চীনা প্রস্তুতশিল্পের উত্থান ও অনাগত পতন

চীনের বিশাল উদ্বৃত্ত মানে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ঘাটতিছবি: রয়টার্স

বিশ্বের উৎপাদন মূল্য সংযোজনের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ এবং বিশ্বব্যাপী উৎপাদন রপ্তানির এক-পঞ্চমাংশ করে চীন। এই বিস্ময়কর হার বিশ্বব্যাপী উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। একে বলা হচ্ছে অতি উৎপাদনক্ষমতা। তবে চীনের উৎপাদন খাতের পতন আসন্ন বলে বিশ্বাস করার উপযুক্ত কারণ রয়েছে। চীনে এখন কী ঘটছে তা বোঝার জন্য জাপানের সাম্প্রতিক ইতিহাস স্মরণ করা দরকার।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাপানের উৎপাদন খাত দ্রুত বৃদ্ধি পায়; কিন্তু ১৯৮৫ সালে প্লাজা অ্যাকর্ড চুক্তির ফলে ইয়েনের মূল্য বাড়ল, দুর্বল হলো জাপানের রপ্তানি। এর মধ্যে বয়স্ক জনসংখ্যা বেড়ে শ্রমশক্তি গেল কমে। 

এই ভারসাম্যহীনতার পেছনে মূল কারণ হিসেবে কাজ করেছে চীনের পরিবার–পরিকল্পনা নীতি। সাধারণত পারিবারিক নিষ্পত্তিযোগ্য আয় থেকে দেশের জিডিপির ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আসে। চীনে ১৯৮০ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত ‘এক সন্তান’ নীতি চালু ছিল। এর ফলে গার্হস্থ্য আয় ছিল সীমিত, যা উচ্চ হারে সঞ্চয় উৎসাহিত করেছে।

আবার গার্হস্থ্য চাহিদা ছিল সীমিত। তবে চীন সরকারের যথেষ্ট আর্থিক সংস্থান আছে। তারা সে সংস্থান শিল্পে ভর্তুকি আর ম্যানুফ্যাকচারিং (প্রস্তুতশিল্প) খাতে বিনিয়োগে ব্যবহার করে। এ ছাড়া চীনা ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে লাভের হার খুব বেশি। তাই আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীরা এখানে পুঁজি খাটাতে আগ্রহী। এর সঙ্গে আছে প্রায় ১০ কোটি শ্রমিক–উদ্বৃত্ত। এই অতিরিক্ত ক্ষমতা এড়িয়ে যাওয়া কঠিন।

চীনে দেশের ভেতরে চাহিদা যথেষ্ট নয়। তার নিজের অতিরিক্ত ক্ষমতা কমানো আর দেশের জনগণের জন্য যথেষ্ট কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার একমাত্র উপায় হলো বিশাল চলতি হিসাবের উদ্বৃত্ত বজায় রাখা। এখানেই যুক্তরাষ্ট্র প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে।

যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিতে চীনা পণ্য ১৯৮৫ সালের ১ শতাংশ থেকে ২০১৭ সালে বেড়ে ২২ শতাংশ হয়। ২০০১-১৮ সালের মধ্যে চীনের তিন-চতুর্থাংশ বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এসেছে যুক্তরাষ্ট্র থেকে।

চীনের বিশাল উদ্বৃত্ত মানে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে ঘাটতি। চীনা উত্পাদনের উত্থান মার্কিন উৎপাদনের পতনের একমাত্র কারণ না হলেও বড় কারণ তো বটেই; বিশ্ব উৎপাদন রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ ১৯৭১ থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত ১৩ শতাংশে স্থিতিশীল ছিল।

২০০১ সালে চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় যোগ দেয়। এরপর থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানুফ্যাকচারিং দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে। ২০২২ সালে তা এসে ৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে ম্যানুফ্যাকচারিং মূল্য সংযোজনে যুক্তরাষ্ট্রের অংশ হ্রাস পেয়েছে। ২০০০ সালের ২৫ শতাংশ থেকে ২০২১ সালে তা হয়েছে ১৬ শতাংশ।

উৎপাদন খাতে যুক্তরাষ্ট্রের এই পতন পুরো বিশ্বায়ন নিয়েই হতাশা তৈরি করছিল। এই হতাশা দিন দিন বেড়েছে। ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্প সেটিকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেলেন হোয়াইট হাউসে। প্রতিশ্রুতি দিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রের উৎপাদনের সুদিন ফিরিয়ে আনবেন। বাধ্য করবেন চীনকে তার বাণিজ্যের ধরন বদলাতে। আগামী নভেম্বরের নির্বাচনেও ট্রাম্প সেই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসেননি।  

এই অর্থে চীনের এক সন্তান নীতি পরোক্ষ; কিন্তু গভীরভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক জমিন নতুন করে সাজিয়েছে। আর এখন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বদলে দিচ্ছে চীনের অর্থনীতি। চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়া শুরু হয়েছিল ২০১৮ সালে ট্রাম্পের আরোপিত শুল্ক দিয়ে। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের আমলে তা তীব্র হয়েছে। ২০২৪ সালের প্রথমার্ধে মার্কিন আমদানিতে চীনা পণ্যের অংশ মাত্র ১২ দশমিক ৭ শতাংশে নেমে এসেছে। 

মার্কিন বাজার হারানো ছাড়াও চীন তার নিজস্ব কিছু উৎপাদনকারী কোম্পানিকে হারাচ্ছে। এই কোম্পানিগুলো মার্কিন শুল্ক এড়াতে তাদের উৎপাদনের কিছু অংশ ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোয় সরিয়ে ফেলছে। এই স্থানান্তর এখন আংশিক। কিন্তু ভবিষ্যতে তা ব্যাপক হয়ে উঠতে পারে। এর সঙ্গে জাপানের ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের পতনের মিল পাওয়া যায়। আরও দুটি দিক দিয়ে চীনের সঙ্গে জাপানের মিল পাওয়া যাচ্ছে।

প্রথমত, চীনের কর্মক্ষম জনশক্তির বয়স বাড়ছে। সরকারি হিসাবমতে, বার্ষিক জন্মসংখ্যা ১৯৬২-৯০ সালে গড়ে ২ দশমিক ৩ কোটি থেকে কমে গত বছর মাত্র ৯০ লাখে নেমে এসেছে। কয়েক বছরের মধ্যে চীন সম্ভবত বছরে মাত্র ৬০ লাখ নতুন শিশুর মুখ দেখতে পাবে। এরই মধ্যে অভিবাসী শ্রমিকদের গড় বয়স ২০০৮ সালে ছিল ৩৪ বছর। গত বছর তা বেড়ে ৪৩ বছরে দাঁড়িয়েছে। ৫০ বছর বয়সের বেশি শ্রমিকের অংশ ১১ শতাংশ থেকে বেড়ে হয়েছে ৩১ শতাংশ। শ্রমিকের অভাবে কিছু কারখানা এরই মধ্যে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। 

দ্বিতীয়ত, চীনের পরিষেবা খাত উত্পাদন কমিয়ে ফেলছে। চীন সরকার গৃহস্থালির নিষ্পত্তিযোগ্য আয়ের জিডিপি ভাগ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ফলে মার্কিন পণ্যের জন্য চীনা চাহিদা বাড়বে। উত্পাদনের সঙ্গে যুক্ত কিছু কর্মী পরিষেবা খাতে যাবেন। 

চীনে ম্যানুফ্যাকচারিংয়ের পতন জাপানের মতো দ্রুত হয়তো হবে না। কারণ, চীনের অভ্যন্তরীণ বাজার অনেক বড়। এর শিল্প আবহ অনেক বিস্তৃত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবোটিকসে চীন প্রচুর বিনিয়োগও করছে; যা থেকে লাভ পাওয়া যাবে। কিন্তু চীনের ম্যানুফ্যাকচারিংয়ে পতন অনিবার্য এবং অপরিবর্তনীয়। 

ইয়ি ফুশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইসকনসিন-ম্যাডিসনের জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, ইংরেজি থেকে অনূদিত