কয়েক দিন আগে পত্রিকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার খবর পড়ে মনটা খুব বিষণ্ন হয়ে আছে। সলিমুল্লাহ হলের এই শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার আগেও আমরা শুনেছি আরও বেশ কয়েকটি তরুণ প্রাণের অকালে ঝরে যাওয়ার খবর।
এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই, সাম্প্রতিক সময়ে কিশোর ও তরুণদের মধ্যে আত্মহত্যার বিষয়টি আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। এর কারণ হিসেবে চাকরির বাজারের ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা ও বেকারত্বকে অনেকে অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করে থাকেন। আমাদের দেশে তরুণ ও শিক্ষিত বেকারত্বের হার সার্বিক বেকারত্বের হারের চেয়ে বেশি। তাই শিক্ষিত তরুণদের বেকারত্বের বিষয়টি সহজভাবে দেখলে চলবে না।
তবে বেকারত্ব ও জীবিকাই কি তরুণদের এই হতাশা আর জীবনের প্রতি অনীহার মূল কারণ? এর উত্তর হয়তো মনোবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে আমার ধারণা, তরুণ সমাজের এই হতাশার পেছনে বহুবিধ কারণ রয়েছে। এর কিছুটা অনেক ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের উদ্বেগ ও আশঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও এর পাশাপাশি সামাজিক অবকাঠামো আর সম্পর্কের জটিলতার মতো বিষয়গুলোও দায়ী।
সমাজ ও পরিবারের প্রত্যাশার চাপে তারুণ্যের সুন্দর সময়গুলো আজকাল হারিয়ে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান প্রতিযোগিতার এই যুগে ভালো সিজিপিএর প্রত্যাশা, বিসিএসের মাধ্যমে চাকরির প্রত্যাশা, উচ্চশিক্ষার প্রত্যাশা—এ সবকিছু তরুণ বয়সেই জীবনকে অনেক জটিল করে ফেলেছে। এর পাশাপাশি নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা টিউশনি, নিজের পড়া, পরিবারের দায়িত্ব—সবকিছু একসঙ্গে সামলাতে গিয়ে অনেক সময়ই বিষাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
আবার গ্রামের কিংবা মফস্সলের সহজ-সরল পারিবারিক আবহ থেকে শহরের আধুনিকতায় খাপ খাওয়াতে পারে না অনেকেই।
হতাশাগ্রস্ত তরুণদের পাশে বিশেষভাবে এসে দাঁড়াতে হবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের। অভিভাবকদের বুঝতে হবে সন্তানের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়, বোঝাতে হবে তাদের সীমাবদ্ধতাকেও। তরুণদের বুঝতে হবে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কোনো কিছুই হতে পারে না আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা জীবনকে শুধু জটিলই করে তোলে।
নিজের সন্তানকে সফল, মেধাবী ও সুপ্রতিষ্ঠিত হিসেবে দেখতে নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্ত—সবাই উদ্গ্রীব, কিন্তু নিজের আকাঙ্ক্ষা ও অপূর্ণ স্বপ্ন সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার ভুলে আমরা অভিভাবকেরা হয়তো সন্তানের সীমাবদ্ধতাকে আমলেই নিই না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের এই রমরমা সময়ে সার্বক্ষণিকভাবে নিজেকে সুখী ও সফল দেখানো এবং ‘কুল’ প্রমাণ করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা থেকে নিজেকে বিরত রাখা আসলেই কতটা সম্ভব হয় এই তরুণদের জন্য?
বিশ্বায়নের এই যুগে বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে আবার পথভ্রষ্ট হয়ে যাচ্ছে কেউ কেউ। আধুনিক এই জীবনব্যবস্থায় সততা, আদর্শ ও নৈতিকতার শিক্ষা অনেক ক্ষেত্রেই গুরুত্ব হারাচ্ছে। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা যেমন একদিকে প্রত্যাশা-প্রাপ্তি, জীবন-জীবিকা, ন্যায়-অন্যায়ের হিসাব মেলাতে না পেরে হতাশায় নিমজ্জিত হচ্ছে, তেমনি উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা সবকিছু সহজেই পেয়ে যাওয়ার পর জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজতে খুঁজতে হয়ে যাচ্ছে মূল্যবোধহীন ও উদ্দেশ্যহীন। এই প্রত্যাশা কিংবা উদ্দেশ্যহীনতা থেকে বাঁচতে কেউ কেউ আশ্রয় নিচ্ছে মাদকে আর জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে। কেউ হয়তো বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো করুণতম পথ।
তারুণ্যের এই হতাশার দায় তাই আমাদের সবারই। এর থেকে পরিত্রাণের জন্য একদিক থেকে যেমন তরুণদের জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করে ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের আশঙ্কা ও অনিশ্চয়তা দূর করা প্রয়োজন, তেমনি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সার্বক্ষণিকভাবে কাউন্সেলিংয়ের কোনো বিকল্প নেই। আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় মানসম্মত থাকা-খাওয়ার পরিবেশ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি। এর পাশাপাশি মনে রাখতে হবে, মানসিক স্বাস্থ্যকে ছোট করে দেখার, গুরুত্ব না দেওয়ার কোনো সুযোগই এই বিশ্বায়নের যুগে আর নেই।
হতাশাগ্রস্ত তরুণদের পাশে বিশেষভাবে এসে দাঁড়াতে হবে শিক্ষক ও অভিভাবকদের। অভিভাবকদের বুঝতে হবে সন্তানের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়, বোঝাতে হবে তাদের সীমাবদ্ধতাকেও। তরুণদের বুঝতে হবে, জীবনের চেয়ে মূল্যবান কোনো কিছুই হতে পারে না আর অসুস্থ প্রতিযোগিতা জীবনকে শুধু জটিলই করে তোলে।
ড. সায়মা হক বিদিশা অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়