বিএনপির অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে যে সবকিছুতেই দোষ। আন্দোলন করলেও দোষ, না করলেও দোষ। ২০১৩-১৪ সালের আন্দোলনের বহু দোষ সরকারপক্ষ ধরেছে তো ধরেছে, এখনো ছাড়েনি। অনেক নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে এখনো মামলা চলছে। তবে এবারের আলোচনা-আন্দোলন করা নিয়ে নয়, না করা নিয়ে। দলটির শত্রু-মিত্র সবাই খুব হতবাক। সরকারের উন্নয়নের ফাঁকফোকর যখন ফাঁস হচ্ছে, ঋণ করে ঘি খাওয়া জাতি এখন তেল-ভাতের জন্যও আইএমএফের কাছে হাত পাতছে, অসহ্য বাজারদাম, নিদারুণ লোডশেডিং আর বেজায় মিথ্যার ফুলঝুরি; মানুষের মনে যখন ক্ষোভ জমেছে, তখন কিনা বিএনপি ভাবছে, এখনই বড় আন্দোলন নয়!
ভোলায় ছাত্রদল ও স্বেচ্ছাসেবক দলের দুই নেতা মারা গেলেন পুলিশের গুলিতে। বিদ্যুতের দাবিতে, বিদ্যুৎ খাতে অগাধ দুর্নীতি আর অনিয়মের প্রতিবাদ করতে গিয়ে। এই হত্যাকাণ্ড কেউ জায়েজ করতে পারবে না। মানুষও মনে হয় সহানুভূতিশীল। কিন্তু হরতাল তো দূরের কথা, দেশময় বিক্ষোভ ঘোষণা করেও তাঁরা দোয়ামূলক কর্মসূচিতে নেমে এলেন। সবাই হতবাক।
হ্যাঁ, ভোলার কঠোরতা একটা বার্তা। যে, নামলেই এ অবস্থা হবে। কিন্তু কবে কোন বিরোধী দল সরকারের কঠোরতা দেখে পিছিয়ে এসেছে? যে এসেছে, সে হেরে গেছে। বিএনপি মনে হয় জানে না যে কখন কঠোর আর কখন কোমল হতে হয়। অনেকেই মনে করেন, যুদ্ধাপরাধ বিচার মোকাবিলায় যে প্রতিরোধ জামায়াতে ইসলামী তৈরি করেছিল ২০১৩-১৪ সালে, তাতে বিএনপির শামিল হওয়া ঠিক হয়নি। বিএনপি অবশ্য আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচারের বিরোধিতা করেনি, কিন্তু প্রক্রিয়া নিয়ে তাদের আপত্তি ছিল। কিন্তু সে রকম আগুনে দিনগুলোয়, যখন পথেঘাটে বিএনপি-জামায়াত-ব্লগার-হেফাজত, সবারই লাশ পড়ছে, তখনো বিএনপি কৌশলী না হয়ে দলে-বলে আর চেতনায় প্রতাপশালী সরকারকে মোকাবিলা করতে গেছে। নির্বাচন বয়কট করেছে।
নন্দর মতো চিরকাল শুয়ে থেকে কাটিয়ে দেওয়া রাজনীতি নয়। যখন লড়াই করার ক্ষমতা নেই, তখন সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য তৃণমূল থেকে ওপরতলা পর্যন্ত কাজ করার আছে। যখন রাজপথ নেই, তখন মানুষের হৃদয়ের পথে চলাচল করার দরকার আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিতর্কে জেতার চেষ্টা করার দরকার আছে। যে দেশে হিরো আলম পর্যন্ত মুচলেকা দিয়ে এসেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, সে দেশে বিএনপির একি দশা!
সেই বিএনপিই কিনা আবার ২০১৮ সালের নির্বাচনে গেল, যখন তার আর যাওয়ার কোনো কারণই ছিল না। নিশিরাতের ঘটনা সেটা প্রমাণ করেছে। কিন্তু এই ২০২২ সালের মধ্যগগনে, যখন কিনা গ্রীষ্মকাল—গ্রীষ্মকালেই আন্দোলন বেশি জমে বলে গবেষকেরা দেখেছেন, তখন কিনা বিএনপি কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নন্দদুলালের মতো পণ করে বসল।
নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ—
স্বদেশের তরে যে করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন
...আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল—‘বাহবা, বাহবা, বাহবা, বেশ।’
নন্দদুলাল যেহেতু দেশের তরে প্রাণ দেবে বলে পণ করেছে, সেহেতু সে আর কোনো কিছুতেই যায় না, কোনো কাজেই হাত লাগায় না। ভাইয়ের কলেরা, নাকি করোনা হয়েছে, নন্দলাল তার কাছেও যায় না। পাছে অকালে সে-ও মারা যায়!
নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি,
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি।
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়,
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।
কিন্তু এর মধ্যেই সে এক কাণ্ড করে ফেললো:
নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;
সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;
নন্দ বলিল, ‘আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,
কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?
বলো কি’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা।’
তখন সকলে বলিল—‘বাহবা বাহবা, বাহবা বাহা!’
রাজনীতি কি এমন নাকে খত দিয়ে হয়? প্রতিপক্ষ যখন সবল, তখন বেঘোরে মারা পড়লেন, কিন্তু যখন তারা নাকি দুর্বল, তখন কী করলেন? নাহ, জনসভা হয়ে গেল দোয়া মাহফিল।
বিএনপি আন্দোলনের তরে জোট করেছে। জোটে আরও আরও দলকে আনার চেষ্টাও চলছে। ‘প্রথমত, এটা কি নির্বাচনী জোট, নাকি আন্দোলনের জোট? বাংলাদেশের ইতিহাস দেখায়, গণ-আন্দোলনে জয়ী না হয়ে কেউ সুষ্ঠু নির্বাচনেও জয়ী হয় না। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে বিজয়ীরাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলনে সবচেয়ে আপসহীনেরাই ১৯৯১ সালে সরকার গঠন করেছে। এখন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতার পালাবদলের যে লক্ষ্য বিএনপি নিয়েছে, সে জন্য তাদের আগে মাঠের আন্দোলনে জয়ী হতে হবে। আন্দোলনে জয়ী না হয়ে কেউ ভোট জয় করতে পারেনি বাংলাদেশে।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক শক্তির বর্তমান যে বিন্যাস, তাতে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে মাঠের খেলাটা বিএনপিকে একাই খেলতে হবে। তাদের দলের অনেক নেতা এই সরকারের সময়ে আন্দোলনে গিয়ে নিহত, বন্দী কিংবা পঙ্গু অথবা ঘরছাড়া হয়েছেন। অনেকে গুম হয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। বিএনপি তাই সাবধান। কিন্তু ২০২৩ সালের নির্বাচনে যদি কিছু করতে হয়, তার কাজ ২০২২ থেকেই তাদের করতে হবে।
বিদ্যুৎ-সংকট, জ্বালানিসংকট, বিদেশি মুদ্রাসংকট, মানুষ চটে আছে, সরকারের অন্তঃকোন্দলের আলামত, তাদের জোটসঙ্গীরাও সমালোচনামুখর, দেশি-বিদেশি অনেক মিত্র সরকারের ব্যাপারে সন্দিহান। এ রকম অবস্থায় বিএনপি যে মাঠ খালি রাখছে, তার কারণ কি শুধু আরও জুলুম-নির্যাতনের ভয়?
যে খবরই থাকুক, মাঠে যদি তারা দাপট দেখাতে না পারে, ওপরে বলা প্রতিটি সংকটের গ্রহণযোগ্য সমাধানের রূপরেখা যদি তারা হাজির না করে, সাহস দিয়ে ভয়ের জমাট বরফ গলাতে না পারে, তাহলে কোনো খবরই কোনো কাজে আসবে না। ইতিহাস তাদেরই তুলে আনে, যারা নিজের জোরে মাটি থেকে কিছুটা ওপরে উঠে আসতে পারে। ইতিহাস শোয়া মানুষকে দাঁড় করিয়ে দেয় না, দাঁড়ানো লোকটার ওপরই ভর করে ইতিহাস।
জনগণকে ডাক দেওয়ার ব্যাপারে বিএনপির যে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি, তা বাইরে থেকে হায়ার করে আনা কোনো নেতা, কোনো বর্ষীয়ান নাগরিক কিংবা কোনো জোটসঙ্গী মিটিয়ে দেবে না। সমালোচকেরা বলে থাকেন, অনেক ক্ষেত্র বিএনপি না বুঝে নিজে অথবা মিত্রদের পরামর্শে সরকারের পাতা ফাঁদেই পা দিয়েছে। সুতরাং মিত্র তৈরি করা ভালো, জোট গঠন করাও অস্তিত্বের জন্য প্রয়োজন। কিন্তু নিজের কাজটা তাদের নিজেদেরই করতে হবে।
কবিতার নন্দলালের মতো হলে তাদের চলবে না যে
নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি,
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি।
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়,
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়।
তাই শুয়ে শুয়ে কষ্টে বাঁচিয়া রহিল নন্দলাল,
সকলে বলিল—‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’
নন্দর মতো চিরকাল শুয়ে থেকে কাটিয়ে দেওয়া রাজনীতি নয়। যখন লড়াই করার ক্ষমতা নেই, তখন সেই ক্ষমতা অর্জনের জন্য তৃণমূল থেকে ওপরতলা পর্যন্ত কাজ করার আছে। যখন রাজপথ নেই, তখন মানুষের হৃদয়ের পথে চলাচল করার দরকার আছে। বুদ্ধিবৃত্তিক ও যুক্তিতর্কে জেতার চেষ্টা করার দরকার আছে। যে দেশে ব্যক্তি হিরো আলম পর্যন্ত মুচলেকা দিয়ে এসেও এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেন, সে দেশে বিএনপির একি দশা!
ফারুক ওয়াসিফ লেখক ও সাংবাদিক।
[email protected]