ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানের ভাবাদর্শ অনমনীয় এবং এত নির্মম যে এর পতন কঠিন। এ যেন ঠিক সোভিয়েত ইউনিয়নের শেষ পর্ব। ক্রমেই দেশটির ক্ষয়ে যাওয়া আমরা দেখতে পাচ্ছি। নিজ দেশের বাইরে ইরানি নারীরা শীর্ষ গণিতবিদ ও মহাকাশচারী। দেশের ভেতরে ক্ষমতাসীন কট্টরপন্থীরা এখনো বিতর্ক করছেন নারীদের দুই চাকার সাইকেল চালাতে দেওয়া ঠিক হবে কি না।
এক বছর আগে এই মাসেই ক্ষমতাসীনদের ‘নীতি পুলিশ’ ২২ বছর বয়সী নারী মাসা জিনা আমিনিকে আটকে রেখে মারধর করে। তাঁর দোষ ছিল ঘোমটার নিচ থেকে চুল বেরিয়ে থাকা। ইরানে নারীদের নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের কাপড় দিয়ে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। হেফাজতে মাসার মৃত্যু ১৯৭৯ সালের সরকারবিরোধী বিপ্লবের পর সবচেয়ে দীর্ঘ আন্দোলনের সূচনা করে। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৭৯ সালের ওই বিপ্লব যুক্তরাষ্ট্রের মদদপুষ্ট সাম্রাজ্যের পতন ঘটায়। সে জায়গায় আসে যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী কট্টরপন্থীরা।
ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আলী খামেনি এই আন্দোলন দমিয়ে ফেলতে সমর্থ হন। এবারও তাঁর কৌশল ছিল পুরোনো, স্বভাবসিদ্ধ। বিরুদ্ধ মতকে থামিয়ে, প্রতিপক্ষের মধ্যে ভাঙন ধরিয়ে এবং একটুও ছাড় না দিয়ে আন্দোলনকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়াস পান তিনি। এ আন্দোলনে ২০ হাজার মানুষ গ্রেপ্তার হন, নিহত হন অন্তত ৫০০ জন। নিহতদের বেশ কয়েকজনের শিরশ্ছেদ করা হয়েছিল। খামেনির মতে, চাপের মুখে নতি স্বীকার করা তাঁর দুর্বলতার প্রকাশ ঘটায়। আর বিরুদ্ধমতকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ইরানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়ে জাতীয় নিরাপত্তার ওপর। ওয়াশিংটন মনে করে, ইরানের জেনারেল কাশেম সুলাইমানিকে হত্যার প্রতিশোধ নিতে তেহরান সাবেক মার্কিন কর্মকর্তাদের হত্যা করতে চায়। এর অংশ হিসেবে তারা ভ্লাদিমির পুতিনকে ইউক্রেনে হামলায় ব্যবহারের জন্য প্রাণঘাতী ড্রোন দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বেশ কয়েকজন নাগরিক ইরানে জিম্মি হয়ে আছেন। তাঁদের পাঁচজনের তেহরানের এভিন কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা রয়েছে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই। যুক্তরাষ্ট্র এর বিনিময়ে দক্ষিণ কোরিয়ায় আটকে রাখা ইরানের ৬ বিলিয়ন ডলারের সম্পদ ফিরিয়ে দেবে বলেছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের সম্পর্কের বরফ হয়তো কিছুটা গলবে। ইরানের শীর্ষ কর্মকর্তারা যাঁরা প্রকাশ্যে জিম্মি বিনিময়কে অর্থনৈতিক নীতির অংশ বলে মনে করেন, এ বিনিময় কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।
ইরাক ও আফগানিস্তানে দুই দশক অবস্থান এবং ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক প্রভাব রাখার মতো মনের জোর আর নেই। আর একটি উদার সহনশীলবিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতি ছাড়া ইসলামিক রিপাবলিকের ভেঙে পড়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। জেফারসন ধরনের ইরানি গণতন্ত্রের বদলে বরং সামরিক সরকারের আধিপত্য বিস্তারের একটা সম্ভাবনা আছে।
বাইডেন প্রশাসনের জন্য এ মুহূর্তে বড় চ্যালেঞ্জ ইরানের পরমাণু কর্মসূচি। কারণ, এ কর্মসূচি ইসরায়েলের সামরিক কর্মকাণ্ড আরও বাড়াবে, একই সঙ্গে বাড়বে তেলের দাম। ওবামার আমলে করা চুক্তি থেকে ট্রাম্পের বেরিয়ে আসার পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। সিআইএ বলেছে, ইরান এখন পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির জন্য প্রস্তুত। পূর্ণমাত্রায় এ অস্ত্র কার্যকর করতে যে বস্তুটির প্রয়োজন, তা তৈরি হতে আর কয়েক সপ্তাহ লাগবে।
খামেনির জন্য পারমাণবিক বোমা তৈরির সিদ্ধান্ত কিছুটা বিপজ্জনক হতে পারে। ইরানের পারমাণবিক সাইটে নিয়মিত ইসরায়েল ও মার্কিনরা ঢুঁ দেয়। শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানীকে খুন এবং কিছুদিন পরপর নাশকতা চেষ্টার অভিযোগের কথা ইরান নিজেই জানিয়েছে। তা ছাড়া খামেনি যদি পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির পথে হাঁটেন, তাহলে ক্ষমতার ভারসাম্যও ঝুঁকিতে পড়তে পারে। কারণ, পরমাণু কর্মসূচির ভার থাকবে রেভল্যুশনারি গার্ডের ওপর (হয়তো দেশটি নিয়ন্ত্রণের খায়েশও তাদের রয়েছে)।
ধারাবাহিকভাবে মার্কিন প্রশাসন ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করেছে, একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যকার শীতল যুদ্ধের অবসান ঘটাতে চেয়েছে। কখনো তারা ইরান সরকারের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কে জড়াতে চায় আবার কখনো তাদের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়ায়। তাদের আশা, এসব পদক্ষেপের কারণে সরকার হয় আত্মসমর্পণ করবে, নয়তো তাদের বিস্ফোরণ ঘটবে। যুক্তরাষ্ট্রের এসব উদ্যোগে কোনো কাজ হয়নি। এখন পর্যন্ত ‘আমেরিকার মৃত্যু চাই’ ইসলামিক রিপাবলিকের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্লোগান।
বিপ্লবের অন্য একটি স্তম্ভ হলো বাধ্যতামূলক হিজাব। মাসা আমিনির মৃত্যুর এক বছর পর হাজার হাজার ইরানি নারী প্রতিদিন এই নিয়ম ভাঙছেন। সরকার চীনা ‘ফেসিয়াল রিকগনিশন টেকনোলজি’ (প্রযুক্তির মাধ্যমে চেহারা শনাক্ত করা) ব্যবহার করে নিশ্চিত হচ্ছে ‘হিজাব ও শালীনতা’ আইন কারা ভাঙছেন। নারীদের অনেকেই এসবের আর কোনো তোয়াক্কা করছেন না।
দেশের অর্থনীতির জেরবার অবস্থা। পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা না গেলে ইরানের পাঁচ কোটি মানুষকে অর্থাৎ ৭০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে দেশ ছাড়তে হবে বলে দেশটির দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, পৃথিবীর যেসব এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবার আগে মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে যাবে, তার মধ্যে প্রথমেই আছে ইরানের কিছু অংশ।
ইরাক ও আফগানিস্তানে দুই দশক অবস্থান এবং ২০১১ সালের আরব বসন্তের পর মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিবাচক প্রভাব রাখার মতো মনের জোর আর নেই। আর একটি উদার সহনশীলবিরোধী পক্ষের অনুপস্থিতি ছাড়া ইসলামিক রিপাবলিকের ভেঙে পড়ার আদৌ কোনো সম্ভাবনা নেই। জেফারসন ধরনের ইরানি গণতন্ত্রের বদলে বরং সামরিক সরকারের আধিপত্য বিস্তারের একটা সম্ভাবনা আছে।
এখন পর্যন্ত এটা একটা কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণকারী রাষ্ট্র, যার নেতৃত্ব আছেন ৮০ বছরের এক কট্টর শাসক। যে সময় ইরানের বহু মানুষের জন্মই হয়নি, সেই ১৯৮৯ সাল থেকে তিনি সর্বোচ্চ নেতা। তেহরান ঘুরে আসা আমার এক পরিচিত বলছিলেন, তাঁর জীবদ্দশায় এ দেশের পরিবর্তন আর সম্ভব নয়।
করিম সাদজাদপুর কার্নেগি এনডাওমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের জ্যেষ্ঠ ফেলো
টাইম ম্যাগাজিনে প্রকাশিত। ইংরেজি থেকে অনুবাদ।