বিজয় দিবস ও একটি রাজনৈতিক দলের গড়ে ওঠা

এবারের বিজয় দিবসে আমাকে খুব ভোরে উঠতে হয়েছিল। এবার পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট জোসে রামোস হোর্তা বিজয় দিবসে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে জাতীয় স্মৃতিসৌধে গিয়েছিলেন। তিনি নিজেও একজন নোবেল বিজয়ী। তাঁকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়েছিল। অনুষ্ঠানে দাওয়াত পাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। কিন্তু আমি এত ভোরে যেতে পারিনি। গিয়েছিলাম পরে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে।

এবার বিজয় দিবস এসেছিল ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর। এবারের পরিবেশটাই ছিল অন্যান্য বছরের তুলনায় আলাদা। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বের দাবিদার আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা ছিল না। ভাবছিলাম, এবার কি আগের মতো জমজমাট অনুষ্ঠান হবে? ব্যাপক লোকসমাগম হবে? কিন্তু স্মৃতিসৌধে বিলম্বে পৌঁছেও আমার সেই ধারণা ভেঙে গেল। বেলা প্রায় সাড়ে ১১টার সময় আমরা সেখানে পৌঁছাতে পেরেছিলাম। তখনো স্মৃতিসৌধ ছিল লোকে লোকারণ্য।

বিলম্বে পৌঁছার দায় অবশ্য আমার বা আমাদের নয়। স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি থেকে রাস্তায় জ্যাম ছিল। এ রকম জ্যাম আমি গত বছরগুলোয় দেখিনি। এটা কি সকালে পর পর দুটো অনুষ্ঠানের কারণে, নাকি অন্য কিছু, তা জানি না। তবে যখন জ্যাম শুরু হয়েছিল, তখন থেকে কোনো ট্রাফিক পুলিশ দেখিনি। আধা মাইল আগে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের দেখেছিলাম। কিন্তু তাঁরা তো আর ট্রাফিক পুলিশিং করছেন না। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে আধা ঘণ্টার বেশি সময় রাস্তায় গাড়ির মধ্যে বসে ছিলাম। এর মধ্যেই হঠাৎ প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের ভাষণ শুরু হলো। কী আর করা! ভাষণ শুনতে লাগলাম। 

মুহাম্মদ ইউনূস একজন মিষ্টভাষী বক্তা। কথার মধ্যে খুব অলংকার নেই, বাগাড়ম্বর তো নেই–ই। কিন্তু কথায় তিনি তাঁর পয়েন্ট তৈরি করতে পারেন। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিতে পারেন তিনি কী বলছেন। বক্তৃতা শুনতে শুনতে মনে হলো তিনি তাঁর পয়েন্ট পরিষ্কার করে বলেছেন। নতুন করে ভোটার তালিকা বানাতে হবে। পরপর তিনটি টার্ম কোনো ভোট হয়নি। অতএব যে ভোটার তালিকা আছে, তার ওপর নির্ভর করা যাবে না এবং এই কাজে ৬ থেকে ৯ মাস লাগবে। যুক্তিযুক্ত কথা।

সবচেয়ে বড় প্রশ্ন সংস্কারের। এ নিয়ে কত প্রস্তাব আছে। আমাদের দেশ মতামতের দিক থেকে ১০০ ভাগের বেশি বিভাজিত। এখানে জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া তো যাবে না। আমার মতে সংস্কারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বিবেচনার বিষয় এটিই। জাতীয় ঐকমত্য লাগবে। প্রধান উপদেষ্টা এ জন্য একটি কমিশন করার কথা বলেছেন, যার প্রধান থাকবেন তিনি নিজে এবং একটি প্রক্রিয়ার কথা বলেছেন তিনি। কত দিন লাগতে পারে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে? জাতীয় ঐকমত্য তৈরি হতে? আগে থেকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যাবে কি? 

সংস্কারের জন্য এ পর্যন্ত অন্তর্বর্তী সরকার ১৩টি কমিশন গঠন করেছে। আমি মনে করি, ১৩টি কমিশনই প্রয়োজনীয়। কিন্তু তার মানে কি এই যে ১৩টি কমিশনের সুপারিশ কার্যকর করার পরে দেশে নির্বাচন হবে? তা-ই কি হতে পারে? সংস্কার আসলে একটি নিরন্তর প্রক্রিয়া। পৃথিবীর জন্মের পর থেকেই সংস্কারপ্রক্রিয়া কার্যকর আছে। এটাকে কোথাও থামিয়ে দেওয়ার অবকাশ নেই। 

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে অবশ্য সমন্বয়কেরা কিছু বলেননি। ইতিমধ্যে অবশ্য বোঝা গেছে যে নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীরা সংস্কার চান। সংস্কারের মধ্যে লুটপাট এবং গণহত্যার বিচারও যুক্ত, তা তাঁরা চাইতেই পারেন। তাঁরা মনে করতেই পারেন বর্তমান সময়টি সংস্কারের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ইতিমধ্যে তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের অভিপ্রায় জানিয়েছেন।

গত ১৫ বছরের শাসনে দেশের গণতন্ত্র এবং নির্বাচনপ্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করা হয়েছে। এটা সংস্কার না করে একটি গুণগতভাবে উন্নত, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করা সম্ভব নয়। কারও কারও মধ্যে এ ব্যাপারে একটি ভুল ধারণা লক্ষ করি। তাঁরা সংস্কার এবং নির্বাচনকে পরস্পরবিরোধী হিসেবে বিবেচনা করেন। এ জন্য হয়তোবা বলেন যে আগে সব সংস্কার করে ফেলতে হবে। এরপর নির্বাচন হবে। অথবা এ রকম করে বলেন, সব সংস্কার করবে কেবল নির্বাচিত সংসদ বা সরকার। যেন অন্য কেউ আর সংস্কার করার ক্ষমতাই রাখেন না। 

জাতির উদ্দেশে ভাষণে মুহাম্মদ ইউনূস এ কথা স্পষ্ট করেছেন যে যদিও তাঁরা ১৩টি কমিশন করেছেন এবং কমিশনগুলো কাজ করছে, তথাপি তিনি মনে করেন, সংবিধান এবং নির্বাচনসংক্রান্ত সংস্কারই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই দুটি বিষয়ে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারসাধন করতে হবে। কত দিন লাগতে পারে, এই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হতে এবং তার ভিত্তিতে সংস্কার করতে এবং এই সংস্কারকৃত সংবিধানের ভিত্তিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে?

আমাদের মতো বিভাজিত রাজনীতি ও সমাজে এ কথা বলা মুশকিল। ইউনূস একটি পথনির্দেশিকা দিয়েছেন। একে পথনির্দেশিকা বলা যায় কি না? দিন-তারিখ দিয়ে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি, সে কারণে কেউ যদি বলতে না চান, তবে বলবেন না। বক্তব্যে স্পষ্টতা ও দিকনির্দেশনার দিক থেকে যাকে একটি পথনির্দেশিকা বলতে আমার আপত্তি নেই। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণটি আমার খারাপ লাগেনি।

দুই. 

আগস্ট অভ্যুত্থানে যে শিক্ষার্থীরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন, অভ্যুত্থানের সাফল্যের পরে তাঁদের অনেককে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। অভ্যুত্থান যখন চলছিল, তখন বেশির ভাগ ছাত্র সম্পর্কে অনেকে কিছু জানতেন না।

কিন্তু অভ্যুত্থানের পর থেকে তাঁদের আচরণ-উচ্চারণে মানুষ ধীরে ধীরে তাঁদের সম্পর্কে ধারণা পেতে থাকে। ধারণাটা যে এখনো স্পষ্ট হয়েছে, তা বলা যাবে না। বিভিন্ন সময়ে তাঁরা যে বক্তব্য দিচ্ছেন, যেসব ক্রিয়া করছেন, তাতে বেশ কিছুটা আলো ফেললেও কিছুটা অন্ধকার রয়ে যাচ্ছে।

আমরা সবাই জানি, তাঁদের পরামর্শ অনুযায়ী বা অনুরোধে মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর উপদেষ্টা পরিষদে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। সেই হিসেবে শিক্ষার্থীরা এই সরকারের অংশ। কিন্তু মাঝেমধ্যেই দেখা যাচ্ছে তাঁরা বেশি র‍্যাডিক্যাল বক্তব্য দিচ্ছেন। সেসবের অনেক কিছুই সরকারের বিরুদ্ধে যাচ্ছে।

বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ নিয়ে অবশ্য সমন্বয়কেরা কিছু বলেননি। ইতিমধ্যে অবশ্য বোঝা গেছে যে নির্বাচনের আগে শিক্ষার্থীরা সংস্কার চান। সংস্কারের মধ্যে লুটপাট এবং গণহত্যার বিচারও যুক্ত, তা তাঁরা চাইতেই পারেন। তাঁরা মনে করতেই পারেন বর্তমান সময়টি সংস্কারের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ইতিমধ্যে তাঁরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের অভিপ্রায় জানিয়েছেন।

এর মানে তাঁরা কি ক্ষমতায় থেকে রাজনৈতিক দল গঠন করছেন? শিক্ষার্থীরা বা তাঁদের প্রতিনিধিরা তো ক্ষমতায় আছেন। এসব প্রশ্ন কোথাও কোথাও থেকে উঠে আসছে। প্রশ্নগুলো তীব্র হয়েছে বিশেষ করে ১৯ ডিসেম্বর ঢাকার প্রেসক্লাবে অনুষ্ঠিত কাউন্সিলরদের সমাবেশের পর। 

পাঠক, এ কথা সবাই জানেন, পরপর তিনটি জাতীয় সংসদের নির্বাচন থেকে এসব পৌরসভার নির্বাচনকে কোনোভাবে আলাদা করার উপায় নেই। তাঁদেরকে স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বলা প্রহসন ছাড়া আর কিছু নয়। তাঁদের ৯০ শতাংশই ছিলেন আওয়ামী দুঃশাসনের প্রত্যক্ষ অংশ। পরবর্তী সময়ে অবশ্য এই সভার আয়োজক ছাত্র সমন্বয়কারী এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু মানুষ এসব বিশ্বাস করেছে বলে মনে হয় না। 

এসব কাউন্সিলরের ৯০ শতাংশই ছিলেন আসলে বিএনপি-জামায়াতের লোক—এ কথা কেউই বিশ্বাস করবে না, তা সবাই বোঝে। এসব কথা আসলে বহুল উচ্চারিত সস্তা রাজনৈতিক বক্তৃতা। মানুষ নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে এসব শিখেছে। আর এবারের মহান আগস্ট অভ্যুত্থান গণমানুষের চেতনার মানকে আরও প্রখর এবং শাণিত করেছে। আরও প্রাণিত, প্রশস্ত করেছে। 

এসবের উদ্ভাস আজ বেশি করে প্রত্যাশিত এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে। আগস্টে তাঁরাই অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। নতুন রাজনীতির যে প্রত্যাশা, তা কপটতা বা মিথ্যাচারকে অনুমোদন করে না। 

মাহমুদুর রহমান মান্না সভাপতি, নাগরিক ঐক্য