ত্রী প্রকাশ্যেই গাজাকে ‘ইহুদিকরণের’ প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। একটি সমুদ্রসৈকতের ধারে সুন্দর বাড়িতে বসবাস করার সুযোগ কেই–বা হাতছাড়া করতে চায়?

অনিশ্চিত সমঝোতা

যুদ্ধ বন্ধসহ ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সমঝোতার প্রয়াস কোনো অগ্রগতি দেখছে না। হামাসের দাবি হলো ইসরায়েলকে অভিযান থামাতে হবে এবং সেনা প্রত্যাহার করতে হবে। আর ইসরায়েল তাতে সম্মত হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও মিসরের সমর্থনে কাতার সক্রিয়ভাবে মধ্যস্থতার চেষ্টা করছে যুদ্ধ বন্ধ ও ফিলিস্তিনিদের প্রাণহানি ঠেকাতে। ইসরায়েলের ভেতর থেকেও জোর দাবি উঠেছে যুদ্ধ বন্ধের ও জিম্মিদের নিরাপদে ফিরিয়ে আনার। কিন্তু কেউই সুবিধা করতে পারছে না ইসরায়েল সরকারের, তথা নেতানিয়াহুর অনড় ও আপসহীন অবস্থানের কারণে। হামাসও দুর্বল হয়ে পড়েছে, তা স্পষ্ট।

হামাসের অর্ধেকের বেশি নেতা নিহত হয়েছেন; প্রাণ হারিয়েছেন ও আহত হয়েছেন অন্তত ১৪ হাজার সদস্য। তারপরও হামাস একেবারে হাল ছেড়ে দেয়নি, যা আবার স্পষ্ট হয় ইসরায়েলের মারমুখী উন্মত্ততায়।

এ পর্যন্ত গাজায় ইসরায়েল অন্তত ৭০ হাজার টন বোমা নিক্ষেপ করেছে বলে ইউরো-মেড হিউম্যান রাইটস মনিটর জানিয়েছে, যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ড্রেসডেন, হামবুর্গ ও লন্ডন নিক্ষিপ্ত বোমার চেয়েও বেশি। এর মধ্য দিয়ে গাজায় ইহুদি বসতি স্থাপনের কাজ ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে।

ইসরায়েল সাংবাদিক গিডিয়ন লেভি এ জন্য নেতানিয়াহুকে দায়ী করে বলেছেন, তিনি ফিলিস্তিন সমস্যার কোনো কূটনীতিক সমাধান চান না; বরং যুদ্ধে জিতে গাজায় স্থায়ী দখলদারি গড়তে চান, যার মানে হলো ফিলিস্তিন সমস্যাকে শুধু যুদ্ধের মাধ্যমে সমাধানের পরিকল্পনায় আরেক প্রস্থ ভিত গড়া।

  • আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক

[email protected]