ছেলেকে নিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়ালেন মতিন সাহেব (ছদ্মনাম)। তাঁর ছেলে রাজধানীর একটি সেমি ইংরেজি মাধ্যমের বেসরকারি স্কুলে পড়ে। দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে তৃতীয় শ্রেণিতে উঠেছে। ভর্তির টাকা জমা দিতেই স্কুলের কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়েছেন বেসরকারি চাকরিজীবী মতিন সাহেব।
কাউন্টার থেকে জানানো হলো, ভর্তির জন্য লাগবে ৮ হাজার টাকা। আর বইয়ের দাম আড়াই হাজার টাকা। মতিন সাহেবের ছেলে দ্বিতীয় শ্রেণিতে ওই স্কুলেই পড়ত। অন্য স্কুল থেকে এই স্কুলে ভর্তির জন্য আসেনি। তাহলে এত টাকা কেন?
মতিন সাহেব কাউন্টারের ছেলেটিকে বললেন, কোন খাতে কত টাকা নিচ্ছেন, দয়া করে লিখে দেবেন। জবাবে কাউন্টারের ছেলেটি জানাল, এটা তিনি পারবেন না। ‘সেশন ফি’ হিসেবে তাঁকে ৮ হাজার টাকা নিতে বলা হয়েছে। এর বেশি জানতে চাইলে প্রিন্সিপালের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
মতিন সাহেব জানতেন, স্কুল কর্তৃপক্ষ তাঁকে এর বেশি কিছু জানাতে পারবে না। অতএব, তিনি স্কুল নির্দেশিত টাকা জমা করে নিজ কাজে বেরিয়ে পড়লেন।
মতিন সাহেবের মতো লাখো মতিন সাহেব সারা দেশে রয়েছেন, যাঁরা জেনেবুঝেও কোনো ধরনের গ্যাঞ্জাম-ফ্যাসাদ, উচ্চবাচ্যের মধ্যে যেতে চান না। যেখানে যা ‘নিয়ম’, সেইমতো কাজ ‘সমাধা’ করে আসেন। আসলে মতিন সাহেবদের মতো মানুষদের কিছু করারও থাকে না।
চারপাশে খোঁজ নিয়ে যা জানা গেল, তা হলো সেশন ফির নামে বেসরকারি স্কুলগুলো একেবারেই খেয়ালখুশিমতো টাকা আদায় করছে। স্কুলভেদে ৮, ১০, ১৫, ২৫ হাজার করে টাকা আদায় করা হচ্ছে। সন্তানের লেখাপড়ার কথা চিন্তা করে অভিভাবকেরা সব মেনে নিচ্ছেন। কারও কাছেই যেন তাঁদের অভিযোগ জানানোর নেই।
এবার এ–বিষয়ক সরকারি নীতিমালায় কী আছে, তা দেখা যাক। এতে লেখা আছে, ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় অবস্থিত আংশিক এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন এবং এমপিওবহির্ভূত শিক্ষকদের বেতন–ভাতা প্রদানের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তির সময় মাসিক বেতন, সেশন চার্জ এবং উন্নয়ন ফিসহ বাংলা মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৮ হাজার এবং ইংরেজি ভার্সনে সর্বোচ্চ ১০ হাজার টাকা গ্রহণ করা যাবে। উন্নয়ন খাতে কোনো প্রতিষ্ঠান তিন হাজার টাকার বেশি আদায় করতে পারবে না। নীতিমালার এ অংশটুকু মোটামুটি স্পষ্ট।
এরপর লেখা হয়েছে, ‘একই প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে এক ক্লাস থেকে পরবর্তী ক্লাসে ভর্তির ক্ষেত্রে প্রতিবছর সেশন চার্জ নেওয়া যাবে। তবে পুনর্ভর্তির ফি নেওয়া যাবে না।’
পুনর্ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অর্থ নেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। নীতিমালাতেও তা–ই আছে। কিন্তু তদারকি করছে কে? আদৌ কেউ করছে কি? প্রতিবছর ভর্তির এ সময়ে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা কি পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়?
এই অংশটুকুতেই যত সমস্যা। প্রথম লাইনে সেশন চার্জ নেওয়ার বৈধতা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সেশন চার্জ হিসেবে কত টাকা নেওয়া যাবে, সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে কিছু উল্লেখ নেই। এ সুযোগটিই নিচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অসাধু কর্তৃপক্ষ। পরের লাইনটিতে আছে, পুনর্ভর্তির ফি নেওয়া যাবে না। কিন্তু স্কুলগুলো এ বিষয়টি স্পষ্ট করে না। কোথাও পুনর্ভর্তির নামে, কোথাও সেশন ফির নামে টাকা নিচ্ছে তারা।
এখন সম্ভবত এই নীতিমালাটি বদলের সময় এসেছে। ‘বেসরকারি স্কুল, স্কুল অ্যান্ড কলেজে (মাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক ও সংযুক্ত প্রাথমিক স্তর) শিক্ষার্থী ভর্তি নীতিমালা-২০২২’ নামে এই নীতিমালাটির মালিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ।
সংশ্লিষ্ট অনেকের সঙ্গে আলাপ করে যে পরামর্শ এল, তাতে এটা বলা যায়, নীতিমালায় সেশন ফির ক্ষেত্রে একটি স্তরভিত্তিক কাঠামো করে দেওয়া যেতে পারে। অর্থাৎ স্কুলে লেখাপড়ার মান, শিক্ষার্থী, শিক্ষকের সংখ্যার ওপর সেশন ফি নির্ধারিত হতে পারে। এবং তা ন্যূনতম হওয়াই বাঞ্ছনীয়।
আর পুনর্ভর্তির ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অর্থ নেওয়ার সুযোগ থাকতে পারে না। নীতিমালাতেও তা–ই আছে। কিন্তু তদারকি করছে কে? আদৌ কেউ করছে কি? প্রতিবছর ভর্তির এ সময়ে এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা কি পাঠায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়?
আমাদের মাননীয় মন্ত্রী, সচিব এবং পদস্থ অন্য কর্মকর্তারা তাঁদের বক্তব্যেও এ বিষয়গুলো আনতে পারেন। কিন্তু তাদের বক্তব্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায় রাজনীতির কথা। আজকাল আবার মন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের চেয়ে আমলারাই বেশি রাজনীতির কথা বলছেন।
প্রতিবছরই এই সময়টাতে সেশন ফির নামে অভিভাবকদের পকেট কেটে নেওয়ার বিষয়ে কিছু আলাপসালাপ হয়। কিন্তু জানুয়ারি মাস গেলেই শুকিয়ে যায় ক্ষত। আমরা গণমাধ্যমকর্মীরাও সারা বছর বলা যায় একরকম চুপই থাকি।
এবার পরিস্থিতি সত্যিই ভিন্ন। সাধারণ মানুষের হাতে টাকাপয়সা নেই বললেই চলে। ডিসেম্বর মাসে বাড়ে বাসা ভাড়া। এরপর সন্তানের স্কুল ভর্তি, নতুন ড্রেস বানানো—সব মিলিয়ে অনেক খরচ হয়ে যায়। কিন্তু এই বাড়তি টাকাটা কোথা থেকে আসে? অনেকেই এ সময় ধার করেন। কিন্তু ধার দেওয়ার লোকই তো কমে যাচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যিনি ধার দিতেন, তাকেই ধার করতে হচ্ছে। এখন আর পকেট ভরে টাকা নিয়েও ব্যাগ ভরে বাজার আসছে না। বরং ব্যাগ ভরে টাকা নিয়ে পকেট ভরে বাজার করার দিন চলে এসেছে।
এমন অবস্থায় সাধারণ মানুষের জীবনে ন্যূনতম পর্যায়ে স্বস্তি যাতে আসতে পারে, সে বিষয়ে যদি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যায়, তবেই মঙ্গল। পাশাপাশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষকদের জন্য ভর্তুকি, শিক্ষা খাতে বাজেট বাড়ানোর কথাও বলতে হবে। যাতে অভিভাবকদের ওপর চাপ কম পড়ে।
লেখাটির প্রান্তে চলে আসা যাক। এটা নিশ্চিত যে হাজার চিৎকার করলেও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সেশন ফির নামে অনাচার বন্ধ করবে না। যদি নীতিমালাটি সংশোধন করা না হয়। যদি সেশন ফি নিতেই হয়, তবে তার পরিমাণ নীতিমালায় কোনো না কোনোভাবে উল্লেখ থাকুক। সবই হোক স্বচ্ছতার ভিত্তিতে, এই সামান্যটুকু চাওয়া।
কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
[email protected]