জ্যান্ত অবস্থায় যমালয়ে যাওয়ার পর ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় গোঁ ধরলেন, ভগবান বিষ্ণুর সঙ্গে দেখা না করে তিনি মর্ত্যে ফিরবেন না। বিষ্ণু নিরীহ এক ব্রাহ্মণের ছদ্মবেশে ভানুর কাছে এসে বসলেন। দুজনের আড্ডা জমে উঠল।
ভানু বললেন, ‘বুঝলেন মশাই, মর্ত্যলোকে হরিলুট চলছে। কারখানা আছে, কাজ নাই। বাত্তি আছে, কারেন্ট নাই। পাস করা ছেলের চাকরি নাই। ব্যবসায়ীরা সমানে চালে কাঁকর মেশাচ্ছে। একেবারে যাচ্ছেতাই কাণ্ড!’
ব্রাহ্মণরূপী বিষ্ণু বললেন, ‘বলো কী হে! এসব ঠেকানোর জন্য তো ভগবান বারবার তাঁর প্রতিনিধি পাঠাচ্ছেন।’
ভানু বললেন, ‘ধুর মশাই! তারা তো সব উল্টোপাল্টা বোঝাচ্ছে। কেউ বলেছে “ভোগ করো! ” কেউ বলেছে, “ত্যাগ করো”, কেউ বলেছে, “ভোগ, ত্যাগ দুই-ই করো।” এখন কার সাজেশন নিয়ে কোন পজিশনে যাব, সেই ডিসিশন নিতে গিয়েই তো জান কয়লা!’
আমাদের এখন ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’ ছবির সেই ভানুর দশা চলছে। দেশজুড়ে যখন কিস্তিভিত্তিক কুইক রেন্টাল লোডশেডিং চলছে, মোটা চাল ৫০ আর নাজিরশাইল যখন ৯০ টাকার আগায় বসে ভেংচি মারছে, মনের বাজার যখন মন্দা, আনন্দের রিজার্ভ মানিতে যখন ধস, ফিউচারের ফরেন কারেন্সি যখন শর্ট, টাইফয়েডের আগে খুশখুশানি কাশির মতো চারদিকে যখন ‘শ্রীলঙ্কান সিনড্রোমের’ ফিসফাস, তখন একদল অর্থনীতিবিদ বলছেন, ‘সাবধান! ট্যাঁকের টাকা সামলান, একটা পয়সা আজাইরা খরচ করবেন না, সামনে অবস্থা গুরুচরণ’; আরেক দল বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘এখনই শ্রীলঙ্কা রোগে ধরবে না, সময় এখনো হাতে আছে’, অন্যদিকে অর্থমন্ত্রী বলছেন, ‘ডোন্ট ওরি! নাই নাই করেও রিজার্ভ আছে চার হাজার কোটি ডলার, টেনশনের কিছু নাই।’
বাজারে গিয়ে পটোলের দাম শুনে যখন খাব না তুলব, ভাবতে ভাবতে খাবি খাচ্ছি, ঠিক তখন খবর বেরিয়েছে, রাজধানীর হোটেল সারিনা সোনার প্রলেপ দেওয়া একেকটি আইসক্রিম লাখ টাকায় বিক্রির ঘোষণা দিয়েছিল। একদিনেই তাদের প্যাকেজটি ‘ওভারবুকড’ হয়ে গেছে এবং সে কারণে এর অর্ডার নেওয়া তারা বন্ধ করে দিয়েছে। একটা আইসক্রিম এক লাখ টাকায় কিনে খাওয়ার মতো বড়লোকের সংখ্যা এই দেশে কত, তা এ ঘটনায় আন্দাজ করা যায়।
একদিকে পটোল কিনতে গিয়ে তুলে ফেলা লোক শ্রীলঙ্কা সিনড্রোমের ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে চরম গরমে পরম আরামে চক্ষু মুদে লাখ টাকার আইসক্রিম খাওয়া লোকেরা অর্থমন্ত্রীর ‘নাই নাই করেও রিজার্ভ আছে চার হাজার কোটি ডলার’ শুনে নো টেনশনে নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। মাঝখান থেকে মধ্যবিত্ত কাঙালসমাজ বুঝে উঠতে পারছে না আদতে ঘটনা কী? তাদের সামনে বিশেষজ্ঞদের পাওয়ার পয়েন্টে দেখানো থিউরিটিক্যাল অর্থনীতি এক রকম; আর বাজারে গিয়ে তেল-নুন কেনার প্র্যাকটিক্যাল অর্থনীতি আরেক রকম। এক পরাবাস্তব কলে আটকা পড়ে তারা ভানুর মতো বিভ্রান্ত হয়ে আছে। তারা কার সাজেশন নিয়ে কোন পজিশনে গিয়ে কোন ডিসিশন নেবে, তা ঠিক করে উঠতে পারছে না।
এই বিভ্রান্তির বড় কারণ হলো, টাঁকশালে জমানো টাকাকড়ি ও আর্থিক প্রবৃদ্ধির হিসাব–নিকাশসংক্রান্ত প্রশ্নের উত্তর অর্থনীতিবিদদের কাছে এক রকম, আর রাজনীতিকদের কাছে আরেক রকম। অর্থ নিয়ে অর্থনীতিবিদদের (ভাড়াটে অর্থনীতিবিদেরা নন) উত্তর আগাগোড়া অপরিবর্তিত থাকে। দেশের অর্থনীতি কী অবস্থায় আছে, তা তাদের সেই উত্তরে পাওয়া যায়। আর রাজনীতিকদের উত্তরগুলো হলো একেকটি অস্ত্র; রাজনৈতিক অস্ত্র। তাঁদের রাজনৈতিক বয়ানে, ভাষণে সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়।
মধ্যবিত্ত কাঙালসমাজ বুঝে উঠতে পারছে না আদতে ঘটনা কী? তাদের সামনে বিশেষজ্ঞদের পাওয়ার পয়েন্টে দেখানো থিউরিটিক্যাল অর্থনীতি এক রকম; আর বাজারে গিয়ে তেল-নুন কেনার প্র্যাকটিক্যাল অর্থনীতি আরেক রকম। এক পরাবাস্তব কলে আটকা পড়ে তারা ভানুর মতো বিভ্রান্ত হয়ে আছে। তারা কার সাজেশন নিয়ে কোন পজিশনে গিয়ে কোন ডিসিশন নেবে, তা ঠিক করে উঠতে পারছে না।
অর্থমন্ত্রী সংসদে কিংবা সাংবাদিকদের সামনে দাঁড়িয়ে যখন প্রবৃদ্ধির হারকে আসমান বরাবর তুলে নেওয়ার এবং মুদ্রাস্ফীতিকে জমিনের সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার কথা বলেন, তখন অনুগত শ্রোতামণ্ডলী খুশির চোটে হাততালির ঝড় তোলেন; যদিও প্রবৃদ্ধি কিংবা মুদ্রাস্ফীতির হার ঠিক কী জিনিস, এসব বস্তু খায় নাকি মাথায় দেয়, অধিকাংশ শ্রোতাই তা জানে না। সম্ভবত বেশির ভাগ নেতারও এ বিষয়ে ধারণা স্পষ্টতর নয়। কিন্তু বড় নেতারা আর্থিক প্রবৃদ্ধির হিসাব দাখিল করে দারিদ্র্য এবং লোডশেডিংকে জাদুঘরে পাঠানোর হুংকার দিয়ে আনন্দ পান। অনুগত সুধী দর্শক ও শ্রোতৃমণ্ডলী ততোধিক আমোদ পেয়ে করতালি দেন।
কিন্তু সেই গুণমুগ্ধ শ্রোতৃমণ্ডলীর কারও কারও করতালি মিইয়ে আসতে শুরু করেছে। নেতাদের কথায় তাঁদের কেউ কেউ সন্দেহ করতে শুরু করেছেন। কারণ, সরকারের কাছে সর্বোচ্চ মাত্র ৪০ দিনের জ্বালানি তেলের রিজার্ভ আছে। এটা সম্ভাব্য জ্বালানিসংকটের আলামত। এই আলামত ভালো না।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন, রিজার্ভের পরিমাণ আছে ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। এই রিজার্ভ কমে যাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন হতেও তিনি মানা করেছেন। কিন্তু একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, অর্থমন্ত্রী সাড়ে চার হাজার কোটি ডলারের বেশি আছে বললেও সেই অর্থের একটি বড় অংশ ‘পরহস্তে ধন’ হিসেবে আছে। রপ্তানি উন্নয়ন তহবিল বা ইডিএফ, নন-ইনভেস্টমেন্ট গ্রেড বন্ড, বিভিন্ন সরকারি ব্যাংককে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, উন্নয়ন প্রকল্পে দেওয়া রিজার্ভ ঋণ, শ্রীলঙ্কা ও সুদানকে দেওয়া ঋণ ইত্যাদিসহ রিজার্ভ ঋণগুলো আটকে যাওয়ায় এসব রিজার্ভ খাতায় আছে কিন্তু হাতে নেই। আইএমএফের হিসাবে, আমাদের খরচ করার মতো রিজার্ভ আছে ৩২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এ মুহূর্তে খরচের মতো রিজার্ভ অবিশ্বাস্যভাবে কম। আবার মূল্যস্ফীতিও এখন গত ৯ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। হাতে থাকা ডলার যাতে খরচ না হয়ে যায়, সে জন্য বিদ্যুৎ ব্যবহার কমানোর চেষ্টা করছে সরকার। এ অবস্থায়ও সরকারের একজন সচিব বলেছেন, ‘আতঙ্কিত হওয়ার কোনো কারণ নেই।’
সরকারের এলাকাভিত্তিক লোডশেডিং তালিকা প্রকাশে লাখ টাকার আইসক্রিম খাওয়া পাবলিক এখনো আতঙ্কিত হয়নি। কিন্তু বাজার করতে গিয়ে চোখে শর্ষে ফুল দেখা মানুষ আতঙ্কে না পড়লেও উদ্বেগে আছে। অনুজ সাংবাদিক এহসান মাহমুদ প্রশ্ন ছুড়েছেন, ‘লোডশেডিং থাকার কথা জাদুঘরে। বাইরে এল কেন? কারা বের করল?’ আমাদের মনে ভয়ার্ত প্রশ্ন জেগে উঠছে, সরকারের ভেতরের লোকদের বারবার কেন বলতে হচ্ছে, ‘ভয় নেই, নো টেনশন’?
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক
ই-মেইল: [email protected]