অভিমত
বন রক্ষায় কেন বনজীবীদের সম্পৃক্ত করা হবে না
তাপপ্রবাহ কোনো গোপন বিষয় ছিল না। আগুনপ্রবণ এলাকাও ছিল সবার চেনা। সুন্দরবনে আগুন লাগার ক্ষেত্রে ঢালাওভাবে বনজীবীদের দায়ী না করে প্রাকৃতিক কারণগুলো খতিয়ে দেখা উচিত। বন রক্ষায় কেন বনজীবীদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন, তা নিয়ে লিখেছেন গওহার নঈম ওয়ারা।
বন রাঙা হওয়ার কথা ছিল কুসুমে, কিন্তু রাঙা হলো আগুনে।
বসন্তের শেষে গ্রীষ্মে সুন্দরবনের চেহারায় অন্য এক খোলতাই আসে। মধু সংগ্রহের সময় সাধারণত মার্চ মাসের শেষের দিক থেকে জুন মাস পর্যন্ত। এই সময়ে সুন্দরবনে নানা রঙের ফুল ফোটে। কেওড়া, খলিশা, হরকোচা থেকে শুরু করে প্রায় সব গাছ ফুলে ফুলে সেজে ওঠে। কাঁটায় ভরা হরকোচাও মনোহর হয়ে ওঠে।
বৈচিত্র্যময় রূপের অধিকারী খলিশা ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি। তার সঙ্গে নতুন গজানো পাতা ও বাহারি শাঁসমূলের সমাহারে এক অন্য সুন্দরবন জেগে ওঠে। তবে মার্চ মাস থেকে দুর্যোগ মৌসুম শুরু হলে সুন্দরবনে পর্যটকদের আনাগোনা সীমিত হয়ে যায়। ফলে অনেক পর্যটকের কাছে সুন্দরবনের এই সৌন্দর্য থাকে অদেখা।
শনিবার (৪ মে) দুপুরে মোরেলগঞ্জের নিশানবাড়িয়া থেকে আগুন লাগার খবর আসে। অনলাইন পোর্টালগুলোতে বিকেল চারটার মধ্যে সে খবর চাউর হয়ে যায়। ওই দিন দুপুরে স্থানীয় জেলেরা সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের আমুরবুনিয়া টহল ফাঁড়িসংলগ্ন বনাঞ্চলে আগুন দেখতে পান।
আগুন লাগার খবর শুনে নিশানবাড়িয়া ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. আবু তাহের মিয়া স্থানীয় বাসিন্দাদের নিয়ে অকুস্থলে ছুটে যান। তিনি সেখান থেকে প্রথম আলোকে জানান, ‘সুন্দরবনে আমুরবুনিয়া ফাঁড়ির কাছেই আগুন লেগেছে। বেশ বড় এলাকা। আগুন ছড়াইছে অন্তত তিন কিলোমিটার। সবাই চেষ্টা করছে। যেভাবে লাগছে, তাতে আগুন থামানো কঠিন আছে।’
শনিবার সকালে নিশানবাড়িয়ার লোকজন আগুনের অবস্থান টের পেলেও বনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকের বিশ্বাস, আগুন আরও কয়েক দিন আগে লেগেছিল। স্থানীয় ভিলেজ কনজারভেশন ফোরামের (ভিসিএফ) একজন সদস্য সে রকমই দাবি করেছেন। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, আগুন লেগেছে কয়েক দিন আগে।
ওই সদস্য বলেন, ‘এক-দুই দিন আগে আগুন লাগে। এখন ছড়িয়ে পড়ছে। অন্তত ৫ বিঘা এলাকায় আগুন ছড়াইছে। জান বাজি রেখে গ্রামবাসী ছুটে গিয়েছিলেন আগুন নেভাতে। স্থানীয় বাসিন্দারা বালতি ও কলসি নিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ শুরু করেন। সে কাজ বেশি দূর এগোয়নি। আগুন নেভানোর নানা বাহিনী গোছগাছ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে যায়। নিরাপত্তার কথা ভেবে আগুন নেভানোর অভিযান রোববার সকাল পর্যন্ত মুলতবি করা হয়। অভিযান মুলতবি রাখায় আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকলেও সেটা হয়নি।’
পরিবেশ মন্ত্রণালয় সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর যেসব স্থানে বিক্ষিপ্তভাবে ছোট পরিসরে আগুন ও ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিল, তা নিভিয়ে ফেলা হয়েছে। ড্রোনের টহল অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রতিনিয়ত মনিটরিং করা হচ্ছে। মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সোমবার (৬ মে) তিনবার আগুনের ধোঁয়া শনাক্ত করে তা দ্রুত নিভিয়ে ফেলা হয়েছে।
কেন আগুন লাগে বারবার
২০০২ সালের ২২ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্যে আগুন লাগে। এর পর থেকে বাংলাদেশ দুর্যোগ প্রস্তুতি ফোরাম আগুনের হিসাব রাখা শুরু করে। তাদের সংরক্ষিত হিসাব অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০২৪ (৪ মে পর্যন্ত) সালের মধ্যে এ নিয়ে ২৫ বার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
এই হিসাব সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের সংকলনমাত্র। এমন অনেক আগুন আছে, যা বনজীবীরা ‘ম্যানেজ’ করে ফেলেন। সংবাদ বা প্রতিবেদনে সেগুলোর উল্লেখ থাকে না। শুধু সেসব আগুনের খবর প্রকাশিত হয়, যেসব আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিস বা অন্য কোনো সংস্থার সহযোগিতা লাগে।
এখন পর্যন্ত আগুন–পরবর্তী যতগুলো তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তার প্রায় সব কটিতেই বনজীবীদের দায়ী করা হয়েছে। বলা হয়েছে, আগুনের পেছনে আছে বন ব্যবহারকারীদের অসচেতনতা। তা ছাড়াও বনসংলগ্ন নদ-নদী মরে যাওয়া, নাশকতা, ফেলে দেওয়া বিড়ি-সিগারেটের আগুনকে দায়ী করা হয়। এবার আগুনের পর থেকে তীব্র তাপপ্রবাহের দিকে আঙুল তোলা হচ্ছিল।
আগুনের তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এখন পর্যন্ত যত আগুন লেগেছে, তার বেশির ভাগই লেগেছে শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জে। ফলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসের এই সময়ে কেন বারবার সুন্দরবনের একটা নির্দিষ্ট এলাকায় আগুন লাগে?
কেন শরণখোলা ও চাঁদপাই রেঞ্জ? শুষ্ক মৌসুমে মার্চ-এপ্রিল-মে মাসে বন কর্মকর্তারা কি অতিরিক্ত সতর্কতা অবলম্বন করেন নাকি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো ‘দেখি না কী হয়’ নীতি অনুসরণ করেন।
আগুন লাগার পর ড্রোনের কথা শোনা যাচ্ছে। তাপপ্রবাহ কোনো গোপন বিষয় ছিল না। আগুনপ্রবণ এলাকাও ছিল সবার চেনা। তারপরও কেন তিন কিলোমিটার দূরে বসবাসকারী গ্রামবাসী মারফত শুনতে হলো আগুনের প্রথম খবর। সুন্দরবনের শরণখোলা, চাঁদপাই রেঞ্জ ও আশপাশ এলাকায় যাতে আগুন লাগাতে না পারে, সে জন্য এসব এলাকায় বনকর্মীদের টহল বাড়ানোর সুপারিশ আগেও করা হয়েছিল, কেউ শোনেনি।
যেসব গ্রামবাসী দূর থেকে হাঁড়ি–বালতি নিয়ে আগুন নেভাতে ছুটে আসেন, তাঁদের পক্ষে বন ধ্বংসের জন্য বিড়ি-সিগারেটের আগুন, মৌয়ালদের মৌমাছি খেদানো মশাল দিয়ে বনে আগুন দেওয়া সহজ নয়। এটা ঠিক, মৌয়ালেরা মাছ ধরার জন্য লতাগুল্ম পরিষ্কার করতে কখনো–সখনো ছোটখাটো আগুন দেন, কিন্তু নিজেদের স্বার্থেই সেটা থাকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রিত।
বনে আগুন লাগার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক কারণগুলো আমাদের খতিয়ে দেখা উচিত। অনেক সময় গাছের পাতা পড়ে পাতার একটা পুরু স্তর তৈরি হয়। জোয়ারের পানিতে পাতা পচে সেখান থেকে মিথেন গ্যাস তৈরি হয়। মিথেন গ্যাস থেকেও আগুনের সূত্রপাত হতে পারে।
সুন্দরবনের পানির উৎসগুলোর প্রতি কারও নজর আছে কি? পূর্ব সুন্দরবনের একদা জিয়নকাঠি ভোলা নদী এখন ‘মৃত’। সেই সঙ্গে সুন্দরবনের ছোটখাটো অনেক নদী ও খাল মরে যাওয়ার কারণে অনেক এলাকা শুকিয়ে গেছে। নদী-জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় শুষ্ক অঞ্চল আগুনের সূত্রপাতে সহায়তা করছে।
আগের তদন্ত কমিটির সুপারিশগুলো কেন আমলে নেওয়া হয়নি, সেটা এবার আলোচনায় ফিরিয়ে আনতে হবে। অন্যথায় আগুন লাগার পর কমিটি গঠন করে লাভ কী? আগের সুপারিশগুলোর মধ্যে ছিল বনকর্মীদের টহল জোরদার; দ্রুত আগুন নেভানোর জন্য রিভার ফায়ার স্টেশন তৈরি; পর্যবেক্ষণ টাওয়ার নির্মাণ; সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জে বেড়া নির্মাণ; বনসংলগ্ন ভরাট হয়ে যাওয়া ভোলা নদী, খাল পুনঃখনন ইত্যাদি।
আবার তদন্ত কমিটি
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষককে সভাপতি এবং খুলনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করে কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি (সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ), বাগেরহাটের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি
অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক এস এম ফিরোজ, বেসরকারি সংগঠন আরণ্যক ফাউন্ডেশনের ম্যানগ্রোভ ইকোলজিস্ট এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক স্বপন কুমার সরকার এবং ওয়াইল্ডলাইফ কনজারভেশন সোসাইটির একজন প্রতিনিধি।
কমিটিকে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে বনজ সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ ও পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সুপারিশ প্রণয়নসহ বিস্তারিত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
যোগ্যতা ও মেধায় তাঁরা সবাই নমস্য। দেবালয়ে বসে দেবতারা সব করলেও মাঝেমধ্যে উৎসবে–সংকটে তাঁরা মর্ত্যে ছদ্মবেশে ঘুরে যেতেন বা দূত পাঠাতেন। তাঁদের পরামর্শ আমলে নিতেন।
এসব নিছক পৌরাণিক কল্পকথা বলে আমরা বাতিল করে দিতে পারি, কিন্তু এটা তো মানতে হবে, বনজীবীদের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো কমিটি পূর্ণাঙ্গ হবে না। যাঁরা আগুনের খবর দিয়ে বসে না থেকে কলসি–বালতি নিয়ে আগুন নেভাতে ছুটে যেতে পারেন, বন রক্ষায় তাঁদের হিস্যা দিতেই হবে। তাঁদের প্রতিনিধিকে পূর্ণ সদস্যের মর্যাদায় এসব কমিটিতে রাখা মানবাধিকারের প্রতি সম্মান জানানোর বহিঃপ্রকাশ।
অনেকের ধারণা, বন ধ্বংস করেন বনজীবীরা। মানুষকে বন থেকে সরিয়ে ফেলতে পারলেই বন রক্ষা হবে। এটা যে একটা ভুল ধারণা, তার একটি উদাহরণ মনে পড়ল।
একসময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন জওহরলাল নেহরু। বন থেকে বনবাসীদের সরিয়ে ফেলার জন্য বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ প্রায় মেনে নিয়েছিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত হয়েছিল বন খালি করে বনজীবীদের অন্য জায়গায় পুনর্বাসিত করা হবে। তাঁদের জন্য পড়াশোনা আর অন্য জীবিকার ব্যবস্থা করা হবে।
এই সময় একদিন উত্তর ভারতে রাষ্ট্রীয় কাজে যাওয়ার সময় নেহরুর হেলিকপ্টারে যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। জরুরি অবতরণ করতে হয় এক বনভূমির মধ্যে। নেহরু দেখলেন, বনের যেখানে মানুষ আছেন, সেখানেই কেবল গাছপালা আছে, জঙ্গল অবশিষ্ট আছে। অন্য জায়গার গাছপালা সব সাফা।
নেহরু সিদ্ধান্ত নিলেন, বনজীবীরা বনেই থাকবেন। বন রক্ষা না হলে দেশ রক্ষা হবে না। আর বনবাসীরাই জানেন, কীভাবে বন রক্ষা করতে হবে।
নেহরুর সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। আমরা কি তেমন করে বনভূমির বিষয়টি দেখতে পারি না? মানুষকে সম্পৃক্ত করে বন রক্ষার কি কোনো তরিকা নেই? নিশ্চয় আছে। কিন্তু সেই উপায় বের করবে কারা?
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক