বাংলাদেশ সরকারের ডাকসাইটে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন করেছেন, নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও পুরোনো, লক্কড়ঝক্কড় বাসের রং করা হচ্ছে না। এখন কি তাহলে তাঁকে নিজে গিয়ে সেসব বাস রং করে আসতে হবে?
প্রশ্নটা যদি আমাকে করা হতো, তাহলে উত্তর হতো, কেন নয়? মন্ত্রীর নির্দেশ যদি অমান্য করা হয়, তা মান্য করাতে মন্ত্রী নিজে আস্তিন গুটিয়ে কাজে নামেন, তাতে ক্ষতি কী? বস্তুত, এর ফলে বাসমালিকদের হুঁশ আসবে, তাদের ওপর চাপ বাড়বে, পাবলিকের সমালোচনার মুখে বাধ্য হয়ে তারা সরকারি নির্দেশ মানতে উদ্যোগী হবে।
এমন উদাহরণের কমতি নেই, যেখানে দেশের হর্তাকর্তারা, মায় প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত নিজে ঝাড়ু হাতে রাস্তা পরিষ্কারে নেমে গেছেন। বেশি দূরে নয়, পাশের বাড়ির মোদি সাহেবকেই দেখুন না। তাঁর ‘স্বচ্ছ ভারত’ আন্দোলনের অংশ হিসেবে তিনি ও তাঁর সরকারের অন্য অনেকেই ঝাড়ু-বালতি নিয়ে রাস্তা সাফসুতরো করেছেন। তাতে কতটা কাজ হয়েছে জানি না, কিন্তু মানুষের নজরে এসেছে, স্বচ্ছ ভারত নির্মাণের তাগিদ বেড়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
আমাদের দেশেও কোনো কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি শুধু ভাষণ বা নির্দেশ না দিয়ে নিজেরাই হাতে-কলমে কাজটা করে দেখাচ্ছেন। সিলেটের এক নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি তো সে কাজের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রীতিমতো শোরগোল তুলে দিয়েছেন।
মাননীয় মন্ত্রীর কথায় অবশ্য আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ দিকের আভাস মিলছে। আর তা হলো, সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে নির্দেশ দেওয়া সত্ত্বেও তা মানা হয় না, তার প্রতিকার হিসেবে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কোনো কার্যকর প্রক্রিয়াও নেই। এটাই যদি নিয়মে দাঁড়ায় তাহলে জনতা ধরে নিতে পারে, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে যখন কোনো নির্দেশ জারি করা হয়, তা কেবল বাত কি বাত। না মানলেও তেমন কোনো সমস্যা নেই।
আইন থাকলে সে আইন ভাঙা হবে, সে কথা আমরা জানি, কিন্তু সে আইন ভাঙলে যারা দোষী, তাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে, এটাও রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমরা আশা করতে পারি। এই সহজ কাজটা যখন বাস্তবায়িত হয় না, হবে না, সেটাই যখন ‘রুটিন’ হয়ে দাঁড়ায়, তখন দেখা দেয় সরকারের প্রতি অনাস্থা।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যেকোনো সরকারের বৈধতা বা লেজিটিমেসির একমাত্র উৎস সে সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা। সরকার মানে প্রতিটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, প্রতিটি মন্ত্রণালয়ভুক্ত দপ্তর, বিচার বা আইন প্রয়োগকারী সংস্থা।
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায়, অথবা অশাসনতান্ত্রিক (সামরিক) প্রশাসনে জনগণ কী ভাবল বা ভাবল না, তা নিয়ে তোয়াক্কার কোনো প্রয়োজন নেই। জনগণকে ঠান্ডা করতে ডান্ডা আছে। কিন্তু আমাদের বিবেচনা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা নিয়ে, যেখানে কে কত দিন ক্ষমতায় থাকবে, তা নির্ভর করে জনগণের এই আস্থার ওপর। বস্তুত, গণতন্ত্র ও আস্থা পয়সার এপিঠ-ওপিঠ।
যেকোনো সরকারের প্রতি আস্থা বা বিশ্বাস বুঝতে আমরা তিনটি পরিমাপক বিবেচনায় আনতে পারি: নাগরিক অংশগ্রহণ (পার্টিসিপেশন), নাগরিক প্রতিনিধিত্বশীলতা (রিপ্রেজেন্টেশন) ও নাগরিক চাহিদার প্রতি সরকারি মনোযোগ (রেসপনসিভনেস)। এর কোনোটাই ল্যাবরেটরিতে মেপে তার পরিমাপ নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, বুঝতে হলে হয় আমাদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করতে হবে, অথবা জাতীয় জনমত জরিপের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের তথ্য ব্যবস্থামুক্ত হলে সেখানেও এই তিন পরিমাপকের একটি অর্থবহ ছাপচিত্র পাওয়া সম্ভব।
আমাদের দেশেও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আমাদের অনাস্থা বাড়ছে। সরকার আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে, এ কথায় আমাদের বিশ্বাস কমে আসছে। সরকার নিজেও সে দায়িত্ব পালনে উন্মুখ, এমন কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় না। সরকার ও দেশের মানুষের মধ্যে এই দূরত্ব যত বাড়বে, ক্ষমতা দখলের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ততই লাফাবে।
সরকারের প্রতি নাগরিকের অনাস্থা পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই কমবেশি রয়েছে। এ অনাস্থার কারণেই সরকারের পতন হয়, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসে। এ আস্থার গুরুত্ব বিবেচনা করে কয়েক বছর ধরে ওইসিডি (অর্গানাইজেশন অব ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) এই সংস্থার অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোয় সরকারের প্রতি নাগরিক আস্থা নিয়ে জরিপ শুরু করেছে।
২০২২ সালের প্রথম জরিপ অনুসারে, সরকারের প্রতি আস্থার খামতি থাকলেও এসব দেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জনগণ মনে করে, তাদের দেশের সরকারগুলো মোটের ওপর তাদের স্বার্থ রক্ষায় তৎপর। অন্য কথায়, সরকার ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট, এ কথা অধিকাংশ মানুষ বিশ্বাস করে।
তবে এই জরিপ একটু ঘেঁটে দেখলে একটি ভিন্ন ছবি ধরা পড়ে। যেমন অর্ধেকের মতো মানুষ মনে করেন, সরকারি কর্মচারীরা তাঁদের দায়িত্ব পালনে সচেতন হলেও প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মনে করে, ‘না, তারা তেমন সচেতন নয়। অর্ধেকের মতো মানুষ মনে করে, নীতিনির্ধারণ ও নীতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণের সুযোগ সীমিত। চলতি যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা, অর্ধেকের মতো মানুষ মনে করে, তাতে অংশগ্রহণের কোনো কার্যকর সুযোগই তাদের নেই।
প্রায় দেশেই দুর্নীতি একটি অব্যাহত সমস্যা। এক-তৃতীয়াংশ মানুষ মনে করে, কোনো কাজ সময়মতো করতে হলে সরকারি কর্তাব্যক্তিদের উৎকোচ দেওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। দরিদ্র বা বৈষম্যগ্রস্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সরকারের প্রতি অনাস্থা সবচেয়ে বেশি। একইভাবে দলীয় মেরুকরণও প্রকট। এই জরিপ অনুসারে, দলীয় সমর্থকেরা তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি অধিক আস্থাবান। বিরোধীদলীয় সমর্থকেরা ঠিক উল্টো। আগ্রহী পাঠক, এইখানে ২০২২ সালের ‘আস্থা প্রতিবেদন’ প্রতিবেদনটি দেখে নিতে পারেন: <https://bit.ly/3xcRW8j>
ওইসিডি ২০২১ সালে যখন এই ‘আস্থা জরিপ’-এর উদ্যোগ নেয়, তখন বলা হয়েছিল, গণতন্ত্রের প্রতি হুমকি মোকাবিলায় সরকারের প্রতি আস্থা বৃদ্ধি জরুরি। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রায় সব দেশের জনগোষ্ঠীর এক বড় অংশ রাষ্ট্রীয় অংশীদারত্বে বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছে, ফলে একদিকে বাড়ছে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা, অন্যদিকে শাসনতন্ত্রবহির্ভূত পথে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা।
এই বিচ্ছিন্নতাবোধ সবচেয়ে প্রকট ৩০-অনূর্ধ্ব মানুষের মধ্যে। একটি মার্কিন জরিপে দেখছি, এই বয়সী নাগরিকদের ১৯ শতাংশ বলছে, গণতন্ত্র নয়, একনায়কতন্ত্রই তাদের অধিক কাম্য। এই বয়সভুক্ত নাগরিকদের ২৯ শতাংশ মনে করে, গণতন্ত্র হোক বা একনায়কতন্ত্র, কোনোটার ব্যাপারেই তাদের মাথাব্যথা নেই, কারণ উভয় ব্যবস্থাতেই তারা উপেক্ষিত। তাদের কথা কেউই ভাবে না।
দেশের জনগোষ্ঠীর এক উল্লেখযোগ্য অংশ যখন নিজেদের সরকারের সঙ্গে এতটা ‘বিচ্ছিন্ন’ বোধ করে, তখন অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের উত্থানের পথ সুগম হয়ে আসে। প্রমাণ হিসেবে আজকের ইউরোপের কোনো কোনো দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকালেই টের পাওয়া যাবে।
এত সব পণ্ডিতি কথা বলার একটাই কারণ। আমাদের দেশেও রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতি আমাদের অনাস্থা বাড়ছে। সরকার আমাদের স্বার্থ রক্ষা করে, এ কথায় আমাদের বিশ্বাস কমে আসছে। সরকার নিজেও সে দায়িত্ব পালনে উন্মুখ, এমন কথাও নির্দ্বিধায় বলা যায় না। সরকার ও দেশের মানুষের মধ্যে এই দূরত্ব যত বাড়বে, ক্ষমতা দখলের জন্য ঘাপটি মেরে বসে থাকে অগণতান্ত্রিক শক্তিগুলো ততই লাফাবে।
অতএব সাবধান!
২ এপ্রিল ২০২৪, নিউইয়র্ক
● হাসান ফেরদৌস প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক