যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনের পর মার্কিন নাগরিকেরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলছেন এই ভেবে যে ভোটের সময় ভোটার এবং নির্বাচনী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সহিংসতার যে হুমকির আভাস সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া যাচ্ছিল, বাস্তবে তেমনটি ঘটেনি। বোঝা যাচ্ছে, আমরা এমন একটি খারাপ সময় পার করছি, যখন শান্তিপূর্ণভাবে ভোট সম্পন্ন হলে আমরা একই সঙ্গে আনন্দ পাচ্ছি, আবার বিস্মিত হচ্ছি।
প্রশ্ন উঠছে, সুষ্ঠু নির্বাচনের বৈধতা প্রত্যাখ্যান করতে, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব গ্রহণ করতে এবং রাজনৈতিক সহিংসতার পথে যেতে কিছু লোককে ঠিক কোন বিষয়টি প্ররোচিত করছে? আমরা বিশ্বাস করি, উত্তরটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্রের পথে দাঁড়ানো একটি অভিনব হুমকির মধ্যে লুকায়িত রয়েছে।
সেটি হলো তথ্য নিরাপত্তাহীনতা। এটি বেশির ভাগ সময়ই প্রোপাগান্ডার চেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তথ্য নিরাপত্তাহীনতার সুযোগে ডিজিটাল সক্ষমতা দিয়ে তথ্যের সমগ্র ইকোসিস্টেম বা বাস্তুতন্ত্রের পদ্ধতিগত বিকৃতি ঘটানো সম্ভব।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং জলবায়ু নিরাপত্তাহীনতার সমান্তরাল বিবেচনা করুন। অতীতে আমরা হারিকেন, খরা এবং বন্যাকে বিচ্ছিন্ন জরুরি অবস্থা হিসেবে মোকাবিলা করেছি। কিন্তু আজ আমরা জলবায়ু পরিবর্তনকে কৃষি, বিদ্যুৎ এবং জননিরাপত্তার সমগ্র ব্যবস্থার জন্য হুমকি হিসেবে বুঝি। একইভাবে আজ আমরা খাদ্যনিরাপত্তাহীনতাকে শুধু জীবনের জন্য নয়, বরং সামাজিক সংহতি ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও একটি স্থায়ী হুমকি হিসেবে বুঝি।
এ কারণেই পদ্ধতিগত হুমকির জন্য একটি পদ্ধতিগত মোকাবিলা ব্যবস্থা প্রয়োজন। বিংশ শতাব্দীর কৌশল ছিল, প্রতিপক্ষের কৃতিত্ব যেসব চ্যানেলে প্রচারিত হয়, সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন করা বা ব্লক করে দেওয়া। কিন্তু আজকের দিনে তা যথেষ্ট হবে না। আজকের তথ্যসংক্রান্ত ক্রিয়াকলাপ শত শত চ্যানেলজুড়ে বিস্তৃত। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে নানা ধরনের সম্প্রচার মাধ্যম এখন সক্রিয়।
এখানে নামে–বেনামে হাজার মাধ্যমে প্রোপাগান্ডা ছড়ানো হয়। উদাহরণস্বরূপ, ক্রেমলিন শুধু রাষ্ট্রীয় মিডিয়া চ্যানেল, সম্প্রচারযন্ত্র এবং ডিজিটাল প্লাটফর্মে তার ইউক্রেন-সম্পর্কিত প্রচার চালায় না। তারা একাধিক ভাষায় পরিচালিত বহু প্ল্যাটফর্মজুড়ে গোপন ডিজিটাল চ্যানেলগুলোর একটি বৃহৎ নেটওয়ার্কের ওপরও নির্ভর করে।
বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যনিরাপত্তা, সংক্রামক রোগ, জ্বালানিঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে খারাপ অবস্থায় আছে। এসব হুমকি বিশ্বনেতারা মোকাবিলা করছেন। এ তালিকায় তথ্যনিরাপত্তাহীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এ চ্যানেলগুলো কিয়েভ সম্পর্কে ষড়যন্ত্রের তত্ত্বগুলো ছড়িয়ে দেয়। রাশিয়ার দ্বারা অবরুদ্ধ করা খাদ্য চালানের অনুপস্থিতির জন্য তারা পশ্চিমকে দোষারোপ করে এবং জ্বালানির দাম এবং শরণার্থীদের নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে অস্থিরতা সৃষ্টি করে। এ কৌশলগুলো দেশি ষড়যন্ত্রকে প্রসারিত করে এবং বিদেশি ও দেশীয় এজেন্টদের মধ্যে পার্থক্যকে অস্পষ্ট করে। উদ্দেশ্যটি কেবল নিজেদের প্রচার চালানো, সত্যের প্রতি আস্থাকে দুর্বল করা এবং সর্বত্র ‘ভুয়া খবর’ সম্পর্কে সন্দেহের বীজ বপন করা।
চীনের মতো স্বৈরাচারী সরকারগুলো অভ্যন্তরীণভাবে মিডিয়াকে হুমকি হিসেবে দেখে এবং সেগুলোর ওপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চায়। যদিও কর্তৃপক্ষ অনলাইনে সব ভিন্নমতের মতামতকে নির্মূল করতে পারে না, তবে তারা বড় বড় বাধা তৈরি করতে পারে।
গণতান্ত্রিক সমাজে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। সেই মতপ্রকাশ নিশ্চিত করতে সরকারকে জবাবদিহিমূলক অবস্থায় রাখা অপরিহার্য। বহু কর্তৃত্ববাদী সরকার ভিন্নমতাবলম্বীদের ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউবসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকে নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করে। এর বাইরে তারা এসব মাধ্যমকে নিজেদের প্রোপাগান্ডা ছড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে।
এ ধরনের সরকারের এ তৎপরতা ঠেকাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্মগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং দমন নীতি অনুসরণ করা সরকারগুলো যাতে নিজেদের ক্ষমতা ধরে রাখতে প্লাটফর্মগুলো ব্যবহার করতে না পারে, সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিশ্ব এখন জলবায়ু পরিবর্তন, খাদ্যনিরাপত্তা, সংক্রামক রোগ, জ্বালানিঘাটতি এবং মুদ্রাস্ফীতির কারণে খারাপ অবস্থায় আছে। এসব হুমকি বিশ্বনেতারা মোকাবিলা করছেন। এ তালিকায় তথ্যনিরাপত্তাহীনতাকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
অ্যান-মারি স্লটার গবেষণাপ্রতিষ্ঠান নিউ আমেরিকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বেন স্কট যৌথ ফাউন্ডেশন ও অ্যাডভোকেসি সংস্থা দ্য ওমিডিয়ার গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান রিসেটের পরিচালক