মুকেশ আম্বানি ভারতের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। ধনীদের চালচলন নানাদিক থেকে ভিন্ন হলেও যে একটি ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে এদের মধ্যে অদ্ভুত একটি মিল লক্ষ করা যায় তা হলো, বিত্তের বৈভব এদের কতটা বিস্তৃত, অন্যদের তা দেখিয়ে দেওয়ার মধ্যে তৃপ্তির স্বাদ খুঁজে পাওয়া। আম্বানিরাও এর বাইরের কোনো মানুষ নন।
এই ধনিক শ্রেণির প্রতিনিধিদের মধ্যে দ্বিতীয় যে মিল খুঁজে পাওয়া যায় তা হলো, বিত্তের সেই বৈভব দেখিয়ে দিতে এদের সংবাদমাধ্যমের লাগামহীন ব্যবহার। নিজে এরা কতটা ধনী, অন্যরা তা বুঝতে না পারলে সে রকম ধনী হওয়ার আদৌ কোনো অর্থ আছে কি?
চারপাশের বিত্তবান অন্যান্য পরিবারের মতোই সীমিত বিত্তের সেই বন্ধনে নিজের আবদ্ধ থাকা এদের মনে তৃপ্তি এনে দেয় না। আর এ কারণেই সংবাদমাধ্যমকে কাজে লাগিয়ে অন্যদের চেয়ে আরও কতটা উঁচুতে নিজের অবস্থান, তা দেখিয়ে দিতে এদের বিবেক সদা জাগ্রত।
আমরা এখন অবাক হয়ে দেখছি অলংকারের ভারে নেতিয়ে পড়া বিয়ের আসরের কন্যা কীভাবে সংবাদমাধ্যম থেকে অবলীলায় বিতাড়িত করে দিচ্ছে রাস্তার পাশে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের করুণা ভিক্ষা করা অর্ধউলঙ্গ শিশুটিকে কিংবা হাসপাতালে ধরনা দিতে এসেও বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া কঙ্কালসার বৃদ্ধটিকে।
বিত্তের লাগাম এদের হাতে ধরা থাকায় সংবাদমাধ্যমের আয়ের প্রধান যে উৎস হচ্ছে বিজ্ঞাপন, সেটাও বলা যায় অনেকাংশে এদের নিয়ন্ত্রণে। ফলে ধনকুবের না চাইলেও সংবাদমাধ্যম যে তলানিতে জমা হওয়া লাভের ক্ষুদ্র এক ভগ্নাংশের প্রত্যাশায় এদের যেকোনো কীর্তিকলাপ ঢোল পিটিয়ে প্রচার করায় ব্যস্ত হবে, সেটাও এদের ভালোভাবে জানা।
ফলে দুইয়ে দুইয়ে মিলে চার হয়ে যাওয়ার যে অলঙ্ঘনীয় নিয়ম, সেটাই এই ক্ষেত্রে কাজ করে যেকোনো আদর্শ বা আপ্ত বাক্যের চেয়ে অনেক বেশি ফলপ্রসূভাবে। আম্বানি পরিবারের কোনো এক সদস্যের বিয়ে নিয়ে আমাদের বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে বয়ে যাওয়া ঢেউ সেই বার্তা দিচ্ছে নাকি?
বিয়ের পোশাকে কোন ধরনের অলংকার ব্যবহার করা হয়েছে এবং এসবের মূল্যই বা কত, সেগুলো যে জাতীয় দৈনিক কিংবা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় দিনের পর দিন ধরে আলোচিত হতে পারে, অনেকেরই হয়তো তা জানা ছিল না। তবে আম্বানি পরিবারের বিয়ে আমাদের সেই ভুল ভেঙে দিয়েছে।
আমরা এখন অবাক হয়ে দেখছি অলংকারের ভারে নেতিয়ে পড়া বিয়ের আসরের কন্যা কীভাবে সংবাদমাধ্যম থেকে অবলীলায় বিতাড়িত করে দিচ্ছে রাস্তার পাশে হাত পেতে দাঁড়িয়ে থেকে আমাদের করুণা ভিক্ষা করা অর্ধউলঙ্গ শিশুটিকে কিংবা হাসপাতালে ধরনা দিতে এসেও বিনা চিকিৎসায় মারা যাওয়া কঙ্কালসার বৃদ্ধটিকে।
অথচ আম্বানি নয় বরং এরাই তো হওয়ার কথা ছিল সংবাদের আলোচিত চরিত্র, এ কারণে যে আমরা জানি এদের সেই হতদরিদ্র জীবন থেকে উদ্ধার না পাওয়ার পেছনে অন্তত আংশিকভাবে হলেও জড়িয়ে আছে ধনীদের শোষণ, যে ধনিক শ্রেণির নেতৃস্থানীয় এক প্রতিনিধি হচ্ছে আম্বানি পরিবার।
আম্বানিরা যে ভারতে কয়েক প্রজন্ম ধরে বিত্তের শীর্ষে অবস্থান করছে তা তো নয়। বরং এদের ধনী হয়ে ওঠা সাম্প্রতিক সময়ে এবং অন্যান্য নব্য ধনীদের মতোই এরাও নিজেদের বিত্তের পাহাড় বুক চিতিয়ে অন্যকে দেখিয়ে দেওয়ার খেলায় পিছিয়ে নেই।
সেই পরিবারের কোনো এক সদস্যের বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়োজন নিয়ে দিনের পর দিন ধরে নানা রকম ছবি, ভিডিও ক্লিপিং ও সংবাদ প্রচার করে যাওয়ার চেয়ে বরং বিয়েকে উপলক্ষ ধরে নিয়ে এদের বিত্তের পাহাড়ের আড়ালে পড়ে থাকা শোষণ আর বঞ্চনার কাহিনির ওপর কিছুটা হলেও আলোকপাত করা হলেও আপাত ভারসাম্য হয়তো গড়ে নেওয়া যেত।
তবে আমরা জানি তা হওয়ার নয়; এ কারণে যে রাস্তার সেই অর্ধউলঙ্গ শিশু কিংবা চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে বুকের হাড় বের হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ-সংবাদমাধ্যমকে নিজের চরম দারিদ্র্য দেখিয়ে দেওয়া ছাড়া এদের যে আর কিছুই দেওয়ার নেই। ফলে যা হওয়ার তাই এখানে হয়েছে।
আমরা দেখছি অলংকারের ভারে নতজানু হয়ে পড়া এক কনের বিকৃত অভিব্যক্তির ছবি, স্বাভাবিক বিচার-বুদ্ধিসম্পন্ন কোনো মানুষের পক্ষে সৌন্দর্যের উপস্থিতি যেখানে খুঁজে পাওয়া আদৌ সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। তবে তারপরও সংবাদমাধ্যমকে এরা টানছে, এ কারণে যে সেই বিকৃতির আড়ালে রয়ে গেছে বিজ্ঞাপন নামের এক থলের বিড়াল, যার সক্রিয় সাহায্য-সহযোগিতা ছাড়া সংবাদমাধ্যমের পক্ষে টিকে থাকা কষ্টকর। ফলে অযথা কেন কষ্টের জীবন বেছে নেওয়া?
মুখে আমি দারিদ্র্য আর শোষণের বিরুদ্ধে নিরলসভাবে চালিয়ে যাওয়া সংগ্রামের কথা বলে গেলেও কাজে আমি কতটা আন্তরিক, সময়ে-সময়ে আম্বানিদের উপস্থিতি মনে হয় সেই সত্যকে আরও অনেক বেশি নগ্নভাবে আমাদের সামনে তুলে ধরে। ফলে জয় বাবা আম্বানি, জয় আপনার পুত্র-কন্যা ও বংশের বিদ্যমান ও অনাগত সব প্রজন্ম!
আপনার সেবাতেই তো আমার স্বর্গপ্রাপ্তি, যদিও আমি মুখে যতই বলে যাই না কেন সমাজকে শোষণ, বঞ্চনা ও দারিদ্র্যমুক্ত করতে পারাই হচ্ছে আমার জীবনের ব্রত।
মনজুরুল হক সাংবাদিক