যুক্তরাষ্ট্রের ঝানু কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার বলেছেন, ইউক্রেন সংঘাত মীমাংসার শর্ত এ বছরের শেষে পোক্ত হয়ে উঠবে। মধ্যস্থতার ভূমিকায় চীনের আবির্ভাব এবং রুশদের তাতে মনোযোগ দেওয়া—এ হিসাব–নিকাশের ওপর ভিত্তি করে তিনি এ কথা বলেছেন।
যা হোক, কিসিঞ্জারের এ ভবিষ্যদ্বাণী একটি বিষয় অনুপস্থিত রয়েছে। সেটা চীনের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত বিষয় নয়। রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে নিছক একটি চুক্তির চেয়ে বেশি কিছু চায়। ইউক্রেনকে নিরস্ত্রীকরণ এবং দেশটি যাতে ন্যাটোর সদস্য না হয়, অন্তত এ চাওয়া রয়েছে রাশিয়ার।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনা পুরোপুরি উল্টো। ওয়াশিংটনের ভাবনা হলো, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে আনা যায়—সে রকম কোনো চুক্তিই কেবল গ্রহণযোগ্য হতে পারে।
একই রকমের আরও ধারণা সময়-সময় উসকে উঠছে। এর মধ্যে একটি ধারণা হলো, ইউরোপের কয়েকটি দেশ ও যুক্তরাষ্ট্র মিলে ভবিষ্যতে ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। এ ধারণা করার পেছনে কারণ হলো, ইউক্রেনকে ন্যাটোতে যুক্ত করার মতো যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে যথেষ্ট ভোট রয়েছে।
যদিও ন্যাটোর যেকোনো পদক্ষেপ রাশিয়ার জন্য হবে অভিশাপ। এরপরও অনুমান করা যায়, চুক্তি হলে ইউক্রেনে একটা প্রতিনিধিত্বমূলক নিরাপত্তাব্যবস্থা চালু হতে পারে। কিন্তু দুটি সমস্যাকে কেন্দ্র করে ইউক্রেনে নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে।
প্রথমত, ইউক্রেনের ভেতরে রাশিয়া এখন যে ভূখণ্ড নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, সেখানে সমস্যা তৈরি হবে। দোনেৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া, খেরসন, এমনকি ক্রিমিয়ায় সমস্যা তৈরি হবে।
এ অঞ্চলগুলোর ব্যাপারে স্থায়ী কোনো সমাধানে আসা ইউক্রেনের জন্য ভীষণ রকম কঠিন একটা ব্যাপার হবে। এ ছাড়া আগামী কয়েক মাসের মধ্যে ইউক্রেন যদি সামরিকভাবে পরাজিত করে অঞ্চলগুলো থেকে রুশদের বের করে না দিতে পারে, তাহলে ইউক্রেনের মানচিত্র নতুনভাবে আঁকা ছাড়া বিকল্প কিছু মেনে নিতে রাজি হবে না রাশিয়া।
এ বিশ্লেষণ যদি সঠিক হয়, তাহলে রাশিয়া ও ইউরোপ—দুই পক্ষকে গ্রাস করে ধরা নিরাপত্তাসংকটের সমাধান মস্কো আর কিয়েভের মধ্যে সম্পাদিত কোনো চুক্তির মধ্য দিয়ে মীমাংসা হওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে প্রচুর তথ্যপ্রমাণ আছে, ইউরোপে এখন এই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে যে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল খুব খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। একই সঙ্গে ইউরোপে এ শঙ্কাও ছড়িয়ে পড়েছে যে রুশদের পেছনে লাগার জন্য ভবিষ্যতে তাদের ভালোমতোই ভুগতে হবে।
ইউক্রেনের বর্তমান সরকার সেই পথে যাবে না। এ কারণে এ বিষয়ে মীমাংসায় আসা তখনই সম্ভব হবে, যদি ইউক্রেনে ক্ষমতাসীন সরকারের বদল হয় অথবা রাশিয়া যুদ্ধে পরাজিত হয়।
অন্য সমস্যাটি হলো রুশদের মন। সেটা আসলে ইউক্রেনের বাস্তবতা থেকেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
রাশিয়া বিশ্বাস করে ইউক্রেন যুদ্ধ মূলত ন্যাটো ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের যুদ্ধ। রাশিয়া আরও বিশ্বাস করে, ইউক্রেনের মাটিতে যুদ্ধ হলেও ইউরোপের ঘাঁটি থেকে ইউক্রেনীয়রা সমর্থন পাচ্ছে এবং যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো রাশিয়াকে ভেঙে ফেলার যে পরিকল্পনা করেছে, তার অংশ হিসেবেই এ যুদ্ধ। রাশিয়াকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো এমনভাবে টুকরা করত চায়, যাতে তাদের ওপর আধিপত্য করা যায়। ফিনল্যান্ড ও সুইজ্যারল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য হিসেবে যুক্ত হওয়ায় রুশদের এ সন্দেহ আরও তীব্র হয়েছে। রাশিয়া ন্যাটো, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দিক থেকে সম্মিলিত হুমকি অনুভব করছে।
এ কারণেই পশ্চিমের পণ্ডিতেরা যখন ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন, সে সময় রুশরা তাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কিত।
এখানে একটি বিষয় পুনরুল্লেখ করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছি। ইউক্রেনে আগ্রাসন শুরু করার আগে রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ন্যাটোপ্রধানের কাছে দুটি বার্তা পাঠিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টকে সম্বোধন করে পাঠানো চিঠিতে ইউক্রেন সমস্যার বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। ন্যাটোপ্রধানকে পাঠানো চিঠিতে পূর্ব ইউরোপের নতুন নিরাপত্তাব্যবস্থা চালুর আহ্বান জানানো হয়েছিল। দুটি চিঠিই অপমানজনকভাবে ও শত্রুতার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল।
সেই চিঠিগুলো যদি রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনার একটি ভিত্তি তৈরি করত, তাহলে অন্তত তথাকথিত বিশেষ সামরিক অভিযান পরিচালনা করত না রাশিয়া। রক্তপাত ও ধ্বংসযজ্ঞ এড়ানোর সেই সুযোগ হেলায় হারানো হয়েছে। রাশিয়ার প্রস্তাব দাম্ভিকতার সঙ্গে পশ্চিমাদের প্রত্যাখ্যানের বিষয়টিকেই পরবর্তীকালে রাশিয়া প্রমাণ হিসেবে ব্যবহার করছে। ন্যাটোর উদ্দেশ্য হলো রাশিয়াকে ধ্বংস করা। সেই উদ্দেশ্য পূরণের জন্য তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।
এ বিশ্লেষণ যদি সঠিক হয়, তাহলে রাশিয়া ও ইউরোপ—দুই পক্ষকে গ্রাস করে ধরা নিরাপত্তাসংকটের সমাধান মস্কো আর কিয়েভের মধ্যে সম্পাদিত কোনো চুক্তির মধ্য দিয়ে মীমাংসা হওয়া সম্ভব নয়। এ বিষয়ে প্রচুর তথ্যপ্রমাণ আছে, ইউরোপে এখন এই ভয় ছড়িয়ে পড়েছে যে ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল খুব খারাপ দিকে মোড় নিতে পারে। একই সঙ্গে ইউরোপে এ শঙ্কাও ছড়িয়ে পড়েছে যে রুশদের পেছনে লাগার জন্য ভবিষ্যতে তাদের ভালোমতোই ভুগতে হবে।
এ প্রেক্ষাপটে একমাত্র বাস্তবসম্মত পথ হলো, ইউরোপিয়ানদের তাদের নিরাপত্তার বিষয়ে খোলাখুলিভাবে বলতে হবে। এ নিরাপত্তার প্রশ্ন থেকেই ইউক্রেন যুদ্ধ ও ন্যাটো সম্প্রসারণের ঘটনা ঘটেছে।
এই স্পর্শকাতর ও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা ইস্যুতে কিসিঞ্জার যদি মনোযোগ দিতে পারেন, তাহলে সেটা সবার জন্যই ভালো হবে।
স্টিফেন ব্রায়েন সেন্টার ফল সিকিউরিটি পলিসি অ্যান্ড ইয়র্কটাউন ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত।